বাংলা বর্ষপঞ্জি নিয়ে বিতর্ক ও অন্যান্য প্রসঙ্গ

রেজা ঘটক

প্রকাশিত : এপ্রিল ১৫, ২০২২

জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের মতে, সৌর-মাস নির্ধারিত হয়, সূর্যের গতিপথের ওপর ভিত্তি করে। সূর্যের ভিন্ন অবস্থান নির্ণয় করা হয় আকাশের অন্যান্য নক্ষত্রের বিচারে। প্রাচীনকালের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সূর্যের বার্ষিক অবস্থান অনুসারে আকাশকে মোট ১২টি ভাগে ভাগ করেছিলেন। এর একটি ভাগকে তারা নাম দিয়েছিলেন রাশি। আর ১২টি রাশির সমন্বয়ে যে পূর্ণ আবর্তন চক্র সম্পন্ন হয়, তার নাম দেওয়া হয়েছে রাশিচক্র।

এই রাশিগুলোর নাম হলো: মেষ রাশি, বৃষ রাশি, মিথুন রাশি, কর্কট রাশি, সিংহ রাশি, কন্যা রাশি, তুলা রাশি, বৃশ্চিক রাশি, ধনু রাশি, মকর রাশি, কুম্ভ রাশি ও মীন রাশি। সূর্যের বার্ষিক অবস্থানের বিচারে, সূর্য কোনো না কোনো রাশির ভিতরে অবস্থান করে। এই বিচারে সূর্য পরিক্রমা অনুসারে, সূর্য যখন একটি রাশি থেকে অন্য রাশিতে যায়, তখন তাকে বলা হয় সংক্রান্তি। এই বিচারে এক বছরে মোট ১২টি সংক্রান্তি পাওয়া যায়। একেকটি সংক্রান্তিকে একেকটি মাসের শেষ দিন হিসেবে গণ্য করা হয়।

যেদিন রাত্রি ১২টার মধ্যে সূর্য্য ০ ডিগ্রি দ্রাঘিমাংশে প্রবেশ করে, তার পরদিনই ১ বৈশাখ (পহেলা বৈশাখ) হয়। যেদিন রাত্রি ১২টার মধ্যে সংক্রান্তি হয়, তার পরদিনই মাসের প্রথম দিন। মূলত একটি সংক্রান্তির পরের দিন থেকে অপর সংক্রান্ত পর্যন্ত সময়কে এক সৌর মাস বলা হয়।

লক্ষ্য করা যায় সূর্য পরিক্রমণ অনুসারে, সূর্য প্রতিটি রাশি অতিক্রম করতে একই সময় নেয় না। এক্ষেত্রে মাসভেদে সূর্যের একেকটি রাশি অতিক্রম করতে সময় লাগতে পারে, ২৯, ৩০, ৩১ বা ৩২ দিন। সেই কারণে প্রতি বছর বিভিন্ন মাসের দিনসংখ্যা সমান হয় না। এই সনাতন বর্ষপঞ্জি অনুসারে বছর ঋতুভিত্তিক থাকে না। একেকটি মাস ক্রমশ মূল ঋতু থেকে পিছিয়ে যেতে থাকে।

খ্রিস্টপূর্ব ৫৭ অব্দে বর্ষপঞ্জির সূচনা হলেও বাংলা বর্ষপঞ্জি শুরু হয়েছিল ৫৯৩ খ্রিস্টাব্দে। প্রাচীন ভারতে রাজা শশাঙ্ক ছিলেন প্রাচীন বাংলার শাসক। তিনি বাংলার বিভিন্ন ক্ষুদ্র রাজ্যকে একত্র করে গৌড় নামের জনপদ গড়ে তোলেন। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে তিনি রাজত্ব করেছেন বলে ধারণা করা হয়। ঐতিহাসিকদের মতে, তিনি ৫৯০ হতে ৬২৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রাজত্ব করেন। তার রাজধানীর নাম ছিল কর্ণসুবর্ণ বা কানসোনা।

এই রাজা শশাঙ্কের সময় থেকেই ভারতবর্ষে বাংলা বর্ষপঞ্জি গণনার শুরু হয়। অর্থ্যাৎ ঐতিহাসিকদের মতে, বাংলা বর্ষপঞ্জি এসেছে সপ্তম শতকের হিন্দু রাজা শশাঙ্কের কাছ থেকে। বৈদিক আচার অনুষ্ঠানের জন্য কোন সময়ে কি কাজ হবে, এধরনের ধারণা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বৈদিক যুগের জ্যোতিঃশাস্ত্রে পারদর্শীগণ তখন মহাকাশের বিভিন্ন জ্যোতিষ্কের চলাফেরা দেখে সময় সম্পর্কিত হিসাব নিকাশ ও এই সব আচার অনুষ্ঠানের দিন নির্ধারণ করার কাজ করতেন।

জ্যোতিঃশাস্ত্র বিষয়ক পাঠ ছিল ছয়টি প্রাচীন বেদাঙ্গ বা বেদ সংক্রান্ত ছয়টি প্রাচীন বিজ্ঞানের একটি। যেগুলো হিন্দুধর্মগ্রন্থের অংশ। বৈদিক আচার অনুষ্ঠানের জন্য প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতি একটি উন্নত ও পরিশীলিত সময় নির্ণয় কৌশল এবং বর্ষপঞ্জি প্রস্তুত করে। হিন্দু বিক্রমী বর্ষপঞ্জির নামকরণ করা হয় রাজা বিক্রমাদিত্যের নাম অনুসারে। এটা শুরু হয় খ্রিস্টপূর্ব ৫৭ অব্দ থেকে।

ভারত ও নেপালের অনেক স্থানের মতো গ্রামীণ বাঙালি সম্প্রদায়ে বাংলা বর্ষপঞ্জির কৃতজ্ঞতা দেওয়া হয় রাজা বিক্রমাদিত্যকে। ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলে খ্রিস্টপূর্ব ৫৭ অব্দে সেই বর্ষপঞ্জির সূচনা হলেও বাংলা বর্ষপঞ্জি শুরু হয়েছিল ৫৯৩ খ্রিস্টব্দে। ঐতিহাসিকগণ এটাকে  বঙ্গাব্দের আদর্শ বিন্দু বা রেফারেন্স পয়েন্ট হিসাবে গণ্য করেন।

প্রাচীনকালে হিন্দু পণ্ডিতগণ সূর্য, চন্দ্র এবং অন্যান্য গ্রহসমূহের ক্রমাবর্তনকে পর্যবেক্ষণ এবং হিসাব করে সময়ের হিসাব রাখার চেষ্টা করতেন। সূর্য সম্পর্কিত এই হিসাব নিকাশ সংস্কৃত ভাষার বিভিন্ন জ্যোতিঃশাস্ত্র বিষয়ক গ্রন্থে সুস্পষ্টভাবেই রয়েছে। যেমন ৫ম শতকে আর্যভট্ট কর্তৃক রচিত আর্যভট্টীয়, ৬ষ্ঠ শতকে লটদেব কর্তৃক রচিত রোমক এবং বরাহমিহির কর্তৃক রচিত পঞ্চসিদ্ধান্তিকা, ৭ম শতকে ব্রহ্মগুপ্ত কর্তৃক রচিত খাণ্ডখাণ্ড্যক ইত্যাদি।

এই গ্রন্থগুলোতে সূর্যসহ ও বিভিন্ন গ্রহ সম্পর্কে লেখা হয় এবং এদের স্থানান্তর সম্পর্কিত হিসাব-নিকাশ এবং বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হয়। অন্যান্য গ্রন্থ যেমন `সূর্য সিদ্ধান্ত` ৫ম থেকে ১০ শতকে রচিত হয় এবং এর অধ্যায়গুলোতে বিভিন্ন গ্রহ এবং দেব দেবী সংক্রান্ত পুরাণ দেখা যায়।

ভারতীয় রাজ্যগুলো যেমন পশ্চিমবঙ্গ্‌, ত্রিপুরা এবং আসামের বাঙালিদের ব্যবহৃত বাংলা বর্ষপঞ্জি এই ‘সূর্য সিদ্ধান্ত’ নামক সংস্কৃত গ্রন্থের উপর ভিত্তি করে বানানো। এখানে মাসগুলোর ঐতিহাসিক সংস্কৃত নামও রক্ষা করা হয়েছে। সেখানে বাংলা বর্ষপঞ্জিতে প্রথম মাসের নামও বৈশাখ। তাই বাংলা বর্ষপঞ্জি হিন্দু বর্ষপঞ্জি ব্যবস্থার সাথে প্রাচীনকাল থেকেই অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবেই জড়িত। আর বিভিন্ন বাঙালি হিন্দু উৎসব এই বাংলা বর্ষপঞ্জি দেখে ঠিক করা হয়।

৫৫০ খ্রিস্টাব্দের দিকে বরাহমিহির ‘পঞ্চসিদ্ধান্তিকা’ নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। গ্রন্থটি পাঁচটি খণ্ডে সমাপ্ত। এই গ্রন্থটিকে জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং জ্যোতিষশাস্ত্রের সংক্ষিপ্তসার বলে অভিহিত করা হয়। `পঞ্চসিদ্ধান্তিকা`র পাঁচটি খণ্ডের এই সিদ্ধান্তগুলো হলো– সূর্যসিদ্ধান্ত, বশিষ্ঠসিদ্ধান্ত, পৌলিশ সিদ্ধান্ত, রোমক সিদ্ধান্ত ও ব্রহ্ম সিদ্ধান্ত।

প্রাচীন দিন, মাস, বৎসর গণনার ক্ষেত্রে `সূর্যসিদ্ধান্ত` একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। বরাহমিহিরের পরে ব্রহ্মগুপ্ত নামক অপর একজন জ্যোতির্বিজ্ঞানী (জন্ম ৫৯৮) একটি সিদ্ধান্ত রচনা করেছিলেন। এই গ্রন্থটির নাম `ব্রহ্মস্ফুট সিদ্ধান্ত`। এই গ্রন্থটি খলিফা আল-মনসুরের আদেশে `সিন্দহিন্দ` নামে আরবি ভাষায় অনূদিত হয়েছিল।

বঙ্গাব্দের সূচনা সম্পর্কে বর্তমানে দুটি মতবাদ চালু আছে। প্রথম মতামত অনুযায়ী, প্রাচীন বঙ্গদেশের (গৌড়) রাজা শশাঙ্ক (রাজত্বকাল আনুমানিক ৫৯০-৬২৫ খ্রিস্টাব্দ) বঙ্গাব্দ চালু করেছিলেন। সপ্তম শতাব্দীর প্রারম্ভে রাজা শশাঙ্ক বঙ্গদেশের রাজচক্রবর্তী রাজা ছিলেন। আধুনিক বঙ্গ, বিহার এলাকা তাঁর সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ঐতিহাসিকদের অনুমান, জুলীয় বর্ষপঞ্জির বৃহস্পতিবার ১৮ মার্চ ৫৯৪ এবং গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির শনিবার ২০ মার্চ ৫৯৪, বঙ্গাব্দের সূচনা হয়েছিল।

দ্বিতীয় মতামত অনুসারে, ইসলামি শাসনামলে হিজরী পঞ্জিকা অনুসারেই সকল কাজকর্ম পরিচালিত হতো। মূল হিজরী পঞ্জিকা চান্দ্র মাসের উপর নির্ভরশীল। সাধারণত চান্দ্র বৎসর সৌর বৎসরের চেয়ে ১১/১২ দিন কম হয়। কারণ সৌর বৎসর ৩৬৫ দিন, আর চান্দ্র বৎসর ৩৫৪ দিন। যে কারণে চান্দ্র বৎসরে ঋতুগুলি ঠিক থাকে না। আর বঙ্গদেশে চাষাবাদ ও এ জাতীয় অনেক কাজ ঋতুনির্ভর। এজন্য মোগল সম্রাট আকবরের সময়ে প্রচলিত হিজরী চান্দ্র পঞ্জিকাকে সৌর পঞ্জিকায় রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

সম্রাট আকবর ইরান থেকে আগত বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী আমির ফতুল্লাহ শিরাজীকে হিজরী চান্দ্র বর্ষপঞ্জিকে সৌর বর্ষপঞ্জিতে রূপান্তরিত করার দায়িত্ব প্রদান করেন। ফতুল্লাহ শিরাজীর সুপারিশ অনুযায়ী, পারস্যে প্রচলিত ফার্সি বর্ষপঞ্জির অনুকরণে ৯৯২ হিজরী মোতাবেক, ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবর হিজরী সৌর বর্ষপঞ্জির প্রচলন করেন।

কিন্তু তিনি ঊনত্রিশ বছর পূর্বে তাঁর সিংহাসন আরোহনের বছর থেকে এই পঞ্জিকা প্রচলনের নির্দেশ দেন। এজন্য সম্রাট আকবর প্রবর্তিত বাংলা বর্ষপঞ্জিতে ৯৬৩ হিজরী সাল থেকে বঙ্গাব্দ গণনা শুরু হয়। আর ৯৬৩ হিজরী সালের মুহররম মাস ছিল বাংলা বৈশাখ মাস। এজন্য বৈশাখ মাসকেই বঙ্গাব্দ বা বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস এবং পহেলা বৈশাখকে নববর্ষ ধরা হয়।

সম্রাট আকবর প্রবর্তিত ভারতবর্ষের এই বর্ষপঞ্জিকে বলা হতো `তারিখ-ই-ইলাহি`। বাংলা বর্ষপঞ্জির `তারিখ-ই-ইলাহি`-তে প্রতিটি দিন এবং মাসের আলাদা আলাদা নাম ছিল। এখন আমরা যে বাংলা মাসের নামগুলো দেখি, `তারিখ-ই-ইলাহি`তে মাসের নামগুলো ভিন্ন ছিল। সম্রাট আকবরের পৌত্র সম্রাট শাহজাহান রবিবার দিয়ে শুরু হওয়া সাত দিনের সপ্তাহের প্রচলনের কারণে সম্রাট আকবর প্রবর্তিত `তারিখ-ই-ইলাহি` বর্ষপঞ্জিতে নতুন সংস্কার শুরু হয়।

তখন থেকেই `শকাব্দে` (ভারতীয় জাতীয় বর্ষপঞ্জি) থাকা মাসের নামের সাথে মিল রেখে `তারিখ-ই-ইলাহি`র মাসের নামকরণ করা হয়। এখন আমরা বাংলাদেশে বাংলায় যে বর্ষপঞ্জিটি ব্যবহার করি, সেই বর্ষপঞ্জিটির ভিত্তি হলো সম্রাট আকবর প্রবর্তিত `তারিখ-ই-ইলাহি`র সম্রাট শাহজাহান কর্তৃক সংস্করণ হওয়া ভার্সান।

বাংলার কৃষকদের বসন্তের ফসল সংগ্রহের পর খাজনা আদায় করার কাজ সহজ করতেই সম্রাট আকবর এই বাংলা বর্ষপঞ্জি চালু করেছিলেন। বৈশাখ হলো বঙ্গাব্দ বা বাংলা সনের প্রথম মাস এবং শকাব্দ বা ভারতীয় রাষ্ট্রীয় শকাব্দের দ্বিতীয় মাস। এটি নেপালি পঞ্জিকা বিক্রম সম্বৎ ও পাঞ্জাবি নানকশাহি পঞ্জিকার প্রথম মাস। গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির এপ্রিল মাসের শেষার্ধ ও মে মাসের প্রথমার্ধ নিয়ে বৈশাখ মাস। বৈদিক পঞ্জিকায় এই মাসকে মাধব মাস এবং বৈষ্ণব পঞ্জিকায় একে মধুসূদন মাস বলে।

বঙ্গাব্দের ১২ মাসের নামকরণ করা হয়েছে নক্ষত্রমণ্ডলে চন্দ্রের আবর্তনে বিশেষ তারার (সূর্যের) অবস্থানের উপর ভিত্তি করে। জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক প্রাচীন গ্রন্থ `সূর্যসিদ্ধান্ত` থেকেই বঙ্গাব্দের ১২ মাসের নামকরণ করা হয়েছে। প্রাচীন সংস্কৃত ভাষায় এগুলো সুস্পষ্টভাবেই উল্লেখ রয়েছে। বিশাখা থেকে এসেছে বৈশাখ। এটি বাংলা সনের প্রথম মাস এবং শকাব্দ বা ভারতীয় রাষ্ট্রীয় শকাব্দের দ্বিতীয় মাস। জ্যেষ্ঠা থেকে এসেছে জৈষ্ঠ্য বা জ্যৈষ্ঠ। জৈষ্ঠ্য বা জ্যৈষ্ঠ বাংলা সনের দ্বিতীয় মাস এবং ভারতীয় রাষ্ট্রীয় শকাব্দের তৃতীয় মাস। উত্তরাষাঢ়া থেকে এসেছে আষাঢ়। আষাঢ় বাংলা সনের তৃতীয় মাস এবং ভারতীয় রাষ্ট্রীয় শকাব্দের চতুর্থ মাস।

শ্রবণা থেকে এসেছে শ্রাবণ। শ্রাবণ বাংলা সনের চতুর্থ মাস এবং ভারতীয় রাষ্ট্রীয় শকাব্দের পঞ্চম মাস। পূর্বভাদ্রপদ থেকে এসেছে ভাদ্র। ভাদ্র বাংলা সনের পঞ্চম মাস এবং ভারতীয় রাষ্ট্রীয় শকাব্দের ষষ্ঠ মাস। অশ্বিনী থেকে এসেছে আশ্বিন। আশ্বিন বাংলা সনের ষষ্ঠ মাস এবং ভারতীয় রাষ্ট্রীয় শকাব্দের সপ্তম মাস।

কৃত্তিকা থেকে এসেছে কার্তিক। কার্তিক বাংলা সনের সপ্তম মাস এবং ভারতীয় রাষ্ট্রীয় শকাব্দের অষ্টম মাস। মৃগশিরা থেকে এসেছে অগ্রহায়ণ। অগ্রহায়ণ বাংলা সনের অষ্টম মাস এবং ভারতীয় রাষ্ট্রীয় শকাব্দের নবম মাস। পুষ্যা থেকে এসেছে পৌষ। পৌষ বাংলা সনের নবম মাস এবং ভারতীয় রাষ্ট্রীয় শকাব্দের দশম মাস।

মঘা থেকে এসেছে মাঘ। মাঘ বাংলা সনের দশম মাস এবং ভারতীয় রাষ্ট্রীয় শকাব্দের একাদশতম মাস। উত্তরফাল্গুনী থেকে এসেছে ফাল্গুন। ফাল্গুন বা ফাগুন বাংলা সনের একাদশ মাস এবং ভারতীয় রাষ্ট্রীয় শকাব্দের দ্বাদশ এবং সমাপনী মাস। চৈত্র বা চৈৎ বাংলা সনের দ্বাদশ ও সমাপনী মাস এবং ভারতীয় রাষ্ট্রীয় শকাব্দের প্রথম মাস।

মূলত ভারতবর্ষে প্রচলিত বাংলা বর্ষপঞ্জি প্রাচীনকাল থেকে শাসকদের ইচ্ছানুসারে পরিবর্তিত হতে হতে আজকের বর্তমান পর্যায়ে এসেছে। ভারতে মুসলিম শাসকদের শাসনকাল শুরুর পর সম্রাট আকবর প্রথম ভারতীয় রাষ্ট্রীয় শকাব্দ পরিবর্তন করেন। যা `তারিখ-ই-ইলাহী` নামে পরিচিত। যেখানে বাংলা মাসগুলোর নাম হিজরী নামের সাথে মিলিয়ে ছিল। কিন্তু সম্রাট শাহজাহান সেটি সংস্কার করে প্রাচীন ভারতীয় শকাব্দের সংস্কৃত ভাষার নামগুলো গ্রহণ করেন।

সুতরাং বাংলা বর্ষপঞ্জিতে আমরা এখন যে নামগুলো ব্যবহার করি, সেগুলো সংস্কৃত থেকে আসা নাম। আর আকাশে নক্ষত্রের অবস্থান থেকেই এই নামগুলো এসেছে। যা মোটেও হিজরী হিসাব থেকে নয়। বরং প্রাচীন ভারতীয় শকাব্দ থেকেই এসেছে। যার আদি নামগুলো সংস্কৃত ভাষায়। যে কারণে বাংলা বর্ষপঞ্জি নিয়ে হিন্দু মুসলিম বিতর্কের যে শুরু, তার শুরুটা সম্রাট আকবর করেছিলেন। কিন্তু আদি সবকিছু সনাতন রীতি অনুসারেই এসেছে।

বাংলাদেশের কৃষকরা (হিন্দু-মুসলিম সবাই) এই ভারতীয় শকাব্দ রীতিই অনুসরণ করতেন। ভারতীয় শাসনব্যবস্থা থেকে মুগল সাম্রাজ্যের পতনের পর ইংরেজদের আগমন ও নির্গমন পর্যন্ত এটাই চালু ছিল। ভারতভাগের পর পাকিস্তান আমলে আবার নতুন করে বাংলা বর্ষপঞ্জিতে সম্রাট আকবর প্রবর্তিত ইসলামি নিয়ম-কানুন অনুসরণ করা শুরু হয়। তখন থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিমদের মধ্যে বাংলা বর্ষপঞ্জির দিন-তারিখ ব্যবহারে হিন্দুদের থেকে আলাদা করার একটা রেওয়াজ শুরু হয়।

১৯৬৬ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি কর্তৃক বাংলা সন সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে একটি কমিটি বিভিন্ন বাংলা মাস ও ঋতুতে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থ-সাংস্কৃতিক জীবনের কিছু সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতাকে নির্ণয় করেন। এবং সেগুলো থেকে উত্তরণের জন্য একটি প্রস্তাবনা প্রদান করেন। বাংলা সনের ব্যাপ্তি গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির মতোই ৩৬৫ দিনের। যদিও সেখানে পৃথিবীর সূর্যকে প্রদক্ষিণের পরিপূর্ণ সময়কেই যথাযথভাবে নেওয়া হয়েছে।

এই প্রদক্ষিণের মোট সময় ৩৬৫ দিন ৫ ঘণ্টা ৪৮ মিনিট এবং ৪৭ সেকেন্ড। এই ব্যবধান ঘোচাতে গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির প্রতি চার বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে একটি অতিরিক্ত দিন যোগ করা হয়। ব্যতিক্রম হচ্ছে, সে শতাব্দীতে, যে শতাব্দীকে ৪০০ দিয়ে ভাগ করা যায় না বা বিভাজ্য নয়। কিন্তু ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে যে কমিটি এটি সংস্কার করেন, সেখানেও এই লিপিয়ার বছরের সমস্যার সমাধান ছিল না। যে কারণে জ্যোতির্বিজ্ঞান নির্ভর হলেও বাংলা সনে এই অতিরিক্ত দিনকে তখন আত্মীকরণ করা হয়নি। বাংলা মাস অন্যান্য সনের মাসের মতোই বিভিন্ন পরিসরের হয়ে থাকে। এই সমস্যাগুলোকে দূর করার জন্য ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কমিটি বাংলা একাডেমির কাছে কয়েকটি প্রস্তাব পেশ করে। সেগুলো হলো:

১. বছরের প্রথম পাঁচ মাস অর্থাৎ বৈশাখ থেকে ভাদ্র হবে ৩১ দিনের।
২. বাকি মাসগুলো অর্থাৎ আশ্বিন থেকে চৈত্র হবে ৩০ দিনের মাস।
৩. প্রতি চতুর্থ বছরের ফাল্গুন মাসে অতিরিক্ত একটি দিন যোগ করে তা হবে ৩১ দিনের।

বাংলাদেশে বাংলা একাডেমি সরকারীভাবে এই সংশোধিত বাংলা মাসের হিসাব গ্রহণ করে। যদিও ভারতের পশ্চিম বাংলা, আসাম ও ত্রিপুরার বাঙালিরা পুরনো বাংলা সনের হিসাব এখন পর্যন্ত অনুসরণ করেন। বাংলাদেশে সংস্কারকৃত বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে ফাল্গুন (যা গ্রেগরীয় ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি শুরু হয়) মাস প্রতি চতুর্থ বর্ষে ৩১ দিনের হয়। মিল রাখবার উদ্দেশ্যে গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির সাথে সাথেই বাংলা অধিবর্ষ হয়।
উদাহরণস্বরূপ, ফাল্গুন ১৪২২ ছিল বাংলা অধিবর্ষের মাস যা পড়েছে গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জীর অধিবর্ষ ২০১৬-র ফেব্রুয়ারি মাসে।

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় প্রাচীন `সূর্যসিদ্ধান্ত` ভিত্তিক নিরয়ণ বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করা হয়। এই বর্ষপঞ্জির মাসগুলো নির্ধারিত হয় সূর্যের প্রকৃত আবর্তনকে ভিত্তি করে। এই বর্ষপঞ্জিতে বর্ষ সংখ্যা হতে সাত বিয়োজন করে তাকে ৩৯ দিয়ে ভাগ করতে হয়। যদি ভাগশেষ শূন্য হয় বা ৪ দিয়ে বিভাজ্য হয়, তাহলে সে বর্ষটিকে অধিবর্ষ হিসেবে গ্রহণ করা হয় এবং ৩৬৬ দিনের এই বর্ষের চৈত্র মাস ৩১ দিনের হয়। এভাবে প্রতি ৩৯ বছরে ১০টি অধিবর্ষ হয়।

পহেলা বৈশাখ, বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম দিন। বাংলাদেশে বাংলা একাডেমি কর্তৃক সংশোধিত বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে, প্রতি বছরের এপ্রিল মাসের ১৪ তারিখে এই দিন উদযাপন করা হয়। যদিও পশ্চিমবঙ্গে তা উদযাপন করা হয় সনাতন বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে। এটি পাশ্চ্যাতের বর্ষপঞ্জির মতো নির্দিষ্ট নয়। ভারতের বাঙালিরা নতুন বছর উদযাপন করেন এপ্রিল মাসের ১৪ বা ১৫ তারিখে।

ভারতের সকল বঙ্গভাষী অধ্যুষিত অঞ্চলে সনাতন নিরয়ণ (জ্যোর্তিমণ্ডলে তারার অবস্থানের প্রেক্ষিতে গণিত, সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে পৃথিবীর প্রকৃত সময়ই নিরয়ণ বর্ষপঞ্জি। অর্থাৎ নিরয়ণ বর্ষপঞ্জির দৈর্ঘ্য হলো ৩৬৫.২৫৬৩৬০২ সৌর দিবস। যা ক্রান্তীয় সায়ন বর্ষপঞ্জি থেকে ২০ মিনিট ২৪ সেকেন্ড দীর্ঘ।) বর্ষপঞ্জি ব্যবহৃত হয়ে থাকে।

এই বর্ষপঞ্জি ক্রান্তীয় বা সায়ন বর্ষপঞ্জি (যেমন সংস্কারকৃত বাংলা সন এবং গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি) থেকে ভিন্ন। এই উভয় ধরণের বর্ষপঞ্জির মধ্যে সময়ের যে গাণিতিক পার্থক্য রয়েছে, তার কারণেই বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরায় নতুন বর্ষ শুরুতে দিনের পার্থক্য হয়। এই সময়ের পার্থক্যের কারণে, নিরয়ণ সৌর বর্ষপঞ্জিতে মাসের দৈর্ঘ্যেও পার্থক্য রয়েছে।

সংশোধিত বাংলা পঞ্জিকা বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৮৭ সালে গৃহীত হয়। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরাসহ সারা বিশ্বে এখনো পুরাতন সনাতন পদ্ধতি ব্যাবহৃত হয়। বাংলাদেশের সংশোধিত বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী, ১৪ এপ্রিল ২০২২ তারিখ হলো ১ বৈশাখ, ১৪২৯ বঙ্গাব্দ। আর ভারতে ১৫ এপ্রিল ২০২২ হলো পহেলা বৈশাখ ১৪২৯ বঙ্গাব্দ।

বাংলা সন অন্যান্য সনের মতোই ৭ দিনকে গ্রহণ করেছে এবং এ দিনের নামগুলো অন্যান্য সনের মতোই তারামণ্ডলের ওপর ভিত্তি করেই করা হয়েছে। ঐতিহ্যগতভাবে সূর্যোদয় থেকে বাংলা দিন গণনার রীতি থাকলেও ১৪০২ সালের ১ বৈশাখ থেকে বাংলা একাডেমি এই নিয়ম বাতিল করে আন্তর্জাতিক রীতির সাথে সামঞ্জস্য রাখতে রাত ১২.০০টায় দিন গণনা শুরুর নিয়ম চালু করে।

দিনের নামকরণগুলো এসেছে সূর্য থেকে রবিবার, চাঁদ থেকে সোমবার, মঙ্গল থেকে মঙ্গলবার, বুধ থেকে বুধবার, বৃহস্পতি থেকে বৃহস্পতিবার, শুক্র থেকে শুক্রবার এবং শনি থেকে শনিবার। দিনের ও মাসের এই নামকরণ থেকেও সুস্পষ্ট যে, এই নামগুলোতে কোনো ইসলামিকরণ ছিল না। বরং প্রাচীনকালের জ্যোতিঃশাস্ত্র বিষয়ক পাঠ থেকেই এই নামগুলোর আগমন।

সুতরাং বাংলা নববর্ষ ও এর হিন্দু মুসলিম বিতর্ক একটি ফালতু বিতর্ক। ভারতবর্ষে এর সবগুলোই সনাতন রীতি অনুসারেই এসেছে। ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের গোরাপত্তনের পর এগুলোকে ইসলামিকরণ করার চেষ্টা করা হলেও সেগুলোতে ভুল ছিল। মূল কারণ সৌর বছর আর চান্দ্র বছর। সৌর বছরের সময় ৩৬৫ দিন আর চান্দ্র বছরের সময় ৩৫৪ দিন। ১১ দিন কম। মুসলিম পণ্ডিতগণ এই ১১ দিনের হিসাব মিলাতে না পেরেই প্রাচীন ভারতীয় সনাতন রীতিই অনুসরণ করেন।

বর্তমানে বাংলাদেশে বাংলা ক্যালেন্ডারে আরেকটি সংশোধন আনা হয় ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে। বাংলাদেশে নতুন বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী, এখন থেকে বাংলা বছরের প্রথম ছয় মাস ৩১ দিনে হবে। এর আগে বৈশাখ, জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়, শ্রাবণ, ভাদ্র বছরের প্রথম এই পাঁচ মাস ৩১ দিন গণনা করা হতো। এখন ফাল্গুন মাস ছাড়া অন্য পাঁচ মাস ৩০ দিনে পালন করা হবে। ফাল্গুন মাস হবে ২৯ দিনের, কেবল লিপইয়ারের বছর ফাল্গুন ৩০ দিনের মাস হবে।

২১ ফেব্রুয়ারি, ১৬ ডিসেম্বর, ৭ মার্চ, ২৬ মার্চের মত গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দিবস সমূহ বাংলা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী যে দিনে অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সেই দিনে পালন করা হবে। বাংলা বর্ষপঞ্জি পরিবর্তনের এই কাজটি করেছে বাংলা একাডেমির গবেষণা, সংকলন এবং অভিধান ও বিশ্বকোষ বিভাগ।

সুতরাং পহেলা বৈশাখকে বাংলা নববর্ষ হিসাবে পালনের যে ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য, বা পরবর্তীকালে বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ পালনের যে সংস্কৃতি, এর সঙ্গে ইসলামীকরণের কোনো যোগসূত্র নাই। বরং ইসলামীকরণ করেও এর কোনো সমাধান ইসলামি পণ্ডিতগণ আবিষ্কার করতে ব্যর্থ হয়েছেন। যে কারণে এটি নিয়ে বিতর্ক করা একটা সময় নষ্ট করার মতো ব্যাপার।

কারণ প্রাচীন হিসাবে রাজা শশাঙ্কের শাসনকালে (৫৯৪ সাল) বাংলা বর্ষপঞ্জির আগমন। আর মুসলিমদের হিসাবে বাংলা বর্ষপঞ্জির আগমন সম্রাট আকবরের শাসনকাল থেকে। অর্থ্যাৎ ১৫৮৪ সালে। রাজা শশাঙ্ক আর সম্রাট আকবরের শাসনকালের পার্থক্য প্রায় ১৪৯০ বছরের। ১৪৯০ বছর পরে প্রবর্তিত কোনো বিষয় স্বাভাবিকভাবেই আদি হতে পারে না। এটা হিন্দু-মুসলিম নয়, যে কোনো সাধারণ মানুষই বুঝবে।

বাংলাদেশে সরকারিভাবে ১৪ এপ্রিলকে বাংলা নববর্ষ চালু করার পর থেকে তাই এই বর্ষপালন নিয়ে ভারতের সাথে কিছুটা পার্থক্য হওয়ার কারণে, সেই চিরায়ত হিন্দু-মুসলিম বিতর্কটি আবার সামনে এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে ১৪ এপ্রিল পহেলা বৈশাখ পালন করা হলেও গ্রাম-বাংলার কৃষকরা এখনো ভারতীয় রাষ্ট্রীয় শকাব্দ অনুসরণ করেন। কারণ আমাদের কৃষকরা (হিন্দু-মুসলিম সবাই) ফসলের সাথে বাংলা বর্ষপঞ্জি`র এই শতাব্দী প্রাচীন সনাতন রীতিই অনুসরন করেন। আমাদের কৃষকদের সেই অনুসরণ করাকে কেউ ধর্ম দিয়ে আলাদা করতে পারেনি। যে কারণে এটা বাংলাদেশের শহুরে বিতর্ক হলেও গ্রামে এখনো ভারতীয় রাষ্ট্রীয় শকাব্দি অনুসারেই বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসরন করার রীতি চালু আছে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা