বর্তমান পরিস্থিতিতে মসজিদে ‍জুম্মার নামাজ

তুহিন খান

প্রকাশিত : মার্চ ২০, ২০২০

করোনা মহামারিতে মসজিদে জুমা আদায় উচিত কী উচিত না, পরিস্থিতি আর কদ্দুর নাজুক হইলে জুমা বা জামাতের বিকল্প ব্যবস্থার (ঘরে জামাত ইত্যাদি) কথা ভাবা যাইতে পারে, সেই ব্যাপারে দায়িত্বশীল ফয়সালা ওলামায়ে কেরামই করবেন, আমরা এই আশা রাখি। আশা রাখার পাশাপাশি, এই ব্যাপারে কিছু আলাপও চালু রাখা দরকার মনে হইল।

এমনিতে বিশেষ ওজরের কারণে জামাতে নামাজ আদায়ের ব্যাপারে `রুখসত` আছে, এইটা তো খুব কমন মাসালা। তবে জুমার জামাতে রুখসত আছে কিনা, এইটা নিয়া আমাদের এইখানে চর্চা কম। যেহেতু জুমা খুবই গুরুত্বপূর্ণ নামাজ, নানা কারণেই, ফলে এই ব্যাপারটা আমাদের কাছে একটু বেখাপ্পা লাগে।

জুমার নামাজে রুখসত আছে কিনা, থাকলে তার সুরত কী কী, এইসব ব্যাপারে চূড়ান্ত কোনও আলাপ মুফতি সাহেবরা করলেই বেটার। তবে হাদিস ও ফেকাহর হিস্ট্রিতে এই মাসালাটার আলাপ কেমন, সেইদিকে একটু নজর দিতে পারেন সবাই-ই। বুখারি শরিফে এই ব্যাপারে অনেকগুলা হাদিস আসছে। তার মধ্যে তিনটা হাদিস বিশেষভাবে, বিশেষ পরিস্থিতিতে জুমার নামাজে রুখসত আছে কিনা, এই বিষয়ে।

প্রথম হাদিসটা আসছে `কিতাবুল আযান`য়ে। `আযানের মধ্যে কথা বলার অধ্যায়`য়ে, ৬১৬ নম্বর হাদিস এইটা। দ্বিতীয় হাদিসটাও `কিতাবুল আযান`য়ের, `প্রবল বৃষ্টির দিনে জুমার খুতবা দেয়া যাবে কিনা` অধ্যায়ে, ৬৬৮ নম্বর হাদিস। তিন নম্বর হাদিসটা আসছে `কিতাবুল জুমা`য়, `বৃষ্টির কারণে জুমায় না আসার রুখসতের অধ্যায়`য়ে, ৯০১ নম্বর হাদিস।

তিনটা হাদিসের সনদ ও টেক্সটে কিছু পার্থক্য থাকলেও এর মোটামুটি অর্থ এইরকম, `আব্দুল্লাহ ইবনে হারিস বলেন, ‘(বৃষ্টির পর) এক কর্দমাক্ত দিনে ইবনে আব্বাস রা. জুমার বয়ান করলেন। তারপর মুয়াজ্জিন যখন `নামাজের দিকে আসো` বলবেন, তখন তিনি তাকে `ঘরে নামাজ পড়ো` বলতে বললেন। লোকজন এমনভাবে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করা শুরু করল, যেন ব্যাপারটা তাদের খুব একটা পছন্দ হয় নাই। তখন ইবনে আব্বাস রা. বললেন, তোমাদের কি ব্যাপারটা পছন্দ হইল না? আমার চাইতে উত্তম মানুষ (রাসূল স.) এই কাজ করছেন। অবশ্যই জুমা `আজিমত`, কিন্তু আমি তোমাদের কষ্ট দিতে পছন্দ করি না।’

এই হাদিসের ব্যাখ্যায় আল্লামা আনওয়ার শাহ কাশ্মিরি রহ. লিখছেন, `আমাদের কাছে এই মতের উপরেই ফতোয়া, তবে ফতোয়া চাওয়া লাগবে মন থেকে (মানে আসলেই পরিস্থিতি সেরকম খারাপ হওয়া লাগবে)।

আবুল হাসান শিয়ালকোটি রহ. এই হাদিসের ব্যাখ্যায় লেখেন, `এই হাদিসের মাধ্যমে একথা পষ্ট হয় যে, প্রচণ্ড বৃষ্টির দিনে কেউ যদি জুমায় না যায়, তাহলে গুনাহ হবে না। এবং বৃষ্টি থামার পরে যদি রাস্তাঘাট খুব বেশি কর্দমাক্ত হয়ে যায়, তাইলেও জুমার ব্যাপারে রুখসত থাকবে।

ইবনে হাজার আসকালানি রহ. এই হাদিসের ব্যাখ্যায় বলতেছেন, জমহুর ওলামায়ে কেরাম এমনই বলছেন। তবে অনেকেই বেশি বৃষ্টি আর কম বৃষ্টির মধ্যে ফারাক করছেন। ‘তোমরা ঘরে নামায পড়ো’ বাক্য যারা উপস্থিত হয় নাই এবং যারা হইছে উভয়ের জন্যেই দিক-নির্দেশনামূলক।

আল্লামা বদরুদ্দিন আইনি রহ. তার বিখ্যাত কিতাব `উমদাতুল কারি`তে এই হাদিসের বেশ লম্বা চওড়া ব্যাখ্যা করছেন। আল্লামা আইনি লেখেন, ইবনে আব্বাসের মত এমনই যে, যেসব কারণে জুমার নামায ছেড়ে দেয়া বৈধ তার মধ্যে বৃষ্টি একটা। ইবনে শিরিন আর আব্দুর রহমান বিন সামরা`র মতামতও অনুরূপ। এটাই আহমদ এবং ইসহাকেরও মত। ইবনে কানি` থেকে বর্ণনা আছে যে, একবার ইমাম মালেককে জিগেশ করা হলো, বৃষ্টির দিনে জুমার নামাজ না পড়ার ব্যাপারে কী বলেন? উনি বললেন, আমি এমন কিছু শুনি নাই। আবার বলা হলো, `সাল্লু ফির রিহাল`র অর্থ কী? উনি বললেন, ওইটা তো সফরের সময়ের আলাপ।

বৃষ্টি ছাড়া আরো অনেক কারণে জুমার নামাজ ছাড়া যায়। ইবনুল কাসিম থেকে বর্ণিত আছে যে, ইমাম মালেক রহ. ভাইয়ের জানাযার জন্য জুমা পিছিয়ে দেয়ার অনুমতি দিছেন। ইবনে হাবিব ইমাম মালেক থেকে বর্ণনা করেন, এমনিভাবে যদি কারো কোনও মুমূর্ষু আত্মীয় থাকে, তাহলেও। ইবনে উমর রা. জুমা না পড়ে সা`দ বিন যায়েদের অসুস্থ নবজাতকরে দেখতে গেছিলেন। আতা আর আওযায়ি রহ.-এর মতামত এমনই। ইমাম শাফেয়ির মতে, বাপের জানের খতরা থাকলে জুমা তরক করা যাবে। আতা রহ.-র মতে, যদি জুমার খুতবা চলাকালে বাপ সাহায্য চায়, তাইলে জুমা তরক করে তারে সাহায্য করো। আল ওয়াজিহা কিতাবে ইমাম মালেকের এই মতামত আছে যে, রোগী এবং অতিবৃদ্ধের জন্য জুমায় রুখসত আছে।

তো, এই হাদিসের ব্যাখ্যাগুলায় কয়েকটা জিনিশ তো পষ্ট:
১. বৃষ্টি, অসুস্থতা ইত্যাদি নানা কারণে জুমার নামাজে রুখসতের সুযোগ আছে।
২. যথাযথ ইল্লত পাওয়া গেলে জুমা তরক করা যাবে।
৩. এরকম ইল্লতের সময়ে কিছু মানুষ মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়লে এবং বাকিরা ঘরে পড়লে কোনও অসুবিধা নাই। (ইবনে আব্বাসের হাদিস অনুযায়ী, কিছু লোক সেদিন মসজিদে আসছিলেন)।

তাইলে এবার ভাবা দরকার যে, করোনা ভাইরাসের কারণে যে পরিস্থিতি তৈরি হইছে, তা জুমার রুখসতের জন্য ইল্লত হিশাবে মজবুত কিনা। এরই মধ্যে বিভিন্ন মুসলিম দেশে এই ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া হইছে। আশা করি, বাংলাদেশের আলেমসমাজ মানুষকে এই ব্যাপারে যথাযথ দিক-নির্দেশনা দিয়া সাহায্য করতে পারবেন।