বাহাত্তুরের সংবিধান থেকে যত সরে যাব, করোনায় তত আক্রান্ত হবো

চয়ন খায়রুল হাবিব

প্রকাশিত : মার্চ ১৮, ২০২০

করোনাজঙ্গ
গতকাল ছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী। যেভাবে উদযাপনের কথা ছিল, তার অনেকটুকু কাটছাট করতে হয়েছে করোনা ভাইরাস প্যান্ডেমিকের কারণে। বঙ্গবন্ধুর জীবনে আকস্মিক যবনিকা ঘটায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিপথগামী কিছু সদস্য। সেভাবেই আমাদের ভাবতে, লিখতে এবং বলতে বলা হয়েছে। তার সাথে আমরা জানি, দুই যুগ ধরে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সেনাশাসনের সময় বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। ১৯৭৫ এ সেনাকর্তারা যেভাবে পারস্পরিক হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠেছিল, তার বিপরীতে ২০২০ সালে একই সেনাবাহিনী কি লাখো গুণ বেশি সুবিধা পাওয়া অবস্থায় করোনা কবলিত দেশবাসীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় অংশগ্রহণে আন্তরিক?

ফরাসি রঙ্গ
ফ্রান্সের সব অঞ্চলে লক ডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। শুধুমাত্র সুপার মার্কেট, টাবাক ও রুটির দোকান খোলা। এ লেখাটি ফ্রান্সের সাথে বাংলাদেশের তুলনা করবার জন্য নয়। লক ডাউনের ভেতর দেখলাম চূড়ান্ত বর্বরতা, স্বার্থপরতা, কুশিক্ষিতা ও অসভ্যতা। ফরাসি, অফরাসি, সাদাকালো, বাচ্চাদের, প্র্যাম ঠ্যালা বাবা-মায়েদের। একটা আদেখলাপনা, একটা নাদানকি, একটা জন্তুপনা, আতঙ্কটা তার অজুহাত মাত্র। হতভম্ভ হয়ে সাবানের খালি তাকের দিকে, টয়লেট রোলের খালি তাকের দিকে, দুধের খালি তাকের দিকে, রুটির খালি তাকের দিকে তাকিয়ে আছি। তাকিয়ে আছে মাজুল বুড়োবুড়ি, কাজ ফেরতা লোকজন। তাকগুলোতে য্যানো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম বড় বড় নখ, আর চোখা চোখা দাঁতের দাগ।

একটা বোরখা পরা নানি বা দাদি, একটা তসবিহ টেপা নানা বা দাদা, ছেলে বা ছেলের বৌ, মেয়ে বা মেয়ের জামাই, সাথে নাতি, নাতনি গাড়ি দুটো নিয়ে এসেছে। সবার হাত ঠাসা, কয়েকটা ট্রলি ঠাসা। নানিটা উন্মাদের ভঙ্গিতে ফোনের মনিটারে কি বলছে, কাছে গিয়ে উঁকি দিলাম। ওপাশ থেকে আরেকজন আরেক মার্কেট থেকে চিৎকার দিয়ে কি কি বলছে। পুরো কাফেলা এবার ছুট। সারা গায়ে টাট্টু দাগানো, পুরো শরীর মোড়ানো কালো চামড়ার পোষাক দশাসই ভুড়িদার শ্বেতাঙ্গ এক বাইকার দম্পতি ক্রেটের পর ক্রেট বিয়ার ট্রলিতে ওঠাচ্ছে তো ওঠাচ্ছেই। আমার এক পাশে একজন বয়স্কা, কুজে ধরা এক মহিলা, একটু দূরে এক তরুণী। দুজনেই খাবলাখাবলিতে আনাড়ি। বয়স্কা বলল, কিচেন টাওয়েল অব্ধি শেষ করে ফেলেছে। তরুণী এসে বুড়িকে বলল, তুমি কি কিচেন টাওয়েল পাছা মুছানিতে ব্যবহার করবে? বুড়ি বলল, হ্যাঁ। তরুণী বাস্কেট থেকে ওকে দুই রোল কিচেন প্যাপার দিলো। আমাকেও জিজ্ঞেস করলো। ঘাড় নাড়াতে আমাকেও দুই রোল দিলো। আমি বাংলাতে নিদ্বির্ধায় বললাম, পাছা মুছানি কাগজে লেখা প্রেমপত্র। বুড়ি আর তরুণী ফ্যালফ্যাল করে তাকাতেই অনুবাদ করে দিলাম। বুড়ির খিকখিক, তরুণীর অট্টহাসিতে বর্বরতা ভেসে গেল ঝর্নার কুলকুলে। বুড়ি বলল, স্পেক্টাক্লে এক্সট্রা অরদিনেয়ার। তরুণী আর আমি চোখ টেপাটেপি করে যার যার পথে।

আরেক মার্কেটে দেখা হলো আমার দেশের বিয়ানিবাজার, সিদ্দিকবাজারের ইত্যাদি জিনস পরুয়া, ওয়াহাবি দাড়িধারী যারা সিরিয়ান এক্সোডাসের সাথে মিশে ফ্রান্সে ঢুকে পড়ে একের পর বাচ্চা বিয়ায় যাচ্ছে সে দঙ্গলের সাথে। একজন জানালো, উইকএন্ডে তাকে নাকি আরেক `ভাই`  জানিয়েছে সে তার লিভিং রুম, করিডোর পুরো বাসায় মেঝে থেকে ছাদ খালি মজুতই করে যাচ্ছে কয়দিন। জানতে চাইলাম, আপনি মজুত করেন নাই? সে জানালো, কিছুটা করেছি, আরো টয়লেট রোল নিতে আসছি, আর এই বিয়ানি বাজারের `ভাই`কে শপিংয়ে হেল্প করতে আসছি। বিয়ানি বাজারেরটা ক্লিন শেভ হোতকা আমার চেয়েও অনেক বুড়া, সাথে হাঁটুর সমান বাচ্চা। সে বাচ্চাটাও দুই হাতে ঠেসে ঠেসে কি কি সব নিচ্ছে। বুঝলাম, বাজেট, ইকোনমি প্যাকেজিং শিখে গেছে। কোনোদিন কি এই পিচ্চি সিলেটের মুজতবা আলীর কথা জানবে? আমি আর ওদেরকে পাছা মুছানি কাগজের কথা জিজ্ঞেস করি নাই। টয়লেট রোলের বাংলা পাওয়াতে আমার আনন্দ হতে থাকলো। পাছা মুছানি কাগজ না বলে শুধু পাছা মুছানি বলা যেতে পারে।

সেনাবিভাগ
আমরা জানি যে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী একটি সুশৃঙ্খল বাহিনী হিশেবে জাতিসংঘের বিভিন্ন শান্তি রক্ষা মিশনে কাজ করে। বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাওয়া হাসপাতালগুলো সামরিক নিবাসের ভেতর। রাডিসন হোটেল পরিচালনা, ট্রাস্ট ব্যাঙ্ক পরিচালনা, গলফ কোর্স পরিচালনা, হাতির ঝিলের উন্নয়ন, বাংলাদেশের সবচেয়ে ব্যয়বহুল বিয়ের কমিউনিটি সেন্টার পরিচালনার মতো সফল আর্থিক সব কর্মকাণ্ড সেনাবাহিনী করছে। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সেবা পেতে বাঙালি কী সুদান, আইভরি কোস্টের চেয়ে কম যোগ্য? এর জন্য কি বাংলাদেশকে সেনাসদস্যদের বিশেষ ভাতা দিতে হবে? এরই মধ্যে কি বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ আবাসিক এলাকাগুলো সেনাকর্তাদের হাতে তুলে দেয়া হয়নি? কল্পনা চাকমা নিখোঁজ তদন্তে, তনু হত্যা তদন্তে সেনাবাহিনী যেরকম দক্ষভাবে বাধা প্রদান করে এবং বেসামরিক কর্তৃপক্ষ যেভাবে এসব ব্যাপারে সামরিক নির্দেশনা মেনে নেয়, সেভাবে করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় কোনো দক্ষ পারস্পরিকতা দেখা গেল না।

জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও দুর্যোগের সময় যে কোনো দেশের সামগ্রিক আইন শৃঙ্খলা রক্ষার একটি স্তরে সেনাবাহিনীর থাকবার কথা। সেটি নিয়ন্ত্রণ করে একটি বেসামরিক টাস্ক ফোর্স। সব উন্নত দেশে এই টাস্ক ফোর্স সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞদের নেতৃত্বে গঠিত হয়েছে। বাংলাদেশে না দেখা যাচ্ছে কোনো সম্মিলিত টাস্ক ফোর্স, না শোনা যাচ্ছে চিকিৎসক ও আইন রক্ষাকারী বাহিনীর ভেতর সমন্বিত উদ্যোগের খবর। যে খবরগুলো আসছে, তাতে জনস্বাস্থ্য যে প্রবল হুমকির মুখোমুখি তা বোঝা যাচ্ছে, কিন্তু জনগণের অর্থ ব্যায়ে তৈরি বাহিনীগুলো তাকে কোনো অগ্রাধিকার দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। চুম্বক খবরগুলো দেখা যাক:

১. গাজীপুরে কোয়ারেনটাইন ভবনের গেট ভেঙে ইতলি থেকে আসা লোকজন রাস্তায় বিক্ষোভ করেছে।
২. বাহরাইন প্রত্যাগত এক দম্পতির করোনা ভাইরাসের লক্ষণ থাকায় ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল আনার পর আইইডিসিআরকে খবর দিয়ে, কর্তারা যখন পরামর্শে মগ্ন, তখন আইইডিসিআর-এর বিশেষজ্ঞ টিম এসে পৌঁছ‌নোর আগেই দম্পতি পালিয়েছে হাসপাতাল থেকে।
৩. ইউরোপ থেকে ইউরোপিয়ান এবং বাংলাদেশিদের বাংলাদেশে প্রবেশে সাময়িক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলেও বিভিন্ন এয়ারলাইন্স তা মানছে না। সরকারের প্রজ্ঞাপনের পর দেশের আকাশসীমার নিরাপত্তা বিমানবাহিনীর ওপর বর্তায়।

সেনাবাহিনী যদি নির্বাচনের সময় সারা দেশে বেসামরিক ইলেকশান কমিশনের তত্ত্ববধানে নিরাপত্তা বিধানে ভূমিকা রেখে থাকে, তাহলে সমন্বিত উদ্যোগ ব্যাপারটি নতুন নয়। করোনা ভাইরাস প্যানডেমিকের সময় এ সমন্বিত উদ্যোগ শুরুতে কেন হোচট খাচ্ছে. তা বাংলাদেশের সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় বিপর্যয় আরো বাড়াবে। বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতকে লাগামহীন করে দিয়ে এর ভেতর জাতীয় স্বাস্থ্যকে দুর্বল করে দেয়া হয়েছে। সামরিক চিকিৎসকদের ব্যাপক একটি অংশ প্রাইভেট চিকিৎসা খাতে নিয়োজিত। বেসামরিক চিকিৎসকদের ব্যাপক একটি অংশ দেশের মানুষের কাছে কসাই নামে কুখ্যাতি পেয়েছে। বেসামরিক হাসপাতালগুলোতে দুর্নীতি পুলিশের দুর্নীতির সাথে পাল্লা দিতে পারবে। এতসব কিছুর ভেতর বাংলাদেশের বর্তমান সরকারকে আর যাই হোক অনভিজ্ঞ বলা যাবে না। পরপর তিন মেয়াদে আসীন এ সরকার রাষ্ট্রের সবলতা ও দুর্বলতার জায়গাগুলো সম্যক অবগত থাকবার কথা। একটি সেনাবাহিনীকে দিয়ে যদি হাতির ঝিল নির্মাণ করা যায়, তাদের দিয়ে করোনা ভাইরাস ব্যবস্থাপনাও করানো যায়।

এখানে সেনাবাহিনীর দুর্বলতাও মনে রাখা দরকার। ঢাকাতে নিকট অতিতে ঘটে যাওয়া সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর সদর দফতরের পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল ধাপে ধাপে অব্যবস্থাপনা এবং আইনরক্ষী বাহিনীতে মৌলবাদীদের অনুপ্রবেশের ফলে। সেনাবাহিনীর দায়িত্ব জনগণকে সহযোগিতা, জনগণের প্রতিরক্ষা ও জনগণের সংবিধান সংবিধান রক্ষা। একই দায়িত্ব নির্বাচিত প্রতিনিধিদেরও। কিন্তু অপশাসনের ধারাবাহিকতায় রক্ষক হয়ে ওঠে ভক্ষক। জনগণকে যেরকম সেনা নিবাসে ঢুকবার সময় বারবার পরিচয় দিতে হয়, পরিচয় দেবার পরও জনগণকে যেরকম মিলিটারি পুলিশের মর্জি মাফিক ঘুরিয়ে দেয়া যায়, হ্যানস্তা করা যায়, করোনা ভাইরাসকে পরিচয় জিজ্ঞেস করে আটকানো যাবে না। বাংলাদেশ এই মারণ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে, সেনাবাহিনীও আক্রান্ত হবে। এরপর জাতিসংঘও বলে বসতে পারে, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে অনির্ণিত ভাইরাস সংক্রমণের সম্ভাবনার কারণে আন্তর্জাতিক নিয়োগ কমিয়ে দেয়া হচ্ছে। শুধুমাত্র সে বিপুল লাভজনক নিয়োগের কথা ভেবে সেনাবাহিনী দেশি বা নেটিভদের সহায়তা করবে, এটাও স্বস্তিদায়ক চিন্তা নয়। সেটা পাবলিক রিলেশান, সেবা ও সুরক্ষা নয়।

জাতীয় স্বাস্থ্যের সাথে জাতীয় শিক্ষা জড়িত। ফ্রান্সের যে উপকূলবর্তী শহরে থাকি, সেখানে ২৭ হাজার লোকের ভেতর সাত হাজার সেনার একটি গ্যারিসন আছে। ফ্রান্সের একটি আণবিক ডুবোজাহাজের ঘাঁটিও এ অঞ্চলে। দশ বছরে আমাকে একবারও কোথাও থামানো হয় নাই। বাজার সওদা করবার সময়, ছেলেকে স্কুলে পৌঁছানোর সময় কখনোই বুঝি নাই, কে সামরিক কে বেসামরিক। মৌলিক অধিকারে, মৌলিক সুবিধা প্রাপ্তিতে সামরিক, বেসামরিকের বৈষম্য না করবার প্রবর্তনাতেই ফ্রান্সের সংবিধানের শেকড়। লক ডাউনের পর অনলাইনে ফরাসি শিক্ষা কর্তৃপক্ষ সবার জন্য একই সুবিধা বিতরণ করছে। বাংলাদেশের ৭২এর সংবিধানও রাষ্ট্রের সব নাগরিককে সমান অধিকার দিয়েছিল। আমরা করোনা ভাইরাসে ততটাই আক্রান্ত হবো, যতটা ৭২ এর সংবিধান থেকে সরে যাব।

ফরাসি রঙ্গ
মৌসুম বদলাচ্ছে। শীত শেষে সাগর পারে ফুল ঝলমল বসন্ত আসি আসি। সকাল হলেই সব জানালা হাট করে খুলে দেই। এ সময় রেণুর ওড়াওড়িতে আমার হাঁচি, কাঁশি বেড়ে যায়। দমক প্রবল হলে হিস্টামিন খাই, তা কাজে দেয়। এবার অবশ্য দমক আসলে বুঝতে একটু অসুবিধা হবে। বুঝি আর না বুঝি, করোনা আক্রান্ত হলে ১৪ দিন স্বেচ্ছা কোয়ারেন্টাইন। প্রাথমিক চিকিৎসকের কাছে যাওয়া যাবে না। বিশেষ নাম্বারে ফোন দিতে হবে। এটা মেনে নেব। এদেশের নদী, সাগর, পাহাড় আমাকে ও আমার সন্তানকে লালন করেছে। ১৪ দিন নিজেকে আটকে রাখতে পারবো না? ডরাইলে ডর, না ডরাইলে ডর নাই।

১৮.৩.২০২০ ব্রিটানি, ফ্রান্স