বিচিত্র

মারিয়া সালাম

প্রকাশিত : মে ১৭, ২০১৯

ভ্রমণ মানেই বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা। আর বাঙালি হলে কথাই নাই, সবকিছুতেই মজার উপাদান খুঁজে পাই আমরা। সাধারণ লোকালবাসে উঠলেও এত ঘটনা ঘটে যায়, জ্যাম, গরম এসব আমাদের গায়েই লাগে না। বিমান ভ্রমণও কিন্তু সেরকমই মজার।

ঢাকা থেকে রওনা দেব দোহার উদ্দেশে, দাঁড়িয়ে আছি ৯ নম্বর গেটের সামনে, গেট খোলেনি তখনও। লোকজন একদম নেই। একেবারে সামনে একজন বোরখা পরিহিতা ভদ্রমহিলা, সম্ভবত কাতারে গৃহকর্মীর কাজ করেন। তার পেছনে এক বিদেশি ভদ্রলোক দাঁড়িয়েছে বাঁকা করে, যেন সে এসব লাইনের তোয়াক্কা করে না। আমি গিয়ে মনে হলো যেহেতু সেই ভদ্রমহিলাটি একদম গেটের সামনে ঠিক জায়গায় দাঁড়িয়েছে, আমারও তার পেছনেই দাঁড়ানো উচিত। কিছুক্ষণ পরে আসলেন একজন সুদানি ভদ্রমহিলা, উনিও আমার পেছনেই দাঁড়ালেন।

এরপর আসলেন সাদা চুলওয়ালা এক বৃদ্ধ ভদ্রলোক, দামি পোশাক, একদম পরিপাটি। শুদ্ধ ইংরেজিতে সেই বিদেশি ভদ্রলোকের সাথে হাই হ্যালো নানারকম আলাপ জুড়ে দিলেন, দাঁড়িয়ে গেলেন তার পেছনেই। এরপরে যেই আসল, সেই ওই বিদেশির পিছে দাঁড়িয়ে গেল। গেট খোলা হলো, দ্বায়িত্বরত লোকজন বলল, তাদের লাইন বাঁকা, সঠিক লাইনে দাঁড়াতে হবে তাদের। বলা মাত্রই আমাকে ঠেলেঠুলে তিনজন লোক আমার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল, আর ওই চুলপাকা কাকু দাঁড়ালেন আমার পিছে। বারবার মাথা ঘুরিয়ে দেখতে থাকলেন, তার টার্গেট কোথায় দাঁড়িয়েছে, সে দাঁড়িয়েছে বেশ পিছে। এতে কাকু বিশেষ বিরক্ত হয়ে উঠলেন বলে মনে হলো, খুব রেগে রেগে ইংরেজিতে বলতে থাকলেন, এখানে কেউ নিয়ম মানে না, সামনের মহিলাগুলা ঠিক নিয়মে দাঁড়ালে তাকে এত পিছে দাঁড়াতে হতো না, ইত্যাদি।

যাই হোক, সবাই হুড়মুড়িয়ে প্লেনে উঠলাম। প্রায় আধাঘণ্টাব্যাপী সবার ব্যাগপত্র জায়গামতো রাখার প্রতিযোগিতা শুরু হলো। আমার পাশে বসেছে এক ছোকড়ামতো লোক, খুব গম্ভীর। আমি হাসতেই মুখ ফিরিয়ে নিল। আমি বললাম, আপনি কোথায় যাচ্ছেন, তার উত্তর ইতালি। আমি বললাম, বাহ সুন্দর জায়গা। সে বলল, আপনি? আমি বললাম, সুইডেন, সে বলল, প্রথমবার? আমি এমন একটা হাসি দিলাম, তারমানে হ্যাঁ বা না যেকোনো কিছুই হতে পারে। তাকে বললাম, নাম কি? সে উদাস ভঙ্গিতে হেডফোন কানে দিয়ে মুভি দেখা শুরু করল। এই পাঁচ ঘণ্টায় আমাদের আর কথা হলো না।

খাবার পরে আমার এক সিট সামনের আংকেল একটা পাতলা প্লাস্টিকের কাভারের সুঁচালো দিক দিয়ে ক্রমাগত দাঁত খোঁচাতে লাগলেন। মাঝে মাঝে আবার পুরো কব্জি মুখের মধ্যে ঢুকিয়ে কি যেন বের করার চেষ্টা করতে থাকলেন। আমার কেমন গা গুলিয়ে যেতে লাগল, আমি চোখ বন্ধ করে বসে থাকলাম। ঘুমটা গাঢ় হতেই, একটা হৈচৈ শুরু হলো, উঠে চোখ কচলে দেখি, একেবারে সামনের সিটে এক বাংলাদেশি আর আরেক আফ্রিকান মায়ের মধ্যে তুমুল ঝগড়া। বিষয়বস্তু বোঝা গেল না, খালি দুজন দুজনকে ‘ইউ স্টুপিড, ইউ স্টুপিড’ করতে থাকল। এভাবেই দোহাতে নামলাম।

আমার এক কলিগ বলেছিলেন, দোহাতে ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশন অফিসাররা বাংলাদেশিদের সাথে বাজে ব্যবহার করে, আমি যেন মাথা গরম না করি। আমাকে জেরা করছে এক আফ্রিকান অফিসার, বেশ গম্ভীর।
সো তুমি সুইডেন যাচ্ছ?
হ্যাঁ।
কেন যাচ্ছ?
একটা কনফারেন্সে।
ওখানে, মানে কনফারেন্সে কি হবে?
আমি না গেলে কিভাবে জানবো কি হবে?
সে সরু চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, যেতে পারো।

পরের ফ্লাইটে আমার সাথে উঠলেন এক সুইডিশ দাদু। বেশ মজার। খুব সুন্দর করে হেসে বললেন, তুমি কোথা থেকে এসেছ?
বাংলাদেশ।
আই সি, ইস্ট পাকিস্থান।
আমার মাথা খুব গরম হয়ে গেল। আমি বললাম, আপডেট ইয়োরসেলফ। প্রায় ৫০ বছর হতে চলছে, আমরা স্বাধীন দেশ।
আসলে আমি ৭০ সালের আগে করাচীতে চাকরি করতাম, তাই বলছি, তুমি কিছু মনে করো না, এমনিতে আমি তোমার অনুভূতিতে আঘাত করতে চাইনি। আমি তোমাদের ইচ্ছাকে সম্মান করি।
এরপরে উনি নানা আলাপ জুড়ে দিলেন। অনেক ভালো ভালো কথা, বেশ ভালো লাগছিল, কিন্তু কখন ঘুমিয়ে গেছি বুঝতে পারিনি। চোখ খুলে দেখি, উনি একটু মনমড়া হয়ে বসে আছে, বাজে ভোর পাঁচটা। আমি হাসিহাসি মুখে বললাম, শুভ সকাল। তার তেমন রেসপন্স নাই, আমি ঘুমিয়ে যাওয়ায় বেশ রেগেছেন।

কিছুক্ষণ পরেই আবার বিপুল উৎসাহে শুরু করলেন, তরুণদের মধ্যে প্রাণশক্তির দারুণ অভাব। তারা ভার্চুয়াল জগতের মায়ায় চলে গেছে, সে এই আশি বছরেও প্রতিদিন সার্ফিং করে, মানুষকে জানতে চায়, কিন্তু, তরুণরা বিমুখী, ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি সব হজম করে গেলাম। পরে জেদ ধরলেন, আমাকে উনার বাড়িতে যেতে হবে, সেটা শহরের বাইরে সুন্দর একটা জায়গা। তার স্ত্রী সেখানে খুব সুন্দর বাগান করেছে, আমাকে সেসব দেখাতে চায়। আমি ব্যস্ততার কথা বলে আপাতত রক্ষা পেলাম। বিমান সুইডেনে পৌঁছাতেই উনি ভিড়ে মিশে গেলেন।

গত দুইদিন খুব ব্যস্ততার মধ্যে গেল, আজ সকালে একটু রিলাক্স মুডে বের হলাম, শুক্রবার বলে কথা। সকালের খাবার খাচ্ছি এক রেস্টুরেন্টে। হঠাৎ শুনি, রাধে...রাধে!

খাবারের প্লেট থেকে মুখ তুলতেই দেখি সামনের টেবিলে দুই মাঝবয়সী লোক, আমাকে দেখে রাধে রাধে বলে চিৎকার করছে, আর আকাশের দিকে হাত তুলে মন্দিরের ঘণ্টা বাজানোর ভান করে হাসছে। আমাকে ইন্ডিয়ান ভেবে বুলিং করছে বুঝলাম। জানি না, হিজাব বা বোরকা পরলে কি করত এরা। যাই হোক, আমি তাদের সামনে গিয়ে নামাস্তে বলে লম্বা একটা প্রণাম ঠুকে বের হয়ে আসলাম।

লেখক: গল্পকার ও সংবাদকর্মী