ফুকোর বয়ানে ক্ষমতার রূপ-রূপান্তর ও ডিস্কোর্স নিয়ন্ত্রণ

জগলুল আসাদ

প্রকাশিত : মে ০৯, ২০২১

ফুকো ইদানীং কমনসেন্স হয়া গেলেও মাঝে মাঝে পুরানা কথা মনে করিয়ে দেয়া জরুরি। তো ফুকো, আপনারা জানেন, ক্ষমতার কয়েকটি রূপ ও রূপান্তরের কথা কইছেন। এই রূপগুলোকে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে হয় একত্রে না হয় কিছুটা বিচ্ছিন্নভাবে কাজ করতে দেখা গেছে। তিন ধরনের ক্ষমতা  নিয়ে আজ ফুকোর আলাপটা সংক্ষেপে করা যাক। অর্থাৎ স্মরণ করা যাক।

একটা হলো Sovereign power। এটার বৈশিষ্ট্য হলো, সে সার্বভৌম, প্রকাশ্যে শাস্তি দেয়, কোনো কিছুকে তোয়াক্কা না করে। এই ক্ষমতা নির্যাতক ও নিপিড়নকারী। ক্রিমিনালের শরীর যেন নিজেই সাক্ষ্য দেয় তার অপরাধের। ইউরোপে সসপ্তদশ শতকে ক্ষমতার এই চেহারা বিশেষভাবে খেয়াল করেন ফুকো। এই ক্ষমতা রিচুয়ালাইজড ও সিম্বোলিক। বেশ আয়োজন করে এই শাস্তি প্রদান করা হতো। যাতে ওই বিশেষ শাস্তি সকলের জন্যে বার্তা হয়ে ওঠে।

Discipline and Punish বইয়ের The Spectacle of the Scaffold চ্যাপ্টারে এই নিয়ে বিশদ পাবেন। এর আগের চ্যাপ্টার The body of the condemned এও পাওয়া যাবে। এ দুটো অধ্যায় বইটির Torture শিরোনামের অধীন। বর্তমানে এই ক্ষমতার রূপ ধরতে পারেন রাস্তাঘাটে ‘বৈধ’ অস্ত্রে নাগরিক হত্যাকে। আরেকটা রূপ হইলো, Disciplinary power। এই ব্যবস্থা অনেকটা গোপনেই সারা হয়, আগেরটির মতো প্রকাশ্যে নয়।

নাগরিকদের বাগে রাখবার জন্যে এই ক্ষমতার প্রয়োগ হয় নানারূপে, নানা প্রতিষ্ঠান ও আইনি প্রকৃয়ার মধ্য দিয়ে। কারাগার এরমধ্যে একটা। জেরেমি বেন্থাম কথিত প্যানঅপটিকনের ধারণা এই ডিসিপ্লিনারি ক্ষমতার ভালো উদাহরণ। প্যানঅপটিকন এমন এক কারাগার ব্যবস্থা যেখানে গার্ড সমস্ত বন্দির ওপর নজর রাখতে পারে নিজেকে লুকিয়ে। সবার অজান্তেই সবাইকে নজরবন্দি রাখা এই ব্যবস্থার উদ্দেশ্য, এই নজর বন্দিত্বই এক প্রকারের শাস্তি।

অনুগত-বাধ্য নাগরিক তৈরির আধুনিক ব্যবস্থাপনাকে রাষ্ট্রের Disciplinary power বলা হয়। ব্যাংক স্টেটমেন্ট তলব, নৈতিক নজরদারি, মামলার ভয়, টেলিফোনে আড়িপাতা বা ফোনকল ফাঁস ইত্যাদির মাধ্যমে রাষ্ট্র Docile Body বা বশ্য-বাধ্য ব্যক্তি তৈরি করে। এখানে এই কথাও যোগ করা যায় যে, যে সত্য রাষ্ট্রের জন্যে বিব্রতকর, সেটা লুকোনো; বিশেষ অস্বস্তিকর ‘সত্য’কে লুকিয়ে ক্ষমতার জন্যে স্বস্তিকর ‘সত্য’ নিয়ে আলাপের পরিবেশ তৈরি করা।

যে সত্য ক্ষমতার জন্যে স্বস্তিকর সেটা প্রকাশ্যে আনা ও প্রচার করার ব্যবস্থা করা ডিসিপ্লিনারি পাওয়ারেরই অন্তর্ভুক্ত। প্রচারণার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় মিথ্যা সরবরাহ করে হলেও নাগরিকদের বাগে রাখা শৃঙ্খলামূলক ক্ষমতার নজির। Normalisation বা স্বাভাবিকীকরণও এই ব্যবস্থার একটা মোজেজা। লোকে নিজের বন্দিত্বকেই স্বাভাবিক ভাববে, ভিন্ন কিছু ভাবাই মনে হবে অস্বাভাবিকতা। Disciplinary power এর অন্তরের ভেতরের জিনিসই হচ্ছে, নিজ ক্ষমতাকে সংহত করা।

আরেকটাকে বলে রাষ্ট্রের জৈব ক্ষমতা বা Biopower। রাষ্ট্র শুধু নীপিড়নমূলক বা নজরদারিমূলক ব্যবস্থা দিয়েই জনগণের উপর নিজের ক্ষমতা সুপ্রতিষ্ঠিত রাখে না, বরঞ্চ একালে বহু ‘জৈবিক’ বিষয়াদির ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়েও সে তার জরুরতকে অব্যাহত রাখে। জনসংখ্যা, যৌনতা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি মডার্ন স্টেইটের বিশেষ বিবেচনার জায়গা। প্রসূতি ও চিকিৎসা ব্যবস্থা, জনসংখ্যা বৃদ্ধি বা নিয়ন্ত্রণ, টীকা কার্যক্রম ইত্যাদি ইতিবাচক ক্রিয়ার মাধ্যমে বায়োপাওয়ার কাজ করে।

পরিসংখ্যান তৈরি, বিভিন্ন এক্সপার্ট গ্রুপ ও পেশাজীবি তৈরি  করা এই বায়োপাওয়ারের নজির। মনিটরিং ও কন্ট্রোলের এই প্রোডাকটিভ ক্ষমতাকেই বায়োপাওয়ার বলা হয়। এই পাওয়ার রিপ্রেসিভ না, প্রোডাক্টিভ। ফুকো এই কাজগুলোর নাম দেন Governmentality বা প্রশাসনিকতা (পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের অনুবাদ) যার মাধ্যমে বিভিন্ন সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান পপুলেশনকে নিয়ন্ত্রণ করে। যাই হোক, ফুকোর তত্ত্বের নানা ক্রিটিকও আছে। তা সত্ত্বেও, ক্ষমতা কিভাবে কাজ করে— মাইক্রো ও ম্যাক্রো পরিসরে—  তা বুঝতে ফুকো এখনো সহায়ক।

লেখক: শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক