সমরেশ মজুমদার

সমরেশ মজুমদার

বাঙলাদেশের মোসলমান পাঠকদের সমরেশ মজুমদারের আদর

তুহিন খান

প্রকাশিত : মে ১১, ২০২৩

এখানে একটা কথা বলা উচিত। হিন্দু অথবা মুসলিম, এ দুটো ধর্মের মানুষদের মধ্যে মুসলমান ধর্মের মানুষরা অনেক বেশি উদার, হিন্দুরা অনেক বেশি মৌলবাদী। এটা আমি কলকাতায়ও বলেছি, আপনাদের এইখানেও বলছি। কেন মৌলবাদী তার ব্যাখ্যা দিচ্ছি।

 

আমাদের কোনো লেখায় লক্ষ্মী পুজো, দুর্গা পুজো ইত্যাদি থাকবেই, বাংলাদেশের পাঠক কিন্তু সেটা পড়তে দ্বিধা করে না। কিন্তু আমাদের কোনো লেখায় বা আপনাদের কোনো লেখায় যখন স্বাভাবিকভাবে চাচা বা আপা এই সব শব্দ আসে, নায়ক নামাজ পড়ছে, পশ্চিমবঙ্গের পাঠক তা বন্ধ করে দেবে। তারা আর পড়তে পারে না। তাদের অস্বস্তি হয়। তারা কমিউনিকেট করতে পারে না।

 

আমি বলি, এটা মৌলবাদের চূড়ান্ত লক্ষণ। দে ক্যান নট অ্যাকসেপ্ট রিলিজিয়ন, রিলিজিয়নকে অ্যাকসেপ্ট করতে না পারলে সাহিত্যকে ধরতে পারবে না, তুমি সেই সময়ের মানুষকে ধরতে পারবে না, এই সময়ের মানুষকেও পারবে না। এ কারণে আমি বারবার বলি, আমাদের মৌলবাদী পাঠকদের লজ্জিত হওয়া উচিত। বাংলাদেশের মানুষ পাঠক হিসাবে মৌলবাদী নন।
—সমরেশ মজুমদার (`যে জলে আগুন জ্বলে`, নিউজ২৪, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৬)


সমরেশ মজুমদার এই আলাপে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের বেশি ‘মৌলবাদী’ বইলা বাঙলাদেশের মুসলিম অডিয়েন্সরে আদর করে দিছেন হালকা। সমরেশের মতো এই কথা আরও কোনও কোনও কোলকাত্তাই ভদ্রলোক বলে থাকবেন। এই আদর আশলে এক ধরনের পাম-পট্টি; এরমধ্যে সমরেশ তথা কোলকাতার কালচারাল স্টাব্লিশমেন্টের কিছু স্বার্থ লুকানো আছে।

 

১. এত বছরের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য, সো-কল্ড রেনেসাঁ, বৃটিশ ভারতের রাজধানীর গৌরব, সমরেশের মতো শত শত উদার ও আধুনিক লেখক ইত্যাদি থাকার পরেও পশ্চিমবঙ্গ কেন এত ‘মৌলবাদী’, এটা কখনো ব্যাখ্যা করেন নাই সমরেশরা। ওনাদের কোনও লেখায়ও পাওয়া যায় না এর ব্যাখ্যা। এই থিমে উনারা কোনও উপন্যাস লেখেন নাই।

 

কারণ এইটা ব্যাখ্যা করতে গেলে এর অনেকটুকু দায় কোলকাতার বৃহত্তর শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী সমাজের ওপর, তথা সিভিল সোসাইটির ওপরও আসবে। কোলকাতার পলিটিশিয়ানদের ওপর আসবে। সো-কল্ড বেঙ্গলি রেনেসাঁর পূজ্য ব্যক্তিত্বদের ওপর আসবে। এমনকি, ৪৭-এর দেশভাগ হিন্দুত্বের এই অধিকতর মৌলবাদী মনোভাবের কারণেই হইছিল কিনা, সে-প্রশ্নও উঠবে। সমরেশরা এসব প্রশ্নের রিস্ক নিতে নারাজ।

 

২. আবার বাঙলাদেশের মানুশ এত কম ‘মৌলবাদী’ হইলে ভারত কেন সারাক্ষণই এদেশে মৌলবাদী খুঁইজা বেড়ায়, বা বাঙলাদেশের সেক্যুলার জাতিবাদী সিভিল সোসাইটি জনগণরে ধর্মের ছুঁতায় ডেমোনাইজ কইরা কেন কোলকাতার রুচি, সংস্কৃতি ও নন্দনের সাব-অর্ডিনেট হইয়া থাকতে বাধ্য করে— সে প্রশ্নও তোলেন না সমরেশরা। বাঙলাদেশিদের কালচারাল অটোনমি বা এজেন্সির আলাপ তোলেন না ওনারা একদমই। কারণ তাতেও ওনাদের ব্যবসা কইমা যাওয়ার রিস্ক আছে।

 

আশলে সমরেশরা চান অনন্ত স্টাটাস কো। ফলে, সাম্প্রদায়িক সাংস্কৃতিক রাজনীতি নির্মাণে, এবং তুলনামূলক কম ‘মৌলবাদী’ হওয়ার পরেও বাঙলাদেশি মোসলমানদের ভিলিফিকেশনে দুই দেশের সিভিল সোসাইটি এবং কালচারাল ও পলিটিকাল এলিটদের ভূমিকা আলাপ না কইরা, সমরেশ সাধারণ পাঠকদের স্বভাব দিয়া পরিস্থিতিটার নিরাপদ ব্যাখ্যা দিতে চান। বলেন যে: হিন্দু পাঠক মৌলবাদী, মুসলিম পাঠক উদার।

 

এতে মুসলিম জনমানস খুশি হয় বটে, কিন্তু আল্টিমেট লাভটা হয় কোলকাত্তাই স্টাব্লিশমেন্টের। তারা অজুহাত দিতে পারে যে— দ্যাখো, আমরা তো উদার, ভালো; আমাদের জনগণ এত ‘মৌলবাদী’ দেইখাই আমরা তাদের বিরুদ্ধে কিছু কইতে/করতে পারি না। আমাদেরও কিছুটা মৌলবাদী হইয়া থাকা লাগে।

 

বাঙলাদেশিদের `উদার` বলাটা আশলে একটা পাম। সবল পোলাটা দুর্বল পোলাটারে মারলে আমরা যেমন গ্যাঞ্জাম এড়ানোর জন্য দুর্বলরে এই বইলা সান্ত্বনা দিই যে, ’আরেহ, ও তো পাগলা, তারছিঁড়া, খবিশ, তুই তো লক্ষী; অর লগে গ্যাঞ্জামে কাম নাই’, সমরেশদের এই স্টেটমেন্ট তেমনই। বাঙলাদেশিরা পশ্চিমবঙ্গের কালচারের ব্যাপারে উদার— এই আদরের অর্থ কী?

 

এর অর্থ হইল: ভারতের মানুশ তো খারাপ, তাই তোমাদের কালচার নেয় না; বাট তোমরা তো ভাল, তাই আমাদের কালচার নেওয়া থামাইও না। এই আদর আশলে বাঙলাদেশের প্রতি পশ্চিমবঙ্গ ও বৃহত্তর ভারতের নানা অন্যায় আবদার ও আগ্রাসন মাইনা নেওয়ার পক্ষে ওকালতিও বটে।

 

ভারত ও বাঙলাদেশের মধ্যে যে অন্যায় ও অসম রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক লেনদেন, সমরেশরা বাঙলাদেশের মানুশরে `উদার` বইলা আদরের মাধ্যমে, সেই লেনদেনটারেই স্মুদ রাখতে চান। তাতে এদেশে উনাদের ব্যবসাটাও ভাল জমে। তাই তারা পশ্চিমবঙ্গের ‘মৌলবাদ’র কারণ ব্যাখ্যা করেন না; এর প্রতিকারের আলাপও করেন না। নিজেরা দায় নেন না। এই অসম সম্পর্কের প্রতিক্রিয়ায় বাঙলাদেশিদের যে সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র ও কর্তাসত্তা গড়ে তোলা দরকার, সেই আলাপও করেন না।

 

বরং পশ্চিমবঙ্গের সাধারণ লোকদের গালি দিয়া আর এদেশের সাধারণ মোসলমানদের রেটরিকালি আদর কইরা কোলকাতার সাম্প্রদায়িক স্টাব্লিশমেন্টের মুখ রক্ষা করেন এবং নিজেদের বইয়ের বাজার স্মুদ রাখেন উনারা। বাঙলাদেশের সেক্যুলার স্টাব্লিশমেন্টও তাই সমরেশের কথার প্রতিবাদ করে না কোন; বলে না যে, ছি, কী বলচেন দাদা, এদেশ তো মৌলবাদীতে ভরা! আপনি জানেনই না কিছু!

 

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক