বিদেশ-বিভূঁই: দিল্লি-শ্রীনগর-চণ্ডিগড়

পর্ব ৪

খায়রুল এ. চৌধুরী

প্রকাশিত : অক্টোবর ২৭, ২০২২

আজকে শুধু শ্রীনগর ঘুরবো। চারটা মোগল বাগান আছে এখানে, সবগুলি কাছাকাছি, ডাল লেকের পাশে, যে জাবারওয়ান পর্বতের পাদদেশে গড়ে উঠেছে শ্রীনগর শহর, তার কোলেই মোগলরা তৈরি করেছে পৃথিবী বিখ্যাত এই স্বর্গীয় উদ্যানগুলি।

প্রথমে গেলাম শালিমার বাগ। সম্রাট জাহাংগীর ১৬১৯ সালে এ বাগানটি নির্মাণ করেছিলেন তার প্রিয়তমা বেগম নূর জাহানের জন্য। জাবারওয়ান পর্বতের পাদদেশে তৈরি বিশাল এ বাগান থেকে সামনে তাকালে ডাল লেকের নয়নাভিরাম দৃশ্য দেখা যায়। বাগানটি জাহাংগীর-নূর জাহানের খুব প্রিয় ছিল। প্রতি বছর গ্রীস্মে এখানে এসে থাকতো তারা।

বাগানটি মূলত চিনার গাছে সজ্জিত, একঘেঁয়েমি কাটাতেই হয়ত কিছু কিছু ম্যাগনোলিয়া আর সাইপ্রাস গাছও লাগানো হয়েছে এখানে। আর পুরো বাগান জুড়ে ফুটে আছে বড় বড় গোলাপ, ডালিয়া আর নাম না জানা অসংখ্য রঙিন ফুল।

তারপর গেলাম নিশাত বাগ। নূর জাহানের বাবা, সম্রাট শাহজাহানের শ্বশুর আসিফ খান বাগানটি নির্মাণ করেছিলেন ১৬৩৩ সালে। বাগানটি শাহজাহানের খুব পছন্দ হয়, তিনি আশা করেছিলেন আসিফ খান হয়তো এ বাগানটি তাকে উপহার দিবেন। কিন্তু আসিফ খান দেন নি এবং সম্রাট তাতে কুপিত হয়ে বাগানের পানি সরবরাহ বন্ধ করার নির্দেশ দেন।

এতে বাগানটি যখন মরতে বসে তখন বিমর্ষ আসিফ খান বাগানে গাছের ছায়ায় বসে যখন সাতপাঁচ ভাবছিলেন তখন হঠাৎ বাগানের ঝরনাগুলো সচল হতে দেখে জানলেন বাগানের এক কর্মচারি বাগান বাঁচাতে নিজেই পাশের শালিমার বাগ থেকে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করেছে। আসিফ খান ভয় পেলেও, অবস্থা দেখে শাহজাহান পুনরায় পানি সরবরাহ করার অনুমতি দিয়ে বাগানটিকে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করলেন।

আমার মতে কাশ্মিরে মোগলদের চারটি বাগানের মধ্যে এটিই সবচেয়ে সুন্দর। কারণগুলো হলো: বাগানটির আয়তনের অসাধারণ নান্দনিক পরিমিতি— খুব বড়ও না, আবার ছোটোও না, একটা স্বপ্নের বাগান যেমন হওয়া দরকার বাগানটি ঠিক সে রকম। এখানেও বাগানটি সাজানো হয়েছে কাশ্মিরীরের আত্মা চিনার, ম্যাগনোলিয়া, সাইপ্রাস এবং আরো কয়েকটি নাম না জানা গাছ দিয়ে।

তবে, শালিমারের মতো চিনার এখানোও প্রধান গাছ। শালিমার এবং নিশাত এ দুই বাগানেই চারশ বছর বয়সি বেশ কয়েকটি বিশাল চিনার গাছ আছে। বলা বাহুল্য, শালিমার বাগের নিকটবর্তী নিশাত বাগও তৈরি হয়েছে জাবারওয়ান পর্বতের পাদদেশে, আর বাগান থেকে সামনে তাকালে দেখা যায় ডাল লেকের অপূর্ব দৃশ্য।

পরবর্তি গন্তব্য চশমা শাহী। এ বাগানটি তৈরি করেছিলেন সম্রাট শাহজাহান, ১৬৩২ সালে। তবে, জাবারওয়ান পর্বতকে পিছনে রেখে নয়, এটি নির্মিত হয়েছে এর ওপরেই। ফলে, এখান থেকে শুধু ডাল লেকের সৌন্দর্যই নয়, দেখা যায় শ্রীনগর শহরের বিরাট একটা অংশও। প্রিন্স দারা শিকোর উপহার হিসাবে বাগানটি নির্মাণ করেছিলেন সম্রাট শাহজাহান।

সবশেষ বাগানটি হলো পরী মহল। ১৬৫০ দশকে দারা শিকো নির্মাণ করেছিলেন সাত স্তরের বাগানটি। নিশাত বাগের পর এ বাগনটিও আমাকে মুগ্ধ করেছে। এর সবচেয়ে বড় কারণ হলো, অনেক উপরের এ বাগান থেকে পুরো ডাল লেকটি খুব ভালো ভাবে দেখা যায়, বাগানটির স্থাপত্য কৌশল এমন যে, সাধারণ মানুষের কাছে মনে হবে বাগানটি নিখুঁত, যেন একটা স্বর্গের বাগান। বাগানটি দারা শিকো তার স্টাডি প্লেস হিসাবে ব্যবহার করতো। ভাবা যায়? মোগল রাজন্যদের মধ্যে দারা শিকোই মনে হয় প্রকৃত অর্থে সবচেয়ে জ্ঞানী ছিলেন।

আজকে হোটেল ছেড়ে বোট হাউজে উঠলাম বিকালে। ডাল লেকের বোট হাউজে থাকবো দুই দিন। ডাল লেকে ছৈঅলা এক রকম নৌকা আছে এগুলোতে চড়ে পর্যটকরা লেকে ঘুরতে বের হয় আর কিছু ভাসমান দোকান আছে তারাও ঘুরে ঘুরে চা-কফি, গয়না, ফ্রুট সালাদ এসব বিক্রি করে। এসব নৌকাগুলোকে শিকারা বলে। বিকালে বোট হাউসে উঠে ডাল লেকে শিকারায় চড়ে সূর্যাস্ত দেখলাম। অসাধারণ অভিজ্ঞতা হলো। কত রংবেরংয়ের মানুষ ঘুরে ফিরছে দুনিয়ায়! যতই মানুষ দেখি, যতই সংস্কৃতি দেখি, ততই নিজেকে হারাই বিচিত্র মেলায়। চলবে