হরিশংকরের বাড়ি বইয়ের প্রচ্ছদ

হরিশংকরের বাড়ি বইয়ের প্রচ্ছদ

বাঙালির বাস্তুচ্যুতি ও হরিশংকরের বাড়ি

অমিত কুমার কুণ্ডু

প্রকাশিত : মার্চ ১৯, ২০২০

পলাশির যুদ্ধে বাঙালি তার স্বাধীনতা হারায়। একথা সত্য। তবে এর থেকেও বড় সত্য বাঙালি সেদিন স্বাধীনতা হারায়, যেদিন মীর মুহম্মদ জাফর আলী খান বাহাদুর, যাকে আমরা মীর জাফর নামে চিনি তিনি বিশ্বাসঘাতকতার ছক কষেন। মীর জাফর যখন ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রবার্ট ক্লাইভ এর সাথে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন তখনই বাংলায় পরাধীনতার বীজ বপিত হয়। মূলত মীর জাফরের কারণেই ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে ব্রিটিশদের হাতে নবাব সিরাজদ্দৌলার চূড়ান্ত পরাজয় ঘটে। পরাজয় ঘটে পুরো বাঙালি জাতির। এমনকি পরাধীন হতে শুরু করে পুরো ভারতীয় উপমহাদেশে।

সে এক দীর্ঘ ইতিহাস। এরপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন এলো। ভারতীয়দের শোষণ শাসন করে ইংল্যান্ডে কলকারখানা গড়ে উঠল। শুরু হলো শিল্পের অভূতপূর্ব উন্নতি। পোষাকের নতুন ধারা চালু হলো। সেখানে প্রয়োজন পড়ল নীল রঙের। পোষাক ও শিল্পে নীলের চাহিদা বেড়ে গেলে বাংলায় শুরু হলো নীল চাষ। একশ্রেণির ব্রিটিশ ব্যবসায়ী নীলচাষে কৃষকদের বাধ্য করতে শুরু করল। নীলকরদের অত্যাচারে তখন বাংলার কৃষক দিশেহারা।

শুধু কী নীল চাষ? ভারতের তুলো যেত ইংল্যান্ডে, সেখান থেকে কাপড় হয়ে আসত আবার এই ভারতে। বহুগুণ বেশি দাম দিয়ে সেই কাপড় কিনতে হতো আমাদের পূর্বপুরুষদের। লবণ উৎপাদন করতে দেয়া হতো না ভারতীয় উপমহাদেশে, লবণ চাষিদের জেলে পর্যন্ত যেতে হতো। লবণ আসতো ইংল্যান্ড থেকে। ভারতীয় উপমহাদেশেকে করে রাখা হয়েছিল ইংল্যান্ডের পণ্য বিক্রির বাজার। এটা থেকে আমরা কী বুঝতে পারি? আমরা বুঝতে পারি, ইংরেজরা চায়নি ভারতীয়রা স্বনির্ভর হোক। নিজেদের প্রয়োজনীয় পণ্য নিজেরা উৎপাদন করুক। ভারতীয়দের পরমুখাপেক্ষী করে রাখাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য।

যে জাতি পরমুখাপেক্ষী থাকে, সে জাতিকে পরাধীন রাখা সহজ হয়, এমনকি শাসন শোষণ করাও সহজ হয়। অন্যদিকে ইংল্যান্ডে ঘুরতে শুরু করল রেলের চাকা। স্টিম ইঞ্জিনের অভূতপূর্ব উন্নতিতে খুলে গেল সভ্যতার নতুন দুয়ার। একশ্রেণীর মানুষ শিল্প-সমঝদার হয়ে উঠল। শিল্প-সাহিত্যের বিকাশে ভূমিকা রাখতে শুরু করল অভূতপূর্বভাবে। পাশাপাশি এ সময় বাংলায় এক নতুন চেতনার উন্মেষ ঘটল। রাজা রামমোহন রায় সতীদাহপ্রথা অইন করে বন্ধ করতে পারলেন। রাজা রামমোহন রায়, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরেরা ব্রাহ্মধর্মের প্রচার করতে শুরু করলেন।

হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠিত হলো। সেখান থেকে মাইকেল মধুসূদন দত্তের মতো ইংরেজি জানা ছাত্ররা বের হতে থাকলেন। সংস্কৃত কলেজে দক্ষতার সাথে অধ্যাপনা শুরু করলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। বাংলায় সাহিত্য রচনা শুরু হলো। বাংলা ভাষাভাষী জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষা বিস্তার শুরু করলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও বাংলার গুণী শিক্ষিত সমাজ। নারী শিক্ষার উদ্যোগ নেয়া হলো। গ্রামে গ্রামে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলো। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন শোষণ ও বাংলার নবজাগরণ হাত-ধরাধরি করে চলতে থাকল।

পলশীর যুদ্ধের একশো বছর পরে ১৮৫৭ সালে শুরু হলো সিপাহী বিদ্রোহ। সিপাহীদের এই স্বাধীনতা সংগ্রামে সিপাহীরা জয়ী হতে পারল না ঠিক, তবে এতে ভারতীয়দের মনোবল বৃদ্ধি পেল, অপরদিকে ইংরেজদের মনোবল ভেঙে গেল। সিপাহী বিদ্রোহের ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ভারতবর্ষের শাসন ক্ষমতা চলে এল ব্রিটিশ রাজপরিবারের হাতে। এদিকে নীলবিদ্রোহ ক্রমে বাড়ছে। ইংরেজদের উপর ভারতীয়দের ঘৃণা প্রবল হচ্ছে। গড়ে উঠছে প্রতিরোধ। বাংলার কৃষক নীলচাষ বন্ধ করতে শুরু করলেন। দীনবন্ধু মিত্রের নীলদর্পণ নাটকের ইংরেজি অনুবাদের প্রভাব পড়ল বেশ জোরেসোরে। অন্যদিকে কৃত্রিম রং আবিষ্কারের ফলে নীলকরদের প্রভাব ধীরে ধীরে কমতে থাকল।

ক্রমে বাংলার শিক্ষিত সমাজের মধ্যে স্বদেশচেতনা জাগ্রত হলো। একসময় ইংরেজদের প্রভাবে দলে দলে যে তরুণসমাজ খ্রিস্টান হয়ে যাচ্ছিল, কিংবা ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত হচ্ছিল স্বামী বিবেকানন্দের দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা স্বদেশি আন্দোলনে চিত্ত সমার্পণ করল। সুভাষচন্দ্র বসু, অরবিন্দ ঘোষ, বাঘা যতীন, মহাত্মা গান্ধি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চক্রবর্তী রাজাগোপালাচারী থেকে শুরু করে জওহরলাল নেহরু পর্যন্ত অসংখ্য তরুণ স্বামী বিবেকানন্দের দ্বারা প্রভাবিত হলেন। স্বদেশ চেতনায় যুক্ত হলো নতুন ভাবনা।

এরপর রবীন্দ্র যুগ শুরু হলো বাংলায়। ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার পেলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হলো। বাঙালির মনোবল বেড়ে গেল বহুগুণ। স্বদেশি আন্দোলনে যুক্ত হলো রবীন্দ্রনাথের গান। এ ধারায় যুক্ত হলেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন, অতুল প্রসাদ সেনসহ অনেকে। ভারতজুড়ে স্বাধীনতার জন্য তীব্র আন্দোলন শুরু হলো। একদিকে মহাত্মা গান্ধীর অহিংস আন্দোলনে, অন্যদিকে নেতাজী সুভাসচন্দ্র বোসের সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অর্জনের পথ অনেকটা এগিয়ে গেল। এর মধ্যে শুরু হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। বিশ্ব এক মহা বিপর্যয়ের মধ্যে এসে পড়ল। বিশ্বের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এল। ভারতবর্ষ ও বাঙলায় পড়ল তার ছোঁয়া।

পাশাপাশি ভারতবর্ষের বিভিন্নস্থানে শুরু হলো সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতা। হিন্দু-মুসলমান, যারা একসাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছে, তাদের মধ্যে দেখা গেল অবিশ্বাস। কংগ্রেসের উপর ভারতবর্ষের মুসলিমরা আস্থা রাখতে পারলেন না। প্রতিষ্ঠিত হলো মুসলিম লীগ। তরুণ শেখ মুজিব মুসলিম লীগের হয়ে কাজ করতে শুরু করলেন। পাকিস্তান আন্দোলন জোরদার হলো। ১৯৪৬ সালে পাকিস্তান দাবির পক্ষে অনুষ্ঠিত হলো নির্বাচন। একইবছরের আগস্ট মাসে কলকাতাসহ পুরো বাংলায় শুরু হলো ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। ব্রিটিশদের বিভাজন নীতি সফল হলো। ১৯৪৭ এর আগস্টে ভারতবর্ষ স্বাধীন হলো কিন্তু অখণ্ড থাকল না। ভারত ভাগ হলো তিনভাগে।

একভাগ পূর্বের ভারত। অন্য দুইভাগ পাকিস্তান। পূর্ব বাংলা হলো পূর্ব পাকিস্তান। দেশ স্বাধীন হলো কিন্তু মানুষের মধ্যে নেমে এলো ইতিহাসের সর্বোচ্চ বাস্তুচ্যুতি। বাড়িঘর সহায় সম্পত্তি ফেলে রেখে বাঙালি ছুটতে থাকল পূর্ব-পাকিস্তান থেকে পশ্চিম বাংলায় কিংবা পশ্চিম বাংলা থেকে পূর্ব পাকিস্তানে। বহু মানুষ সহায়-সম্পত্তি হারিয়ে নিঃশেষ হয়ে গেল। এত ত্যাগের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা, সে স্বাধীনতা পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ লাভ করতে পারল না। বাঙালি যেই পরাধীন সেই পরাধীনই থাকল। ধর্মের কারণে ভারত ভেঙে যে নতুন দেশ সৃষ্টি হলো, ধর্ম সেখানে সম্প্রিতি ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে পারল না। নতুন সৃষ্ট ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তান কার্যত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ল। পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানের নতুন উপনিবেশ স্থাপিত হলো। অবাঙালি শিক্ষিত পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাংলার শাসনভার হাতে তুলে নিল।

পূর্ব বঙ্গে, যা নতুন ভাবে হওয়া পূর্ব পাকিস্তানে, পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন ও শোষণ চলতে থাকল। বাঙালির ভাষা, বাঙালির সংস্কৃতি, বাঙালির সম্প্রিতি সব ভেঙে যেতে থাকল। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারলেন এ স্বাধীনতা, এ পাকিস্তান তিনি চাননি। নতুন প্রতিষ্ঠিত হওয়া মাওলানা ভাসানীর অাওয়ামী মুসলিম লীগের সহ-সম্পাদক হলেন শেখ মুজিব। পরে বৃহত্তর ঐক্যের কথা চিন্তা করে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে শুধু আওয়ামী লীগ করা হলো। পূর্ব পাকিস্তানে শুরু হলো নতুন দলের যাত্রা। নতুন রাজনৈতিক চেতনা, নতুন বাঙালি দেখে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী নড়েচড়ে বসল। প্রথম আঘাতটা এল ভাষার উপর। বাঙালি প্রতিবাদে ফেটে পড়ল। শুরু হলো ভাষা আন্দোলন। তখন ঢাকা ভার্সিটি ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যায়নরত বাঙালি মেয়েরা কালো পাড়ের সাদা শাড়ি পড়ে মিছিলের অগ্রভাগে দাঁড়াল। ছেলেদের সাথে পাশাপাশি ভাষার জন্য সংগ্রাম শুরু করল।

নারী-পুরুষের সম্মিলিত অান্দোলন গণ আন্দোলনে রূপ নিল। ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ সালে ছাত্র-জনতার উপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নির্দেশে পুলিশ গুলি চালাল। শহীদ হলেন রফিক, বরকত, সালাম, জব্বার ও নাম না জানা আরো অনেকে। ভাষার জন্য রক্ত দিয়ে বাঙালির স্বদেশ চেতনা বহুগুণ বেড়ে গেল। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বাংলার যুক্তফ্রন্ট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করল কিন্তু মুসলিম লীগের ষড়যন্ত্রে যুক্তফ্রন্ট বেশি দিন সরকারে থাকতে পারল না। এরপর নানা ঘটনা-অঘটনের মধ্যদিয়ে ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইউব খান পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করলেন। পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র ১১ বছরের মাথায় গণতন্ত্র শেষ হয়ে গেল। পাকিস্তান পতনের বীজটাও বোধহয় বপিত হলো এ ঘটনার মধ্যদিয়েই।

এই শুরু। এরপর বাঙালির আর পিছনে তাকাতে হয়নি। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধ বাধল। পূর্ব পাকিস্তান তখন একেবারে অরক্ষিত। শেখ মুজিব তখন ভালোভাবে বুঝতে পারলেন দেশের স্বাধীনতার গুরুত্ব। তিনি হলেন আওয়ামী লীগের সভাপতি। আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৬৬ সালে ঘোষিত হলো ছয় দফা। এরপর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রতিবাদ। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান। শেখ মুজিবকে `বঙ্গবন্ধু` উপাধি প্রদান। সবকিছু একের পর এক রোমাঞ্চকর গল্পের মতো এগিয়ে যেতে থাকল।

১৯৭০ সালের নভেম্বরে বাংলার দক্ষিণাঞ্চল পড়ল ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের কবলে। মারা গেল পাঁচ লাখ মানুষ। এ পরিস্থিতিতেও পাকিস্তান সরকার বা মুসলিম লীগের থেকে কোন সহায়তা পেল না দূর্দশাগ্রস্থ জনগন। বাঙালি আরেকবার বুঝল স্বাধীনতার প্রয়োজনীয়তা। এই ১৯৭০ সালেই অনুষ্ঠিত হলো নির্বাচন। আওয়ামী লীগ এবারও যুক্তফ্রন্টের মতো নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করল। কিন্তু পাকিস্তানের তৎকালিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তর করলেন না। ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ গণপরিষদের অধিবেশন ডেকেও তা বাতিল করে দিলেন। পূর্ববাংলার জনগণ সেটা মেনে নিতে পারল না। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ লক্ষ জনতার সামনে ঘোষণা দিলেন, "এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।"

পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ভয় পেয়ে গেল। তারা ২৫ মার্চ ঢাকায় গণহত্যা শুরু করল। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করা হলো। গ্রেফতারের পূর্বে তিনি স্বাধীনতার লিখিত ঘোষণা দিয়ে গেলেন। ২৬ মার্চ রেডিওতে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ হলো। ১৯৭১ এর সাতই মার্চের ভাষণ। ২৫ মার্চ গণহত্যা ও ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা, মুজিবনগর সরকার গঠন, সব খুব দ্রুতই হয়ে গেল। পূর্ব বাংলার এক কোটি শরনার্থী গিয়ে ঠাই নিল ভারতে। ভারত থেকে প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করল মুক্তিযোদ্ধারা। দীর্ঘ নয়মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হল। শেষের দিকে ভারত ও বাংলাদেশের মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভ করল বাংলাদেশ।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন হলো। তিনি হলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে সংবিধান প্রণীত হলো। ১৯৭২ সালে জাতীয় কবির খেতাব দিয়ে কাজী নজরুল ইসলামকে বরণ করে নিলেন তিনি। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আবার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল। তিনি দেশ গঠনের কাজে হাত দিলেন। কিন্তু বেশিদিন তিনি দেশের হয়ে কাজ করতে পারলেন না। দেশি-বিদেশি চাক্রান্তে একদল বিশ্বাসঘাতকের হাতে তিনি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে নিহত হলেন।

বাঙলায় বিশ্বাসঘাতকতা যে সূচনা হয়েছিল ১৭৫৭ সালে, ১৯৭৫ সালে সেই বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হতে হলো বঙ্গবন্ধুকে। সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশের স্বপ্ন ভূলুণ্ঠিত হয়ে গেল। পাকিস্তানে যে সামরিক শাসন দেশ স্বাধীন হওয়ার ১১ বছরের মাথায় এসেছিল। সামরিক শাসন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ মাত্র চার বছরের মাথায় সেই সামরিক শাসন আবার দেখতে পেল। সংবিধানের স্তম্ভ ভেঙে গেল। দেশ আবার অন্ধকারে নিমজ্জিত হলো। এই যে পটপরিবর্তন। এই যে ভাঙাগড়া। ইতিহাসের এই যে বাকবদল। এতে কোটি কোটি মানুষ প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো। লাভবান হলো সুযোগসন্ধানী একটি মহল। এতে করে যারা বাস্তুচ্যুত হলো তাদের জন্য নেমে এল সীমাহীন শোক।

লেখক পলাশ মজুমদার এ শোক গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছেন। বাঙালির বাস্তুচ্যুতিতে তার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে। তিনি মর্মে মর্মে বুঝতে পেরেছেন এই দুঃখগাথা। দেশ-বিদেশের ভ্রমণ পিপাসু মন তাকে টেনে নিয়েছে সীমান্তে। কখনো সীমান্তের "হরিশংকরের বাড়ি" তাকে কাঁদিয়েছে। কখনো বর্ডার লাইন তাকে বেদনার ভারাক্রান্ত করেছে। বাঙালির `দেশভাগ ও দাঙ্গা` নিয়ে পলাশ মজুমদারের বই `হরিশংকরের বাড়ি`। বইটিতে তিনি লিখেছেন এটি তার প্রথম প্রকাশিত গল্পগ্রন্থ। প্রথম হলে অনেকের লেখা কাঁচা হয়। এ বই তেমনটি নয়। বইটি পড়লে বোঝা যায়, পলাশ মজুমদার একজন দায়িত্বশীল ও পড়ুয়া লেখক। তার বইটিতে দেশভাগের বেদনা উঠে এসেছে। উঠে এসেছে উদ্বাস্তুর দুঃখ। খুব সুন্দর সরল গদ্যে। সাহিত্যের শক্তিশালী একজন লেখক হবেন পলাশ মজুমদার।

এই বইটি পড়তে গিয়ে আমার মনে হয়েছে, ইতিহাস বড় নির্মম। কখন কি পটপরিবর্তন হয় তা বলা যায় না। বিশ্বাসী কখন বিশ্বাসঘাতক হয়ে ওঠে তাও বলা যায় না। পাশাপাশি মনে হয়েছে, ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। এমনকি কাউকে ভুলেও যায় না। যেমন মীর জাফর থেকে মুশতাকের মতো বিশ্বাসঘাতক, কাউকে ইতিহাস ক্ষমা করেনি। তেমনি সিরাজুদ্দৌলা থেকে বঙ্গবন্ধু, কাউকে ভুলেও যায়নি। মুজিব শতবর্ষের শুরুতে আমার মনে হচ্ছে, ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ এ বিশ্বের একজন নেতার শারীরিক মৃত্যু হয়েছে মাত্র। কিন্তু তিনি মারা যাননি। এ দেশের মাঝে তিনি আজও বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন। অনন্তকাল।

১৭ মার্চ ২০২০

একুশে বইমেলা ২০১৮