ফাতেমা বিনতু কায়েস: নারীর সামাজিক ও অ্যাকাডেমিক অথরিটি

পর্ব ২

তুহিন খান

প্রকাশিত : মে ১৫, ২০২০

ফাতেমার সব পষ্ট মনে পড়ে। মনে হয়, এই তো সেদিনের কথা। কায়স ইবনু খালিদ আর উমাইমা বিনতু রবিআর ঘরে জন্ম নিল ফুটফুটে একটা মেয়ে; নাম রাখা হইল ফাতেমা। মক্কায় হযরত মুহাম্মদ সা. আসলেন ইসলামের বাণী নিয়া। শুরুর দিকেই স্বামী আবু আমর হাফস ইবনে মুগিরাসহ ইসলাম কবুল করলেন তিনি। হিজরত করলেন মদিনায়।

আবু আমরের সাথে সংসার কেন যেন ঠিকঠাক চলতেছিল না। সবই ঠিক আছে, তবুও কোথায় যেন একটা গণ্ডগোল। শ্বশুরবাড়ির লোকজনের মন যুগিয়ে চলা সবসময় সম্ভব হইত না ফাতেমার। সুন্দরী, গুণবতী, মুখরা (লাসিনাহ) ফাতেমার সাথে শ্বশুরবাড়ির লোকজনের নানারকম ঝামেলা হইত। এর মধ্যে আবু আমর দুই তালাক দিয়ে দিছেন তারে। এই সংসারটা আদৌ আর টিকবে কিনা, সন্দেহ হইতেছিল ফাতেমার।

তারপর আসল ১০ম হিজরি সন। রাসুলের ওফাতের বছর। ওফাতের কয়েক মাস আগে হযরত আলির নেতৃত্বে ইয়েমেনের দিকে একটা বাহিনী পাঠাইলেন রাসুল সা.। হযরত ফাতেমার জামাই আবু আমরও সেই বাহিনীতে যোগ দিলেন। ইয়েমেনের দিকে রোখ করা অবস্থায়ই, আবু আমর তাদের বিয়ের উকিল হযরত আয়াশ ইবনু রবিআর মারফত খবর পাঠান হযরত ফাতেমার কাছে: আমি তোমারে তৃতীয় তালাক দিলাম। তালাকের খবর দেয়ার পর হযরত আয়াশ পাঁচ সা` যব আর পাঁচ সা` খেজুর হযরত ফাতেমার হাতে দেন, তার ইদ্দতকালীন সময়ের খোরাকি হিশেবে।

ফাতেমার মনে পড়ে, এই যব আর খেজুর দেইখা তখন কীরকম মেজাজ খারাপ হইছিল তার! তিনি আয়াশের কাছে ইদ্দতের সময়টাতে থাকার জন্য ঘর আর খাওয়ার খরচ দাবি করলেন। আয়াশ তখন বিরক্তির সুরে বললেন: তোমার জামাই যা দিছেন, এইটা অনুগ্রহ ও সহমর্মিতা। আমাদের কাছে এখন আর তোমার কোনও অধিকার পাওনা নাই।

কুরাইশের সম্ভ্রান্ত, রূপবতী, গুণবতী, বাগ্মী নারী ফাতেমা কারুর করুণার দান নেবেন কেন? তিনি সাফ জানায়ে দিলেন, যদি কিছু নেন, অধিকার হিশাবেই নেবেন। আর অধিকার না থাকলে কিছুই নেবেন না। আবু আমরের অনুগ্রহ নেওয়ার তো ঠ্যাকা পড়ে নাই তার! সাথে সাথে কাপড়-চোপড় গুছায়ে ফাতেমা চললেন রাসুলের কাছে। আবু আমরের ফ্যামিলির কাছে কোনও অধিকার পাওনা আছে কিনা, জানতে হবে। হযরত ফাতেমার এই উদ্যোগ ইসলামি আইনশাস্ত্রের ইতিহাসে কি বিরাট দৃষ্টান্তমূলক বিতর্ক তৈরি করবে, উনি কি জানতেন!

হযরত ফাতেমা রাসুলের স. কাছে গেলেন। দেখলেন, খালেদ বিন ওয়ালিদসহ আরো কয়েকজন সাহাবি দাঁড়ায়ে আছেন। তিনি সোজা রাসুলের কাছে গিয়ে, সমস্ত কিছু খুইলা বললেন। রাসুল সা. সব শুনে জিগেশ করলেন, `কয় তালাক হল?` ফাতেমা বললেন, তিন তালাক (কোনও কোনও বর্ণনায় `তিন তালাক` সংশ্লিষ্ট প্রশ্নোত্তর নাই)। রাসুল সা. বললেন, `তাহলে এখন তোমার থাকা-খাওয়ার দায়িত্ব আবু আমরের নেয়া জরুরি না।` তারপর রাসুল সা. তারে উম্মে শুরাইকের ঘরে ইদ্দত পালন করতে বললেন। পরে আবার ডেকে বললেন, `উম্মে শুরাইকের ঘরে তার আত্মীয়-স্বজন আসে যায়, তুমি আব্দুল্লাহ ইবনু উম্মে মাকতুমের ঘরে ইদ্দত পালন করো। সে অন্ধ, আবার তোমার চাচাত ভাই। ইদ্দত শেষ হইলে আমাকে খবর দিও।`

হযরত ফাতেমা আবু আমরের অনুগ্রহ নিলেন না। ইবনু উম্মে মাকতুমের ঘরেই ইদ্দত শেষ করলেন। ইদ্দত শেষ হওয়ার পরে অনেকে বিয়ের প্রস্তাব দিতে লাগল। মুয়াবিয়া ইবনু আবি সুফিয়ান রা. প্রস্তাব দিলেন। আবু জাহম প্রস্তাব দিলেন। উসামা ইবনু যায়েদ প্রস্তাব দিলেন। ফাতেমা রাসুল সা.-এর পরামর্শ চাইলেন। রাসুল সা. তাকে হযরত উসামার সাথে বিয়ে দিলেন। হযরত ফাতেমার প্রথমে একটু দ্বিধা থাকলেও, পরে উনি রাজি হন। এবং নিজের মুখেই বলেন, `সেই সংসারে সুখ ছিল।`

ঘটনাটা এইখানেই শেষ হইতে পারত। কিন্তু রাসুল সা.-এর হাদিস যেহেতু ইসলামি আইনের অন্যতম প্রধান উৎস, তাই ঘটনাটা শেষ হয় না। তালাকের পরে ইদ্দত শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত, বউয়ের থাকা-খাওয়ার ব্যয়ভার জামাই বহন করবে কিনা, এই মাসালা নিয়া বিতর্ক শুরু হইল হযরত উমরের আমলে। এই বিতর্ক পরবর্তীতে ইসলামি আইনশাস্ত্র, হাদিসশাস্ত্র, ইসলামি জ্ঞানচর্চা ও সমাজে নারীদের ধর্মীয় এজেন্সি বিষয়ক ধারণাগুলিরে প্রভাবিত করতে থাকবে যুগের পর যুগ। কিন্তু সে আলাপ যথাস্থানে।

হযরত উমরের সময়ে এই মাসালা নিয়ে বিতর্ক দেখা দিল। হযরত ফাতেমা তার এই ঘটনা এবং রাসুলের সিদ্ধান্ত সবাইরেই বলতেন। কিন্তু অনেক সাহাবি তার এই সিদ্ধান্তের সাথে একমত হইতে পারেন নাই। তাদের কাছে এইটা কোরআনের আয়াতের সাথে সাংঘর্ষিক ছিল। কোরআনের সুরা তালাকের প্রথম আয়াতে বলা হইছে, `হে নবী! যখন তোমরা (মুমিনরা) তাদের স্ত্রীকে তালাক দেবে, তখন ইদ্দতের দিকে খেয়াল রাখ, এবং ইদ্দতের ঠিকঠাক হিশাব রাখ।....তোমরা (এই অবস্থায়) স্ত্রীদের ঘর থেকে বের করে দিও না, তারাও যেন বের হয়ে না যায়। তবে যদি কোন অশ্লীল কাজ তারা করে ফেলে (সেটা আলাদা ব্যাপার)।.... তুমি জানো না, এরপরে আল্লাহ হয়ত ভাল কিছু ঘটাবেন। ইদ্দত শেষ হয়ে গেলে তাদেরকে আবার উত্তমপন্থায় ফিরিয়ে নেও, অথবা ভালভাবে আলাদা হয়ে যাও।....তোমাদের সাধ্যমত তোমরা যেখানে থাক, তাদেরকেও সেইখানেই রাখ; তাদের সাথে এমন খারাপ আচরণ কর না, যেন তাদের জীবনযাপন কষ্টকর হয়ে পড়ে।....। (৬৫: ১-২, ৬)।

এই আয়াতে তালাকের পরে স্ত্রীরে ঘরে রাখার কথা বলা হইছে। এই আয়াতের ভিত্তিতে হযরত উমরসহ অন্য অনেক সাহাবি হযরত ফাতেমার হাদিসের উপরে আপত্তি তোলেন। শেষমেশ হযরত উমর বইলাই ফেলেন, `একজন নারী, পুরা ঘটনা যার ঠিকমত মনে আছে কিনা আদৌ, কে জানে— তার কথায় আমরা আল্লাহর কিতাব ও রাসুলের সুন্নাহ ছাড়তে পারি না। এই অবস্থায় স্ত্রী স্বামীর কাছে থাকা-খাওয়ার জায়গা ও খরচ পাবে।` হযরত ফাতেমা এই আপত্তির জবাব নিজেই দিয়া গেছেন।

সাইদ ইবনু যায়েদের মেয়ে ছিলেন আব্দুল্লাহ ইবনু আমরের বউ। হযরত ফাতেমা ছিলেন ওই মেয়ের খালা। আব্দুল্লাহ তারে তালাক দেওয়ার পরে, ফাতেমা তারে স্বামীর ঘর ছাইড়া চইলা আসতে বলেন। তখন মদিনার গভর্নর মারওয়ান হযরত ফাতেমার কাছে কুবাইসা ইবনু যুআইবরে পাঠান, হাদিসটা তার নিজের মুখে শোনার জন্য। তিনি হাদিস বর্ণনা করেন। সব শুনে মারওয়ান বলে, এই হাদিস একজন মাত্র নারী বর্ণনা করছে। আমরা সর্বসম্মত মতের উপরর আমল করব। হযরত ফাতেমা এই কথা শুইনা বললেন, এই যে কোরআন রাখলাম তোমার আমার সামনে। আল্লাহ বলছেন, (সুরা তালাকের আয়াত দ্রষ্টব্য)। এই আয়াতের যে হুকুম, সেইটা তালাকে রজঈ বা সাময়িক তালাকের (যে তালাকের পরে আবার স্ত্রীকে ফিরায়ে নেওয়া যায়) ক্ষেত্রে প্রযোজ্য (আর তিন তালাক বা ফাইনাল তালাকের ক্ষেত্রে আমার হাদিসের হুকুম প্রযোজ্য)। নাইলে, `আল্লাহ হয়ত এরপরে ভাল কিছু ঘটাবেন`— এর অর্থ কী! তিন তালাকের পরে তো সম্পর্কই শেষ, তখন আর কী ভাল ঘটবে? (সুতরাং, এই আয়াত তিন তালাক না, এক বা দুই তালাকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য)।

একটা হাদিসের ভিত্তিতে সাহাবিদের কারো কারো মত ছিল, স্ত্রী গর্ভবতী হইলেই শুধু খরচ পাবে। নতুবা পাবে না। তিনি এই মতটারেও দলিল হিশেবে ব্যবহার করে বলেন: (তোমাদের মতানুযায়ী) গর্ভবতী না হইলে যদি খরচ না পায়, তাইলে তারে ঘরে আটকাইয়া রাখবা কোন দুঃখে? ইমাম শা`বি, হযরত ফাতেমার একান্ত শাগরিদ, তিনিও কিন্তু হযরত উমরের যুক্তি মানেন নাই। আবু ইসহাক, আসওয়াদ আর শা`বি একদিন মসজিদে বসা। তো, ইমাম শা`বি হযরত ফাতেমার হাদিসটা বয়ান করলেন। আসওয়াদ সাথে সাথে ছোট একটা পাথর নিয়া শা`বির গায়ে ছুঁইড়া মারলেন, বললেন: তুমি ধ্বংস হও! এই মত তোমার? অথচ হযরত উমর বলছেন....`। ইমাম শা`বি চুপ থাকেন নাই। অনেক কাছ থেকে দেখছিলেন তিনি হযরত ফাতেমাকে। সেই ফাতেমা, যিনি দাজ্জাল বিষয়ক দীর্ঘতম হাদিসটা হুবহু বর্ণনা করছিলেন। শা`বি বলেন, কুরাইশের এক নারী, যার জ্ঞান ও প্রজ্ঞার কথা সবাই জানে, উনি নিজের বিপক্ষে যাওয়া একটা রায় ভুইলা যাবেন?!

অনেক পরে, ইবনু তাইমিয়ার শিষ্য ইবনুল কায়্যিম জাওযিয়্যা তার `যাদুল মা`আদ` বইতে হযরত উমরের এই আপত্তির শক্ত জবাব দেন। তিনি বলেন, স্বামীর মৃত্যুর পরে বউ কোথায় ইদ্দত পালন করবে, এই মাসালায় ফুরাইয়াহ বিনতু মালিকের হাদিস আপনারা গ্রহণ করেন। অথচ হযরত ফাতেমা তার চাইতে অনেক বেশি বিচক্ষণ ও বিজ্ঞ ছিলেন। তার হাদিস গ্রহণে অসুবিধা? আর ভুইলা যাওয়ার সম্ভাবনা? তো এইটা যদি ত্রুটিই হয়, তাইলে হযরত উমরেরও এই ত্রুটি আছে। হযরত উমর ফরজ গোসলের বদলেও যে তায়াম্মুম করা যায়, এই হাদিস ভুইলা গেছিলেন; পরে আম্মার ইবনু ইয়াসির মনে করায়ে দিছেন। স্ত্রীকে যত বেশি ইচ্ছা মোহর দেওয়া যাবে, এইটা কোরআনের আয়াত থেকে সাব্যস্ত। ওমর এর বিরুদ্ধেও বলছিলেন, পরে এক নারীর কথায় আবার নিজের মত ফিরায়ে নিছেন। সুতরাং, যদি ভুইলা যাওয়ার সম্ভাবনার কারণে হযরত ফাতেমার হাদিসে সমস্যা হয়, তাইলে হযরত উমরের হাদিসেও সমস্যা থাকার কথা! চলবে