
বাংলাদেশের অগ্রগতি কোথায় আটকে আছে?
রাহমান চৌধুরীপ্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৫
ক’দিন ধরে দেখছি, নেপাল ও বাংংদেশের অভ্যুত্থান মিলিয়ে মানুষ খুব হতাশ। ঠিক একই রকম হতাশা দেখা গেছে শ্রীলঙ্কার অভ্যুত্থানের সঙ্গে বাংলাদেশের অভ্যুত্থানের তুলনা করে। বাংলাদেশের নানান সঙ্কটের বহু কারণ রয়েছে। কিন্তু নেতৃত্বের সঙ্কটটা কী?
সঙ্কটটা লেখাপড়া না করার মধ্যে। হ্যাঁ, এটাই সত্যি। বাংলাদেশই সম্ভবত বিশ্বের একমাত্র দেশ যেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলি থেকে বহু শিক্ষার্থী সাহিত্যের একটা বই পাঠ না করেও সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সনদপত্র লাভ করতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বছরের পর বছর একটা বইও পড়তে হয় না। তিনি পদোন্নতি পান, অধ্যাপক হন।
বই বিক্রির সংখ্যার খবর সবাই রাখে এদেশে। নাট্যচর্চার সঙ্গে সম্পর্কিতরা নাটকের বই পাঠ করে না, রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইছে বহু বছর ধরে, খুব বিখ্যাত হয়েছেন। কিন্তু বই পড়ে জানার চেষ্টা করেননি রবীন্দ্রনাথের গানগুলো রচনার ইতিহাস কী। নাট্যকলার শিক্ষকরা জানেন না নাটক নিয়ে নতুন কী লেখা হচ্ছে। শিক্ষকতা করার জন্য জানতে হয় না এসব।
সারা বিশ্বের নাটক পাঠ দূরের কথা, নিজের দেশে নিজের ভাষায় রচিত নাটক কয়টা পাঠ করেছেন? নাটকের ইতিহাস পাঠ দূরের কথা, দু’চারটা ভালো প্রবন্ধ পড়েননি, কিন্তু দাম্ভিক নাট্যকলার অধ্যাপক।
সাহিত্য ও নাটক নিয়ে যা বললাম, সর্বক্ষেত্রেই তাই। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়, সর্বত্র পড়াশোনা বা অধ্যয়ন বা যোগ্যতার অভাব পরিলক্ষিত হবেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু বিভাগের অধ্যাপককে গুরুত্বপূর্ণ দশটা বইয়ের নাম জিজ্ঞাসা করলে বলতে পারবেন না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের তার সমকাল পর্যন্ত লেখা তার বিষয়ের সব বই, সব গবেষণা প্রবন্ধের খোঁজখবর রাখার কথা। কিন্তু এই দায় তাঁদের নেই।
নাট্যকলার বিশেষ শিক্ষার্থীকে দেখা গেছে, হঠাৎ নাটক সম্পর্কিত একট বই হাতে পেয়ে পাঠ করে খুব মুগ্ধ হয়েছে। কিন্তু তার মনে প্রশ্ন জেগেছে, শিক্ষক এই বইটির কথা তাকে বললেন না কেন? বহু উদাহরণ দেওয়া যাবে এমন।
বহু শিক্ষার্থীর সঙ্গে এরকম ঘটনার পর আমার সঙ্গে কথা হয়েছে। বহু শিক্ষার্থী জানতে চায় শিক্ষকরা সেইসব বইয়ের নাম বলেন না কেন। বলেন না তার সহজ কারণ, নিজেরা পড়েননি, নিজেরা নাম জানেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের শিক্ষকদের জন্য একজন সজ্জন ডীন বছরে পাঁচ হাজার টাকা বই কেনার জন্য বরাদ্দ করেছিলেন।
সেই ডীন পরে একদিন দুঃখ করে আমাকে বলেন, শিক্ষকরা টাকাটা নেন কিন্তু বই কেনার প্রমাণপত্র দিতে চান না। পরে দুজন প্রকাশক আমাকে বলেন, বহু শিক্ষক জাল কাগজ চায় আমাদের কাছে বই ক্রয় করার। কিন্তু বই ক্রয় করেন না। পাঁচ হাজার টাকা তুলে এক শিক্ষক দুটা ইলিশ মাছ কিনেছেন, এমন কথাও শোনা গেছে। শিক্ষকদের লেখাপড়া না করার কথা নাম ধরে ধরে বলে শিক্ষকদের চরিত্র উন্মোচন করা যাবে। কিন্তু তা এখনে লক্ষ্য নয়। দু’চারজন ব্যতিক্রম শিক্ষক অবশ্যই রয়েছেন, তাঁদের নিয়ে আলোচনা করছি না। কারণ ব্যতিক্রম সামগ্রিক ঘটনার উদাহরণ নয়।
সাতশো-আটশো বছর ভয়াবহ অন্ধকারে থাকার পর ইউরোপের মানুষ হঠাৎ জেগে উঠলো কী করে? সেইটা বুঝতে হবে। মধ্যযুগে মুসলমান শাসকদের একটি গ্রন্থাগারে চার লক্ষ বই সংগ্রহের খবর রয়েছে। সেই তখন ইউরোপে ত্রয়োদশ শতকে সবমিলিয়ে গ্রন্থ সংখ্যা কত হবে? প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারে দুই হাজারের সামান্য কিছু বেশি ছিল। ক্যান্টাবেরির ক্যাথেড্রাল গ্রন্থাগারে ছিল পাঁচ হাজার বই যা তখনকার সময়ের একটি ব্যতিক্রম। ঠিক তখন, রেনেসাঁর পথিকৃত পেত্রার্ক চতুর্দশ শতকে মাত্র আড়াইশো ধ্রুপদী গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি জোগার করতে পেরেই খুশি ছিলেন।
যখন ইউরোপ নতুন পথে যাত্রা শুরু করে একাদশ শতকে তখন তার সাক্ষরতার হার এক শতাংশের সামান্য বেশি। ত্রয়োদশ শতকে তা বেড়ে দাঁড়ায় ছয় শতাংশের কাছাকাছি। ইউরোপ তখনো চার্চের নিয়ন্ত্রণে। কিন্তু তারপর দ্রুত আগাতে থাকে তাদের জ্ঞানচর্চা। সেটা সনদপত্রের জন্য কেবল নয়, চারদিক সম্পর্কে বুঝে উঠবার জন্য। চার্চের নানা নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়বার জন্য। সেইসঙ্গে বাক-স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। মূলত এরা ছিলেন শহুরে লোক। প্রথমত সাহিত্য এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের লেখা তাদের উৎসাহের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সেই সঙ্গে নাটক দেখা বা অপেরায় যাওয়া।
ঠিক তার পর খুব দ্রুত যা ঘটে তা অভাবনীয়। ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাটা বলা যাক। ত্রয়োদশ শতকে তিনটি, চতুর্দশ শতকে বিশটি, পঞ্চদশ শতকে চল্লিশটি, ষষ্ঠদশ শতকে ছিষট্টিটি। পাঁচশো ছয়শো বভর আগের কথা এসব। ছাপাখানা আবিষ্কৃত হলো পনেরো শতকের শেষার্ধে, কিন্তু তারপরেই গ্রন্থ মুদ্রণ ব্যাপক হারে বেড়ে চলে। চৌদ্দশো আশি সালেই পশ্চিম ইউরোপের বিভিন্ন শহরে একশো দশটি ছাপাখানা বসে যায়। ইতিহাস গ্রন্থে দেখা যায় তখন ষাট লক্ষাধিক বইয়ের চল্লিশ হাজার সংস্করণ বের হয়েছিল। সমগ্র ইউরোপের লোক সংখ্যা তখন আট থেকে নয় কোটি।
মার্টিনের সূত্র ধরে আহমেত কুরু তার গবেষণা গ্রন্থে দেখাচ্ছেন, পনেরোশো সাল নাগাদ ছাপাখানাগুলো দশ হাজার থেকে পনেরো হাজার রকম বইয়ের দেড় থেকে দুই কোটি বই ছাপায়। পাঠকদের চাহিদার কারণে তা দ্রুত বাড়তে থাকে। পরের শতকে বই ছাপা হয় প্রায় একুশ কোটি, সতেরো শতকে পঞ্চাশ কোটি এবং আঠারো শতকে প্রায় একশো কোটি বই মুদ্রিত হয়। সেই যুগে এরকম ঘটনা চিন্তা করা কি সম্ভব?
কারণ ষোল শতকে ইউরোপের লোক সংখ্যা মাত্র দশ কোটি, সতেরো শতকে পনেরো কোটি, আঠারো শতকে বিশ কোটির কম। ঠিক তারপর লাফ দিয়ে পরের শতকে তা হয়ে দাঁড়ায় চল্লিশ কোটি। সেই যুগে নয় কোটির কম লোক সংখ্যার জন্য বই ছাপা হয় দেড় কোটি, পরের বছর দশ কোটি লোকের দেশে বই ছাপা হয় একুশ কোটি । যখন লোক সংখ্যা মাত্র আঠারো কোটি তখন বই ছাপা হয় প্রায় একশো কোটি। ইউরোপে পাঠকের সংখ্যা কত বিপুল হারে বাড়ছে, তা কি বোঝা যাচ্ছে?
বাংলাদেশে আঠারো কোটি মানুষের জন্য কত বই ছাপা হয় এই যুগে এবং কত বই বিক্রি হয় এই শতকে এসে? বই না পড়া একটা জাতি, জানার চেয়ে বলার আকাঙ্ক্ষা বেশি যাদের, পড়াশোনা করার চেয়ে বক্তৃতাবাজিতে পারদর্শী, মঞ্চে ওঠার জন্য মুখিয়ে থাকে, সর্বক্ষণ অন্যকে জ্ঞান দান করতে চায়; এই জাতি কী করে সঠিক পথ দেখাবে? বাংলাদেশে সরচেয়ে বিস্মিত হই যখন মার্কসবাদীদের সঙ্গে কথা বলি, মার্কসের চিন্তার সব বিপরীত কথা শোনা যায় তাদের মুখে। মার্কসের একটি বইও পড়েননি, না পড়েছেন মনোযোগ দিয়ে কমিউনিস্ট পর্টির ইশতেহার। কিন্তু মার্কসবাদী দলের প্রথম সারির নেতা তিনি। প্রতিদিন বক্তৃতা দিয়ে বেড়াচ্ছেন।
ঠিক একইরকম হতাশ হতে হবে যখন শিল্পকলা-সাহিত্যের অঙ্গনের দিকে কেউ মনোযোগ দিয়ে তাকাবে। মানুষ বড় বড় কথা বলেন, দর্শন আওড়ান কিছু না জেনে কিছু না বুঝে। দু-চার-ছয়খানা বই পড়ে সাহিত্যের পণ্ডিত। বিস্মিত হওয়া ছাড়া উপায় কী তখন? সেখান থেকে সরে আসাটা নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য মর্যাদাকর। কারণ তারা যা বলেন, নিজেই জানেন না তার সংজ্ঞা বা বৈশিষ্ট্য কী। এত কম জেনে এত বড় বড় আস্ফালন করতে কারো লজ্জা পর্যন্ত লাগে না। সারাদিন কাউকে পড়ালেখা করার কথা বলা হচ্ছে না, যা নিয়ে কথা বলছে সেটা নিয়ে তো পড়াশোনা করা দরকার।
বাংলাদেশে আশির দশকে এমন কি নব্বইয়ের দশকে নেপালে বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না। বহু শিক্ষার্থী বাংলাদেশে আসতেন পড়াশোনা করতে। বহু মন্ত্রী, সাংসদের সন্তানকে দেখা গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করতে। নিজেরই আমার এমন বন্ধু ছিল ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেলে। সম্ভবত নেপালে এখন তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, যদি না এর মধ্যে সংখ্যা বাড়ে। সংখ্যা অনুপাতে এখন বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নেপালের তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিচে।
লেখক: সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ