বিচ্ছিন্ন ও একাকী মানুষের নিজেকে খোঁড়াখুঁড়ির গল্প

সেরীন ফেরদৌস

প্রকাশিত : এপ্রিল ২৮, ২০২০

প্রায় বছর দুয়েক আগে মাহবুব মোর্শেদের ‘তোমারে চিনিনা আমি’ উপন্যাসটি হাতে আসে। প্রায় সাথে সাথেই দুর্ভাগ্যবশত সেটি হাতছাড়া হয়ে যায়। অনেক চেষ্টা করেও আর ফেরত পাইনি। এবছর তাই আবারও বইটি হাতে আসার পয়লা দফাতেই পড়ার কাজটি চুকিয়ে ফেলি। বহুবছর পরে একটা গোটা বাংলা উপন্যাস পড় হলো, তাও আবার অপেক্ষাকৃত একজন তরুণ লেখকের। গতবারই উপন্যাসটি দেখার পর নামটা মাথায় লটকে ছিল, বেশ কিছুদিন মাথার ভেতর ঘুরপাকও খেয়েছে। বই হারিয়ে গেছে, নামটা রয়ে গেছে, তোমারে চিনি না আমি! কে এই তুমি আর কে এই আমি! কে কাকে চেনে না, কিভাবে চেনে না, কিভাবে চিনতে চেয়েছিল কে জানে! এত চেনাচিনির পরও চিনতে পেরেছে কি?

করোনা-বিষয়ক চক্করের ভেতরে উপন্যাসটি হাতে আসায় পড়া শেষ করতে সময় লেগেছে, একটানা পড়তেও পারিনি। এরপরও থেমে থেমে পড়ার বাদবাকি কারণটি ঠিক কলেবরও নয়, তার চেয়েও বেশি কিছু। উপন্যাসের বিষয়বস্তু ও গল্প বলার চেষ্টাটি অন্যরকম! চিন্তায় খানিকটা হোঁচটও খেলাম মনে হলো! ভাববার চেষ্টা করেছি, কেন এমন হলো! একমনে মনে হয়েছে, হোঁচট খাওয়ার বিষয়টা ঘটেছে বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে দীর্ঘদিনের ব্যক্তিগত দূরত্বের কারণে। অনভ্যাসের কারণে। আবার মনে হলো, এটা ঘটেছে বাংলা সাহিত্যের পুরোনো-পরিচিত গতানুগতিক ধাঁচের বাইরে উপন্যাসটি সজোরে ছিটকে এসেছে বলে। আর সবশেষে তৃতীয় অনুভূতিটি হলো, দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকার সুবাদে আমি সত্যি সত্যিই ১৫-২০ বছরের বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা ও তরুণ প্রজন্মের অভিজ্ঞতাকে পুরোপুরি মিস করে গেছি। মৃদু বিস্ময়ে বলেছি, তোমাদেরকেও চিনি না আমি!

স্যামুয়েল বেকেটের ’ওয়েটিং ফর গডো’ নাটকটি পাক্কা ৩০-৩২ বছর আগে পড়েছি। এবং খুব ভুল না হলে ভারতের নাসিরুদ্দিন শাহ’র অভিনয় ঢাকার মঞ্চে দেখেছি তাও বছর ২৫-এর বেশি।  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপরই যুদ্ধবিধ্বস্ত ক্ষয়িষ্ণু বিশ্বের পটভূমিতে লেখা হয়েছিল নাটকটি। পৃথিবীর মানুষ শকড, হতাশ! অর্থহীন লাগছে জীবনযাপন আর জীবনের মানে। মানুষের যাবার কোনো জায়গা নেই, পারস্পরিক কথাবার্তার কোনো মানে নেই, কারো সাথে কারো মিনিংফুল সর্ম্পক নেই, জীবনের কোনো লক্ষ্য নেই, চাওয়া নেই! নাটকের প্রধান চরিত্র দুটো শুধু কোনো এক ’গডো’র প্রতীক্ষা করে আর ক্রমাগত কথা বলে চলে! র্অথহীন, দ্ব্যার্থবোধক, পুনরাবৃত্তিমূলক, নিজ অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দিহান, প্রগলভ আর হতাশার চূড়ান্ত সব শব্দ আর পঙক্তি— যেগুলো জোড়া দিলে কোনো অর্থবহ বাক্য তৈরি হয় না। তারা যান না বা যাবেন না কোথাও, অথচ বারবারই নড়েচড়ে বসছেন ’কেউ আসবার’ অপেক্ষায়। যিনি হয়তো মুক্তি দিতে পারবেন এই দুঃসহ অপেক্ষা থেকে!

কী অপেক্ষা, কিসের অপেক্ষা, কতক্ষণ অপেক্ষা— তা স্পষ্ট হয় না। কিন্তু সর্ম্পূণ অপেক্ষাটি ধীরে ধীরে পাঠকের শ্বাসনালি পেঁচিয়ে ধরতে থাকে এবং একসময় দম বন্ধ হয়ে আসতে থাকে। ‘তোমারে চিনি না আমি’ শেষ করার পরও মাথায় ঠেসে বসে থাকে প্রায় কাছাকাছি এরকম একগাদা চিন্তা আর জট। কী কাণ্ড, কোথায় আটকে গেল বলটি! গড়ানোরই কথা ছিল! কী আর্শ্চয, গড়ালো না শেষ পর্যন্ত! উপন্যাসটি শেষ করার পর এই ধরনের হাঁসফাঁস একটা ব্যাপার তৈরি হয়েছিল, বলতেই হবে।

প্রত্যেক লেখক নিশ্চয়ই সমাজের ভেতরে থেকেই সমাজের গল্প লেখে। এমনকি না-সমাজের গল্পও লেখে সে সমাজের ভেতরে বসে। সমাজ, ভ্যালুজ, রীতিনীতি আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবাহিত হয় বলে বেশিরভাগ সময়ই সামাজিক বাস্তবতা ’ঠিকই থাকা’ বাস্তবতা, ’স্বাভাবিক’ বাস্তবতা হিসেবে গ্রহণ করি আমরা। সমাজের অলিগলি, কোণা-খাঁজকে ক্রিটিক্যালি দেখার চোখটি সকলের সহজে গড়েও ওঠে না। সমাজের সাথে নিজের সম্পর্ককে ছাপিয়ে ক্রিটিক্যাল উপন্যাসের নির্মাণ তাই শ্রমসাধ্য ও চ্যালেঞ্জিং। বিশেষ করে স্ব স্ব সময়ের সমাজকে আঁকতে গেলে লেখকের উপর চাপ তৈরি হয়। ব্যক্তি নিজেও সেই সময়ের প্রডাক্ট বলেই হয়তোবা! কোনো না কোনোভাবে লেখকও ঝুঁকির ভেতর থাকবে। কারণ উপন্যাসের চরিত্র থেকে নিজেকে আড়াল করা তখন কঠিন হয়ে পরে। আরো ঝামেলা আছে, চলতি সময়টাকে দূর থেকে নেড়েচেড়ে দেখাও যায় না! চলমান সময়ের গল্প অনেকটা থিয়েটারের মতো, যা বলবার, যা ঘটবার— এখনই ঘটছে, এখনই বলা হচ্ছে!

মাহবুবের নিজের বয়স এবং উপন্যাসের চরিত্র, সময়, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, সামাজিক আবহ, সম্পর্কের ধরণ ইত্যাদি বিবেচনায় নিলে দেখা যাবে, তিনি চলতি সময়ের গল্প বলার এই ঝুঁকিটা নিয়েছেন। গল্পটা তিনি এইভাবে না-বলে পারছিলেন না হয়তো। অথবা কে জানে, নিজেরও মুখোমুখি হওয়াও হয়তো বড্ড দরকার ছিল সেসময়ে তার। তাতে ব্যক্তি লেখকের হাত থেকে উপন্যাসের চরিত্রের বারবার ছুটে যাওয়ারও অবশ্যম্ভাবী ভয় থাকে। সেটা এই উপন্যাসেও মাঝে মাঝে গেছে, টের পাওয়া যায়। মানে, ব্যক্তি লেখকও মাঝেসাঝে এদিক-ওদিক উঁকিঝুঁকি মেরে উপন্যাসে টুক করে ঢুকে পড়েছেন। তাতে ক্ষয়ক্ষতি হয়নি, উপন্যাসের মসৃণ গড়িয়ে চলাও থেমে থাকেনি, বরং লেখকের মানসিক-সামাজিক ছায়াটা উপন্যাসের ওপর আরো একপ্রস্থ গাঢ় রঙ চড়িয়ে গেছে বলা চলে।

একটি মোটামুটি বন্ধ্যা ও স্থবির সময়ের বৃত্তের ভেতরে উপন্যাসের প্রধান চরিত্র রানার গল্প এগিয়ে গেছে। একজন নিঃসঙ্গ, একাকী মানুষ। পরিবারের সাথে তেমন কোনো গুণগত বন্ধন নাই, বন্ধুদের সাথে নাই, প্রেমের সাথে নাই, চাকরির সাথে নাই, স্ত্রীর সাথে নাই, তার গভীর-গোপন সত্তা কবিতার সাথেও নাই। শুধু তাই নয়, বেদনার সাথে প্রত্যক্ষ করা লাগে, তার বেসিক আইডেন্টিটি ’সেল্ফ’ বা নিজস্ব সত্তার সাথেও নাই। উপন্যাসের শুরু ও শেষ— উভয়ই ঘটে রানার নিজের সাথে নিজেরই কথোপকথন দিয়ে। আত্মকেন্দ্রিক এ মানুষটির যেসব জায়গায় জবাবদিহিতার বা দায়িত্ব নেবার দরকার ছিল, ঘটনাক্রমে সেগুলো থেকেই সে পালিয়ে এসেছে বারবার। কবিতার আড়ালে একপ্রকার নিজেকে লুকিয়ে রাখার দীর্ঘদিনের চেষ্টাও সফল হয়নি, কবিতার বর তার ভাগ্যে জোটেনি। স্ত্রী নাজনীন জানেও না, একদা কবিতাই ছিল রানার জীবনে। সবচেয়ে বড় কথা, নিজেকেই যে সে কোথাও খুঁজে পাচ্ছে না, এই তথ্যটুকু জানতে তার আরো কিছু বছর খরচ করতে হয়েছে জীবন থেকে। ততক্ষণে সে যথারীতি আরেকটি বলয়ের ভেতরে আবদ্ধ এবং সেটার ভেতরেও ছটফট করছে।

বোঝা যাচ্ছে না, এইবেলাও সে ঠিকভাবে নিজেকে চিনতে পারছে কিনা! যৌনতার আর কবিতার প্রতিটি অলিগলি আবিষ্কার করতে যাওয়া এতদিনের মুচমুচে তরুণটি যেন হঠাৎই মুখ থুবড়ে পড়লো স্ত্রী নাজনীনের সঙ্গে জীবনযাপনের অংশটিতে। মামুলি এক কেঁচো-কেরানির জীবনকে মেনে নেয় তার বিবাহিত জীবন। এ নিয়েও তার কোনো আয়-ব্যয় নেই, ক্ষোভ নেই, উদ্দীপনা নেই, আগ্রহ নেই, এমনকি মুখে কোনো রা-ও নেই। যেন-বা তার অস্তিত্বসংকট ব্যাপারটাই একমাত্র অস্তিত্ব উপন্যাসজুড়ে। আর এ থেকে তার কোনো মুক্তি নেই। মাহবুবও কোনো লণ্ঠনও ধরেননি তার সামনে, খাঁচার দরজাটায় বরং ছিটকিনিই তোলা রইলো।

তারুণ্যের সবচেয়ে গনগনে সময়টিতে রানা শরীর আর হৃদয় দিয়ে চিনে নিতে চেয়েছে নারী ও কবিতাকে। তার সামনে নতুন নারী এসে দাঁড়ানো মানেই রহস্যে ঘেরা আনকোরা এক জগৎ ও নতুন সম্ভাবনা— নতুন যৌনতা ও নতুন কবিতার উৎস। যে-কোনো নারীকেই তুমুল-আবিষ্কারের আনন্দের নেশা। সে নেশাকে পুঁজি করে নতুন নতুন কবিতার জন্ম দেয়ার তাড়না রানাকে পেয়ে বসে। কবিতা লেখার শক্তিকে অনুপ্রাণিত ও বিকশিত করতে মেধা, পরিশ্রম ও চর্চার চাইতে প্রেমকেই বেশি কার্যকর বলে মনে হতে থাকে। জীবনে একের পর এক নারীর উদ্বোধন ও কামনার নানা শাখায় বিচরণের শিহরণ রানাকে পেয়ে বসে যেন। এই পুনরাবৃত্তিমূলক নির্দিষ্ট মানসিক অবস্থার একটি ডাক্তারি নাম আছে— ‘অবসেসিভ-কমপালসিভ ডিসর্অডার’। বারবারই একই চক্রে ঘুরপাক খাওয়া। কমিটমেন্টবিহীন শরীরের এই সর্ম্পকগুলো ছোট স্কেলে তাকে উদ্দীপনা জোগালেও জীবনের দীর্ঘ যাত্রায় সেগুলোর স্মৃতি তাকে বিড়ম্বিত করে তোলে। রানার নিজেরও পেছনে তাকিয়ে অসঙ্গতিটি ধরতে ধরতে ততদিনে জীবন গড়িয়ে গেছে সংসারের হলুদ মাঠে।

সে কোনোকিছু থেকে পালাতে চেয়েছে কিনা, উপন্যাসে তা পষ্ট নয়। নাকি শৈশবের ভালোলাগা নুরুন্নাহারকেই নানাভাবে খুঁজেছে জীবনভর, যে নুরুন্নাহারকে পূর্ণভাবে আবিষ্কার করা হয়ে ওঠেনি, অথচ বাসনা ছিল; আর কোনোদিন হবেও না। প্রবল যৌনতাড়িত যে যুবকটি তারুণ্যের তুমুল সময়টাতে ভালোবাসা অথবা প্রেমের একটা যুতসই সংজ্ঞা উপলব্ধি করতে গিয়ে হন্যে হয়ে ঘুরেছে শরীর থেকে শরীরে, একটি ভালো কবিতার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে, ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে উত্তরবঙ্গের ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে লড়াকু ভূমিকায় নেমে পড়েছে, সে-ই সংসারে কি করে একেবারেই নির্জীব আর নিষ্ফলা হয়ে যায়! নাজনীনের সাথে তার সংসারের চিত্রটি একঘেঁয়ে, উদ্দীপনাবিহীন সমান্তরাল। পুরো উপন্যাসে একমাত্র নাজনীনের শরীর নিয়েই তার একঘেঁয়ে উচ্ছ্বাস আর আবিষ্কারের ঘটাটি দেখতে পাওয়া যায় না। এও এক বিড়ম্বনা বটে। নাজনীন জানেই না, রানা একদা কবিতা লিখতো। সেই যেন বেকেটের দুই চরিত্র। এই প্রবল বৈপরীত্যের কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। যদিও শেষ পর্যন্ত কবি হতে না-পারার হতাশাটা বেশ খানিকটা বোঝা যায়। বহু বহু দিন পরে নুরুন্নাহারের ফোন পেয়ে নিজেকে শুধাতে বসে, কে আমি, কি আমি! কোথায় আছি, কোথায় যেতে চাই, কি বুঝতে চাই! আমার নিকট ও দূর গন্তব্য কি! আমি কাদের চেনা, কে আমাকে চেনে! আমার দুঃখ কি, না-পাওয়া কি! কি হয়নি, কি হতে পারা যেত, মুক্তি কোথায়, কোন পথে! একজন সামাজিক মানুষ নানারকম দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে যায়। জটিল প্রাণী হিসেবে ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির দ্বন্দ্ব, ব্যক্তির সাথে সমাজের, ব্যক্তির সাথে রাষ্ট্রের, এমনকি ব্যক্তির সাথে মহাজাগতিক দ্বন্দ্বেরও ব্যাপার থাকতে পারে। মাহবুবের এ উপন্যাসে ব্যক্তির নিজের সাথে নিজের অর্থাৎ ’সেল্ফ কনফ্লিক্ট’ এর ব্যাপারটা বড্ড প্রাণে বাজে।

ইংরেজিতে একটি শব্দ আছে, জাক্সটাপজিশন। অর্থ হলো, পারস্পরিক বিপরীতধর্মী ফলাফল বা মতবাদ, অবস্থান বা পার্থক্য। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র দুটি— সরদার এবং রানা, আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, দুজনের অবস্থান অনেকটা জাক্সটাপজিশন। কিন্তু উপন্যাসে দুজনের সম্পর্কের শুরু থেকেই চরিত্র দুটির ভেতর মিল চোখে পড়ে বেশ। কখনো কখনো মনে হয়েছে, একটি আরেকটির ক্লোন অথবা রানার অল্টার ইগো। মানে রানারই যেন আরেকটি ভার্সান। দু’একবার মনে হলো, রানা চরিত্রটিকে সার্পোট দেবার খাতিরেই সরদার উদয় হয়েছে পটভূমিতে। উপরে উপরে দুজনের কিছু পার্থক্য দেখা গেলেও সরদার ও রানা পরস্পরের সম্পূরক। রানা যেখানে যেখানে আটকে যাচ্ছে, ঠিক সেইখানে সেইখানে সরদার এসে হাল ধরছে আর গাইড করছে। শৈশব থেকেই নিজের যে-কোনো কনফ্লিক্ট ঠিকঠাকমতো ডিল করতে না-পারা রানাকে বারবার ছুটে যেতে হচ্ছে সরদারের কাছে।

খুব সাদামাটাভাবে বিষয়টি চোখে পড়ে না প্রথম প্রথম। কিন্তু যতই বল গড়াতে থাকে, দুজনের মিলগুলো চোখে পড়তে থাকে। বয়স, পেশা, অর্থনৈতিক অবস্থা, যৌনতা উপভোগের ধরন, লালন-সাধনা, কবিতার শক্তিকে বিপ্লব হিসেবে ব্যবহারের স্থান-কাল বিষয়ক ভাবনা ইত্যাদিতে দুজন আলাদা। এরপরও ভেতরের বুঝ-ব্যবস্থায় দুজনকে একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ বলে ভ্রম হতে পারে। সরদার বারবারই রানাকে ইন্ধন জুগিয়েছে, রানার চলার রাস্তাটা মসৃণ রাখার চেষ্টা করেছে, রানার প্রেমের তীব্র আকাঙ্ক্ষার আগুনে ঘি ঢেলেছে, সহযোগিতা করেছে, তাকে বদ্ধকূপ থেকে বারবার টেনে টেনে তোলার চেষ্টাও করেছে। এই চোরা-চিকন মিলের জায়গাটা যতটা না প্রমাণসাপেক্ষ, তার চাইতে বেশি অনুভবের। তলে তলে দুজনই কি শেষমেষ চলতি সমাজব্যবস্থার নিংড়ানো ছিবড়া নয়? কী অভিন্ন মিলে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দুজনই কবিতাকে আঁকড়ে ধরতে চেয়েছে জীবন ও সমাজব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটাবে বলে। কবিতাই অন্তঃসলিলা হয়ে কাছাকাছি নিয়ে আসে দুজনকে একজন তারুণ্যে মাত্র পা দিয়েছে আর অন্যজনের তারুণ্য বিদায় নেবে নেবে বয়সে। যৌনতার অবদমনও দুজনের প্রায় সমানে সমান এবং ’মুক্তি’র রাস্তাও কিছুদূর গিয়েই ঝাপসাপ্রায়! দু’জনেরই দুজনের কাছে নিজ নিজ নিভৃত জীবনটির উন্মোচন ঘটিয়েছে অবলীলায়। আর কবিতা ও প্রেম বিষয়ক প্রবল বাহাসকে তো প্রায়ই ধ্বনি এবং প্রতিধ্বনি বলেই মনে হয়েছে। রানা এবং সরদার একটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের যুৎসই স্যাম্পল। চকিতে কখনও এও মনে এসেছে, তাহলে কি সরদারের সাথে যোগাযোগহীনতাই রানার নিষ্ক্রিয় ও হতাশ জীবনের শুরু! নাকি কমিটমেন্টবিহীন নারী শরীরের এই সম্পর্কগুলো ছোট স্কেলে তাকে উদ্দীপনা জোগালেও জীবনের দীর্ঘ যাত্রায় সেগুলোর স্মৃতি তাকে বিড়ম্বিত করে তুলেছে। নিজের আইডেন্টিটি বিষয়ে পুরো সময়টা দ্বন্দ্বের ভেতরেই কাটিয়ে দেয়া রানা হয়তো সরদারের মৃত্যুতে এই বিষয়গুলো ঠিকঠাকমতো উপলব্ধি করতে পারে। তবে সরদার, কামরুজ্জামান ইনাদের সংবাদপত্রের মাধ্যমে মৃত্যু না হলেও চলতো। জীবিতের পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা মৃতের বিচ্ছিন্নতা থেকে অনেক তীব্র।

উপন্যাসের নারী চরিত্রগুলো একধরনের অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে আমাকে। তারা প্রত্যেকেই একেকজন সেক্স-অবজেক্ট। না, যৌন-সম্পর্কগুলো খোলামেলাভাবে প্রকাশের কারণে ততটা নয়, যতটা তরুণ বয়সী নারী-পুরুষের ভেতরের অন্যান্য প্রবল সম্ভাবনা, শক্তি ও সংকটগুলো যৌনতার চেয়ে ছাপিয়ে উঠতে পারলো না বলে! আগাগোড়া যৌন-তাড়নাটিই বীরবিক্রমে উপন্যাসকে শাসন করে গেল, অথচ রানা বা সরদারের কেউই শরীরের প্রচলিত উপভোগের বাইরে নারীর সাথে অথবা নারী শরীরের সাথে সম্পর্কের আর কোনো নতুন ডাইমেনশনে যাবার মতো পরিপক্কতা দেখাতে পারলো না। একটি যৌন-অবদমিত সমাজের মামুলি প্রতিনিধিই থেকে গেল সকলে এবং পরিণতিও মোটামুটি মামুলি। এইখানে এসে খানিকটা থামতে হয়। আর আরো একবার সামাজিক জায়গাটা পরখ করবার দরকার পড়ে। প্রশ্ন জাগে, শহুরে মধ্যবিত্ত নারীর সামাজিক-শারীরিক ট্যাবু কি সত্যি সত্যি এতটা নাজুক হয়ে আছে? মনের ভেতর খচখচ করতে থাকে, প্রেমের থেকে শরীরকে বিচ্যুত না-রাখার এই কঠিন অথবা সরল মানসিক রাস্তায় কি তবে মেয়েরা এরই মধ্যে নেমে পড়েছে যার খোঁজ জানা নেই আমার! নাকি প্রকাশ্য মেলামেশা-বিনোদনে অপারগ, অবদমিত সমাজের ভিক্টিমরা সব এইভাবে শরীরে এসে ভিড় করে! নাকি আপাত উপরিতলের ধর্মীয়-সামাজিক-রাজনৈতিক মূল্যবোধের চাদরে ক্ষয় ধরে ধরে তলে তলে নিঃস্ব হয়ে গেছে একটি প্রজন্মের বিনোদন আর ক্রিয়েটিভিটির আনন্দ! আর কি কোথাও যাবার জায়গা নেই? সমাজটা কি এইভাবে শ্বাসরোধ করে রেখেছে এদের?

উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রই যেন একেকটি অপচয়, সকলেই কোনো না কোানোভাবে ব্যক্তি-সংকটের দ্বন্দ্বে ভুগছে। যেন সমাজের উপরিতলের চাদরটি সরালেই নিচের দগদগে ঘা’টি পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। স্থবির সময়ে নিজেকে খোঁড়াখুঁড়ির এই গল্পে শৈশবের রানা থেকে উপন্যাসের শেষ সময়ের রানা, শেষ পর্যন্ত একই মানুষ। একই রকম আত্ম-অনুসন্ধিৎসু, সিদ্ধান্তহীনতায় ভরপুর আর বৃত্তবন্দি। বস্তুত রানা কোথাও যায়নি, কিছুই ঘটেনি তার জীবনে, কোনো আত্মপরিভ্রমণের ভেতর দিয়ে রানা কোথাও পৌঁছায়ওনি। রানার জীবনে কোনো ‘ট্রান্সফরমেশন’ ঘটেনি, ঘটেনি কোনো গুণগত পরিবর্তন, যেখান থেকে দূর অতীতের রানাকে সে পৃথক করতে পারে। এখনও বুঝতে পারে না, প্রেম কী! শরীরের বিদ্যুৎ নাকি একত্রে পথচলা নাকি ব্যক্তির বিকাশের অনুপ্রেরণা! এই আত্মসংকটের আর কবে অবসান হবে! নিজেকেই চিনতে চিনতে বড্ড দেরি হয়ে যায় অথবা কোনোদিনই আর চেনা হয়ে ওঠে না। তাই উপন্যাসের নামকরণের ‘তুমি’টা প্রতিটি ব্যক্তি মানুষের ভেতরের না-চেনা ‘আমি’টাই হয়তোবা! রানাকে যে দুঃস্বপ্ন নিয়মিত তাড়া করে, তার জন্মদাতা কি রানা নিজেই নয়? তাহলে রানা যদি আতংকে ঘেমেনেয়ে ঘুম ভেঙে ওঠে, তবে নাজনীনের বেদনাও বুকে বড় বাজে?

 

আদর্শ প্রকাশনীর প্রকাশনায় ২০৮ পৃষ্ঠার উপন্যাসটির মূল্য ৩৮০ টাকা

একুশে বইমেলা ২০১৮