`বাঙালী জীবনে রমণী` বইটা পড়িবার পর

শরিফ সাইদুর

প্রকাশিত : মার্চ ২২, ২০১৯

একটা ঘটনা দিয়া লেখাটা শুরু করিতেছি। একবার লেখক নীরদচন্দ্র রায়ের সহিত ভারত সরকারের সম্পর্ক খুব খারাপ হইল। ভারত সরকার যাবতীয় কাজকর্মে নীরদ বাবুর প্রতি নিষেধাজ্ঞা জারি করিয়াছে। এমতাবস্থায় তিনি আর্থিক অবস্থার দুরবস্থায় পতিত হইলেন। একসময় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হইল। বাংলাদেশের এক কোটি মানুষ সেনাবাহিনীর অত্যাচার হইতে বাঁচিবার ইচ্ছায় ভারতে জমায়েত হইল। ভারত সরকার ইচ্ছা করিল, এহেন পরিস্থিতি তারা বিশ্ববাসীকে বিবিধ উপায়ে জানাইবে। সেই লক্ষ্যে রিফুজির বর্ণনা দিয়া পুস্তিকা লেখিবার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় লেখক খুশবন্ত সিংকে ডাকিল। খুশবন্ত বলিল, আমি তো পাঞ্জাবি, কোনো বাঙালিকে সাথে পাইলে খুব উত্তম হইত। এই বলিয়া তিনি নীরদচন্দ্র চৌধুরীর নাম প্রস্তাব করিলেন। মন্ত্রণালয় সানন্দে প্রস্তাবে সম্মতি দিলো।

খুশবন্ত গিয়া নীরদ বাবুকে সরকারের সিদ্ধান্ত বলিলেন। নীরদ বাবু জিজ্ঞেস করিলেন, ভারত সরকার কি আমার উপর হইতে নিষেধাজ্ঞা উঠাইয়াছে? খুশবন্ত বলিল, হ্যাঁ। উঠাইয়াছে। এবার নীরদ বাবু সে অবস্থাতেও দৃঢ়তার সাথে বলিল, ভারত সরকার নীরদ চৌধুরীর উপর হইতে নিষেধাজ্ঞা উঠাইলেও নীরদ চৌধুরী ভারত সরকারের উপর হইতে নিষেধাজ্ঞা উঠায় নাই।

বাঙালির এরকম চারিত্রিক দৃঢ়তা আজকাল দেখিতে পাওয়া যায় না। লেখক নীরদচন্দ্র চলনে, বলনে, মননে ইংরেজ হইতে চাহিয়াছিলেন। ইংরেজ সভ্যতাকে ধারণ করিতে চাহিয়াছিলেন। কিন্তু পারিয়াছিলেন কিনা জানি না। তবে জীবনে শৃঙ্খলাবিধির চালনা করিয়াছেন। এই লেখককে ঠোঁটকাটা হিসেবে অনেকে আখ্যা দিয়া থাকেন। যাহা বিশ্বাস করিতেন তাহা অকপটে বলিতে পারিতেন। যে কারণে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে এমন মন্তব্য করিয়াছেন যাহা অনেকেই হজম করিতে পারে নাই। যেমনি রবীন্দ্রনাথ নিয়া তাহার মন্তব্য অনেকে হজম করিতে পারে নাই। জ্ঞানী রবীন্দ্র ভক্তকে দেখিয়াছে গোস্বার সহিত তার প্রতি বাক্যবাণ ছুড়িতে।

আলোচ্য বইখানা তাহার লেখা পহেলা বাংলা বই। যাহা তিনি ৭০ বৎসর বয়সে রচনা করিয়াছিলেন। বইয়ের ভূমিকাতেই তিনি তীক্ষ্ণ তীক্ষ্ণ বান মারিয়াছেন কলকাতার বুদ্ধিজীবীদের। আটখানা পরিচ্ছেদে বইটা সজ্জিত। কাম ও প্রেম, দেশাচার, বাংলার দৃশ্য ও বাঙালির ভালোবাসা ইত্যাদি নামে পরিচ্ছেদগুলো। কাম ও প্রেম পরিচ্ছেদে তিনি দেখাইয়াছে এদেশের সমাজ, সাহিত্য মূলত কাম প্রধান ছিল। ইউরোপীয় রোমান্টিকতা আসিবার আগেও কামই ছিল মূল। প্রেম সে অর্থে মূখ্য ভূমিকায় ছিল না। ইংরেজ আসিবার ফলে যেমন জাতীয়বোধ আসিয়াছে তেমনি প্রেমও আসিয়াছে। এইখানে লেখক বিভিন্ন কাব্য সাহিত্যের মাধ্যমে তা প্রমাণ করিবার সফল প্রচেষ্টা চালাইয়াছেন।

এরপর দেশাচার পরিচ্ছেদে তখনকার সমাজের সুন্দর কুটিল, কদর্য রুপগুলো চিহ্নিত করিয়াছেন। যা পড়িতে ভালোই লাগে। পুলকিত হওয়া লাগে কাম কিভাবে সমাজে জরাইয়া ছিল। এই পরিচ্ছেদ সবার নাও ভালো লাগিতে পারে। তবে এই অধ্যায়টি খুব গুরুত্ব রাখে।

`বাংলার দৃশ্য ও বাঙালির ভালোবাসা` পরিচ্ছেদটির মতো সুখপাঠ্য, সুস্বাদু, মিষ্টি সাধু গদ্য আমি তেমন আর পড়ি নাই। নদী, নারী, জল, সমাজ, জোছনা, প্রকৃতির সমন্বয়ে যে মোহনীয় আবেশ গদ্যে তৈরি হইয়াছে তা ভুলিবার মতো না। বারবার পড়িবার মতো। প্রকৃতির রূপ রস বর্ণনায় লেখক তাহার বন্ধু বিভূতিভূষণের মতই মুন্সিয়ানা দেখাইয়াছেন।

`বাঙালি সমাজ ও নূতন ভালবাস` এই পরিচ্ছেদে লেখক রবীন্দ্রনাথের গল্প ও বিভিন্ন সাহিত্যের বিশ্লেষণ করিয়া বুঝাইতে চাহিয়াছেন যে, নতুন যে ভালবাসা বাঙালি সমাজে আসিয়াছে তা মূলত ইউরোপ কেন্দ্রিক। এদেশে তা আগে ছিলো না। এই পরিচ্ছেদকে রবীন্দ্রনাথের গল্পের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ হিসেবে পড়াই উত্তম মনে করি।

এরপরের পরিচ্ছেদে বাঙালির মন ও ভালোবাসা নিয়ে আলোকপাত করিয়াছেন। এরপর বঙ্কিম সাহিত্য ও তার দ্বারা প্রেম ভালবাসা কিভাবে প্রকাশ পাইয়াছে তার বিশ্লেষণ। এই অধ্যায়কেও বঙ্কিম সাহিত্যের ব্যাখ্যা হিসেবে পাঠ করা যায়। খুব সুক্ষ্ণ ও তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ। এক্ষেত্রে বলিয়া রাখা উত্তম যে, রবীন্দ্র সাহিত্য ও বঙ্কিম সাহিত্য কিছুটা পড়া থাকিলে বইটা পড়িয়া বেশি লাভবান হওয়া যাইবে।

বইটি শেষ করিয়াছেন বইটি লেখার চল্লিশ বছর পূর্বেকার এক প্রবন্ধ দিয়া। যেইটা তিনি `শনিবারেরে চিঠি`তে সম্পাদক থাকাকালীন লেখিয়াছেন। `প্রেম--সাহিত্যে ও জীবনে` নামে যৌবনে তিনি যে প্রবন্ধ লেখিয়াছেন তা পড়িয়া সে বয়সে তাহার পড়াশোনার বিস্তৃতি দেখিয়া বিস্মিত হইয়াছি। এইখানে তিনি যা বলিয়াছেন তার সারমর্ম হইলো, সাহিত্যে অশ্লীলতা আনিবার সুযোগ নাই। আনিলেও তাহা শিল্পের মোড়কে আনা যাইতে পারে। অন্যথায় তাহা অশ্লীলতাই।

শেষে বলিতে চাই, বইটাতে অনেক কথাই তিনি অগুছালো বলিয়াছেন। ফ্রেঞ্চ, ইংরেজি, সংস্কৃত কবিতার, উদ্ধৃতির ব্যাখ্যামূলক অনুবাদ দিলে বুঝিতে পারিতাম ভালো। এক জায়গায় ঘটনাক্রমে আনিয়াছেন যে, মুসলিম আসার আগে প্রাচীন কালে হিন্দুদের মধ্যে আধুনিক কালের মতই নারীপুরুষের চলাফেরা ছিলো। কিন্তু এই কথার প্রমাণে কোন সুন্দর ব্যাখ্যা মিলে নাই। শুধুমাত্র পৌরাণিক কাহিনী হইতে একখানা ঘটনা বলিয়াছেন। সর্বোপরি বলিতে পারি, খুব ভালো একখানা বই পাঠ করিলাম। তবে আরও ব্যাপক পড়াশোনা থাকিলে ভালো বুঝিতাম, বইটা ভালো বিশ্লেষণ করিতাম, ত্রুটিগুলো আরও নির্দেশ করিতে পারিতাম। তবুও বলিবে, এই বিষয়ে অনুসন্ধিতসু মানসিকতার পাঠকরা পড়িয়া দেখিতে পারেন।

একুশে বইমেলা ২০১৮