ফাহমিনা হাসানাতের প্রবন্ধ ‘আল হালিম’

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১০, ২০২৩

আল্লাহর নাম আল হালিম। মানে, সবচেয়ে সহনশীল, চিরন্তন শান্ত, সবচেয়ে দয়ালু ও কোমল। কুরআনে শব্দটি এগারোবার এসেছে। তিনি দৃশ্যমান ও গোপন, উভয়ভাবেই আশীর্বাদ প্রদান করেন। এমনকি যদি আমরা তার অবাধ্যও হই। আল হালিম চাইলেই তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের শাস্তি দিতে পারেন। তবুও তিনি কতবার আমাদেরকে মৃদু ও নির্মলভাবে অবকাশ দেন, আমাদেরকে তার দিকে ফিরে যাওয়ার সুযোগ দেন!

 

হালিম এসেছে ح-ل-م এর মূল থেকে, যা তিনটি প্রধান অর্থ নির্দেশ করে। ১. সহনশীল, নম্র ও ক্ষমাশীল হওয়া। ২. শান্ত ও নির্মল হওয়া। ৩. তাড়াহুড়া না করা এবং সংযম প্রদর্শন করা।

 

এই মূলটি কুরআনে ২১ বার দুটি উদ্ভূত রূপে উপস্থিত হয়েছে। এই রূপগুলির উদাহরণ হলো احلمين - আহলামিন (স্বপ্ন), الحلم- আল হুলুমা (বয়ঃসন্ধি), আহলামুহুম (তাদের মন), এবং হালিমিন (সহনশীল)।

 

ভাষাগতভাবে, حلم ধৈর্যের ধারণাকে বোঝায়, যা গভীর প্রশান্তি ও নম্রতার অনুভূতি থেকে উদ্ভূত; এবং সবরের ধারণা যা আত্মসংযম ও অভিযোগ ছাড়াই কিছু সহ্য করা থেকে উদ্ভূত। আল হালিম তার প্রতি আমাদের অবাধ্যতা প্রত্যক্ষ করেন। তবুও রাগ তাকে প্ররোচিত করে না। ক্রোধ তাকে গ্রাস করে না। তিনি তাড়াহুড়ো করেন না। এবং বেপরোয়া হয়ে প্রতিশোধ গ্রহণ করেন না। যদিও তিনি পুরোপুরিভাবে তা করতে সক্ষম।

 

আল হালিম নিজেই বলেন, যদি তোমরা আল্লাহকে উত্তম ঋণ দাও, তিনি তা তোমাদের জন্য দ্বিগুণ করে দেবেন এবং তোমাদের ক্ষমা করবেন। আল্লাহ গুণগ্রাহী, পরম ধৈর্যশীল।

 

আল্লাহ কেন শাস্তি বিলম্বিত করেন? আল হালিম বলছেন, যদি আল্লাহ মানুষদেরকে তারা যা অর্জন করেছে তার জন্য পাকড়াও করতেন, তাহলে জমিনের ওপর একটি প্রাণীকেও তিনি ছেড়ে দিতেন না। কিন্তু তিনি একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তাদেরকে বিলম্বিত করে থাকেন।

 

আল হালিম আপনার শাস্তিকে বিলম্বিত করেন যাতে আপনি তার কাছে ফিরে আসতে পারেন, তার কাছে ক্ষমা চাইতে পারেন এবং আপনার পথ পরিবর্তন করতে পারেন। কারণ তিনি সহনশীল। এমনকি তিনি আপনার শাস্তি সম্পূর্ণ বাতিলও করতে পারেন। আল হালিম কি আমাদের প্রতি তাঁর ভালবাসাকে এক আশ্চর্যজনক উপায়ে প্রকাশ করছেন না?

 

কল্পনা করুন যে, আপনি খারাপ কিছু করতে গিয়ে ধরা পড়েছেন, কিন্তু যার কাছে আপনি ধরা পড়েছেন সে আপনাকে শাস্তি দিল না, বা আপনাকে বিব্রত করল না। এক্ষেত্রে আপনি কি তার প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করবেন না? আপনি কি তাকে বলবেন না যে, আপনি এ কাজ আর কখনো করবেন না এবং তার সহনশীলতার জন্য আপনি তার কাছে কৃতজ্ঞ? তাহলে আল্লাহর ব্যাপারে একবার চিন্তা করে দেখুন।

 

প্রতিদিন আমরা এমন কিছু করি যা আমাদের করা উচিত নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তিনি আমাদের অবকাশ দেন। কারণ তিনি আল হালিম, তার সহনশীলতা যে কোনো মানুষের সহনশীলতার ঊর্ধ্বে।

 

সন্তান লালন-পালন আমাদের আল হালিম সম্পর্কে শিক্ষা দেয়; পিতা-মাতার অন্তরে তাদের সন্তানদের প্রতি কোনো বিদ্বেষ বা ঘৃণা নেই, বস্তুত তারা সন্তানের সুখের জন্য সবকিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত। এ প্রসঙ্গে উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলেন: কিছু বন্দিকে রাসুলের (ﷺ) কাছে আনা হয়েছিল। তাদের মধ্যে একজন মহিলা ছিলেন যিনি তার সন্তানের খোঁজ করছিলেন। যখন তিনি তার সন্তানকে দেখতে পেলেন তিনি তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।

 

রাসুলের (ﷺ) আমাদেরকে বললেন, তোমরা কি মনে করো যে, এই মহিলা তার সন্তানকে আগুনে নিক্ষেপ করবে? আমরা বললাম, না। আল্লাহর কসম, তার পক্ষে সম্ভব নয়।

 

রাসুলের (ﷺ) বললেন, এই মহিলা তার সন্তানের প্রতি যতটা দয়ালু, আল্লাহ তার বান্দাদের প্রতি তার চেয়েও বেশি দয়ালু।

 

কখনো কি ভেবে দেখেছেন, কে একজন স্নেহময়ী মায়ের হৃদয়ে মহান করুণা ও কোমলতা দিয়েছেন? আল্লাহ আল হালিম। আল্লাহর এই নামটিকে নিজের জীবনে কিভাবে প্রয়োগ করবেন?

 

অন্যদের প্রতি সহনশীল হোন। এ ব্যাপারে গভীরভাবে চিন্তা করুন এবং সহনশীলতার অনুশীলন করুন। মানুষের মেজাজ যাই হোক না কেন, সবাই সহনশীলতার অনুশীলন করতে পারে। রাসুল (ﷺ) আব্দুল কায়েসকে বলেন, আপনার মধ্যে দুটি গুণ রয়েছে যা আল্লাহ পছন্দ করেন: ধৈর্য ও স্থিরতা।

 

আপনি কি তখন সহিষ্ণুতার পরিচয় দেন যখন আপনি একবার বা দুইবার উপেক্ষা করেন কিন্তু তৃতীয়বার রাগে বিস্ফোরিত হন? শুধুমাত্র রাগের কারণে অনেক সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়। حلم হলো যখন আপনি রাগ দেখানোর অবস্থানে থাকেন কিন্তু তারপরও তা নিয়ন্ত্রণে রাখেন। কিভাবে? আল হালিম দ্বারা নিজেকে অনুপ্রাণিত হতে দিন।

 

আরেকটি উপায় হলো, আল হালিমের জন্য সহনশীলতা অনুশীলন করুন। যদিও আপনি রাগান্বিত বোধ করেন। নিজেকে বলুন, আমি আমার রাগ দমন করছি। কারণ আমি তাকে ভালবাসি এবং তার ভালবাসার প্রত্যাশী। কারণ, আমি তার নিকটবর্তী হতে চাই এবং আমি তার রাসুলকে (ﷺ) মান্য করতে চাই।

 

আল্লাহর حلم এর সুযোগ নেবেন না। যারা উত্তরাধিকারসূত্রে একটি বাগান পেয়েছিল কিন্তু গরিবদেকে তা থেকে উপকৃত হতে দেয়নি, আল হালিম সেসব লোককে বলেন, আযাব এ রকমই হয়ে থাকে। আর আখিরাতের আযাব তো সবচেয়ে কঠিন। যদি তারা জানত!

 

এই শাস্তি ছিল তাদের জন্য জেগে ওঠার আহ্বান ও করুণা। কারণ তারা তাদের ভূল বুঝতে পেরেছিল। আল্লাহ যদি তাদের স্বেচ্ছাচারিতার মধ্যে ছেড়ে দিতেন, তাহলে পরকালে তাদের শাস্তি অপ্রত্যাশিত হতো। সুতরাং জেনে রাখুন, আল হালিম আপনার জন্য নিয়ম নির্ধারণ করেছেন, কাজেই কখনই তার সহনশীলতার সুযোগ নেবেন না।

 

একজন পাপী ব্যক্তির কাছে একটি উত্তম উদাহরণ প্রদর্শন করুন। একজন পাপী ব্যক্তির কাছে কখনই নিজের অহংকার প্রকাশ করবেন না বরং তাকে নম্রভাবে এবং ভাল উদাহরণ প্রদর্শনের মাধ্যমে উপদেশ দেওয়ার চেষ্টা করুন। নিজেকে নিয়ে চিন্তা করুন: এই পাপী ব্যক্তি, একদিন আন্তরিক অনুতাপের সাথে আল হালিমের দিকে প্রত্যাবর্তন করতে পারে এবং আল্লাহর কাছে আমার চেয়ে ভাল এবং প্রিয় হয়ে উঠতে পারে। শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য একজন পাপীকে সংশোধনের চেষ্টা করুন, যাতে সে তার কর্মের পরিণতি সম্পর্কে সচেতন হয় এবং আল্লাহর কাছে ফিরে আসে।

 

আল্লাহর حلم এর জন্য কৃতজ্ঞ হন। কেউ আপনার দোষ ত্রুটি উপেক্ষা করলে আপনি যেমন কৃতজ্ঞ বোধ করেন, ঠিক তেমনি আপনার প্রতি আল হালিমের চরম এবং তীব্র সহনশীলতাকে উপলব্ধি করুন এবং পাপ করার পরে তাঁর কাছে ফিরে আসুন। এবং আল হালিমের সহনশীলতার জন্য কৃতজ্ঞ হওয়ার উপায় হিসাবে, নিজেকে ধৈর্যশীল হতে প্রশিক্ষণ দিন।

 

আল হালিমের কাছে দু`আ করুন আপনার এবং আপনার প্রিয়জনদের প্রতি তাঁর সহনশীলতা প্রদর্শনের জন্য। তাঁর ক্ষমার জন্য প্রার্থনা করুন, কারণ একমাত্র তিনিই পারেন আপনাকে তাঁর ন্যায়সঙ্গত ক্রোধ থেকে রক্ষা করতে।

 

হে আল্লাহ, আল হালিম, আমরা জানি, আপনি সবচেয়ে সহনশীল এবং আপনি আপনার শাস্তি বিলম্বিত করেন এবং অনেক সময় তা প্রজ্ঞার সাথে বাতিল করেন। খারাপ কাজে নিয়োজিত থেকে আপনার حمل এর সুবিধা নেওয়া থেকে আমাদের রক্ষা করুন, পাপ করার পরে আমাদেরকে আপনার কাছে ফিরে আসতে সহায়তা করুন। আপনার সহনশীলতার জন্য যেন আমরা কৃতজ্ঞ হতে পারি এবং কষ্টের সময় ধৈর্য ধারণ করতে পারি।

 

হে আল হালিম, আপনি আমাদের সহায়তা করুন। আমাদেরকে এমন লোকদের অন্তর্ভুক্ত করুন যারা অন্যের প্রতি সহনশীল এবং দয়ালু। আমরা যেন কখনো অহঙ্কার প্রকাশ না করি এবং ক্রোধের সময় আমাদের حلم বিকাশ করতে পারি সে ব্যাপারে আমাদের সহায়তা করুন, আল্লাহুম্মা আমিন।