বিনয় মজুমদার: কবিতার বোধিবৃক্ষ

পর্ব ১০

মলয় রায়চৌধুরী

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৯, ২০১৯

১৯৮২ সালে ‘কোনো গোপনতা নেই’ শীর্ষক সাক্ষাৎকারে ‘বাস্তব কবিতা বলে কিছু হয় কি?‘ প্রশ্নের উত্তরে বিনয় মজুমদার বলেছিলেন, “পুরোটাই— কবিতার প্রত্যেক শব্দ, প্রত্যেক বাক্য, বাস্তব জগৎ, বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে নেয়া।” ১৯৬৬ সালে ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ কাব্যগ্রন্থে তিনি লিখেছেন, একেবারে কাল্পনিক ভাবনা হলো চিন্তাশূন্য শূন্যস্থান, তার মানে মৃত:

সব মিলে একটিই বিশাল জীবন তবে ভূবক্ষে রয়েছে
আপাত দৃষ্টিতে দেখা যে-কোনো তথাকথিত একটি ব্যক্তিকে
বিশাল সমগ্র থেকে আলাদা করে নিলে হঠাৎ—
যদি কোনোদিন নিতে কোনোভাবে পারা যায় তবেই হঠাৎ
দেখা যাবে ব্যক্তিটির চিন্তা বলে কিছু নেই, মন তার শুধু
চিন্তাশূন্য শূন্যস্থান— একেবারে কাল্পনিক, তার মানে মৃত

অর্থাৎ পুরাণের কোনো মিথ থেকে তিনি চাকা ও গায়ত্রীকে এনেছেন বলে বিশ্বাস করা কঠিন। সুমন গুণও বলেছেন, “বিনয়ের ভাষ্য আক্ষরিক অর্থেই ব্যক্তিগত; নিজেকে কেন্দ্র করেই তাঁর বিস্তার।” ওই সাক্ষাৎকারে বিনয় বলেছিলেন, “আচ্ছা, কবিতা কি এমন হতে পারে না— ধরো, খাতা কলম নিয়ে রেল লাইনের ধারে গিয়ে বসলাম, যা দেখি ঠিক তাই লিখি— না দেখা একটা শব্দও যেন না থাকে— যেমন ধরো—

সামনেই ধানক্ষেত দীর্ঘায়িত হয়ে পড়ে আছে
ধানক্ষেতটির ওই পাশ দিয়ে রাস্তা চলে গেছে
উত্তরের দিক থেকে ঠিক দক্ষিণের দিকে— তাই দেখি…

‘গায়ত্রীকে’, ‘ফিরে এসো, চাকা, ‘ঈশ্বরীকে’ কাব্যগ্রন্থটির অসাধারণ প্রেমের কবিতাগুলোও বাস্তবজগতের, এবং এখানেই জীবনানন্দ দাশের কবিতার সঙ্গে বিনয় মজুমদারের পার্থক্য। ১৯৮২ সালের উপরোক্ত সাক্ষাৎকারটিতে বিনয় মজুমদারকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, “গায়ত্রীকে কি তুমি ভালোবাসতে?” উত্তরে বিনয় মজুমদার, একজন প্রেমিক যেভাবে নিজের গোপন প্রেমের কথা বলে, বলেছিলেন, “আরে ধ্যুৎ, আমার সঙ্গে তিনচার দিনের আলাপ— প্রেসিডেন্সি কলেজের নামকরা সুন্দরী ছাত্রী ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের, তারপরে কোথায় চলে গেলেন, আমেরিকা না কোথায়, ঠিক জানি না।”

পরে অজয় নাগ জিগ্যেস করেছিলেন, “বিনয়দা, চক্র মানে কী?” উত্তরে বিনয় মজুমদার বলেছিলেন, “চাকা, যা গড়িয়ে গিয়ে চলে আসে, যেখান থেকে শুরু করেছিল; যে চাকা চালায় সে চক্রবর্তী, আমি সেই চক্রবর্তীকে ফিরে আসতে বলেছি, গায়ত্রী চক্রবর্তীকেই একটা আস্ত চাকা বানিয়ে দিয়েছি।” ১৯৯৯ সালে ‘প্রচ্ছায়া’ পত্রিকার জন্য সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে মারুফ হোসেন জিগ্যেস করেছিলেন, “গায়ত্রী চক্রবর্তী সম্পর্কে কিছু শুনতে চাই।” উত্তরে বিনয় বলেছিলেন, “যিনি আমার গুরুদেব ছিলেন, বাংলা ভাষা পড়াতেন আমাকে প্রেসিডেন্সি কলেজে, সেই জনার্দন চক্রবর্তীর মেয়ে হলো গায়ত্রী চক্রবর্তী। ইডেন হিন্দু হোস্টেলের সুপারিনটেনডেন্টও ছিলেন। আমি ওই হোস্টেলে থেকেছি দুই বছর। গায়ত্রীর বয়স তখন কত হবে? ১০-১১-১২ বছর। আমার তখন হবে ধরো ১৬-১৭-১৮ বছর। তখন আমি ওকে দেখেছি।”

‘একটি উজ্বল মাছ’ কবিতাটি সম্পর্কে মাসুদুল হক বিনয় মজুমদারের মনোভঙ্গ বিশ্লেষণ করে বলেছেন যে, “ব্যাপারটি এভাবে উপলব্ধি করা যায়। পুকুরের তলদেশে একটি নারীমৎস্য দুঃখ নিয়ে সাঁতরে বেড়াচ্ছে। হঠাৎ একটি পুরুষ মৎস্য কোনো এক আনন্দের স্পর্শ দিল। সে-সুখে নারীমৎস্যটি জলমাধ্যম থেকে বায়ুমাধ্যমে উড়াল দেয়। কিন্তু সে আনন্দের উড়াল ক্ষণিকের, কেননা সে অনিবার্যভাবেই আবারও দুঃখের স্রোতে মিশে যাবে। কিন্তু মাঝখানে প্রকৃতির ঐক্যের কারণে, আপেক্ষিত তত্বের পরিপ্রেক্ষিতে, এই উড়াল দৃশ্য একটি ফল দেখে নিয়ে দার্শনিক বেদনাতে আপক্ক রক্তিম হয়ে ওঠে। নিউটনের সেই আপেলের ভূপৃষ্ঠে পতিত হবার যে ঘটনা তা দুঃখবাদের কেন্দ্রগামী বিন্দু। যাকে তিনি অভিকর্ষীয় ত্বরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করেন এই বস্তুবিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতে। কিন্তু মূল বিষয় হচ্ছে দুঃখবাদের এক অনন্ত সমীকরণ। সেই সমীকরণই ঘটান বিনয় মজুমদার, তাঁর ‘একটি উজ্বল মাছ’ কবিতায় গণিতের সমীকরণ দিয়ে। বিনয় তো নিজের সম্পর্কে বলেছেন, মূলত আমি গণিতবিদ, আমার অধিকাংশ সময় কাটে গণিত চিন্তায়; আর কবিতা, মানুষ যেরকম কাজের অবসরে সুন্দর সুন্দর ফুলের বাগান তৈরি করে, তেমনি।” মাসুদুল হক কিন্তু  বিনয় মজুমদারের দুঃখের উৎসসূত্রটি জানাননি।

বিনয়ের চোখে গায়ত্রী নামের যুবতীটি সুন্দরী, তিনি একজন গর্বোদ্ধত স্মার্ট ইংরেজিতে-কথা-বলিয়ে কনভেন্টে-পড়া যুবতী সন্দেহ নেই, তবে ফিল্মস্টার বা মডেলদের মুখশ্রীর সৌন্দর্যের দাবিদার তাঁকে বলা যায় না। তাঁর সৌন্দর্য সবাইকে ছাপিয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হবার, এবং পরবর্তীকালে দেরিদার অনুবাদকের ও সাবঅলটার্ন দর্শনের মুখপাত্রীর। গায়ত্রীর চলে যাওয়াটাও ফিরে এলো ‘ফিরে এসো, চাকা’ কাব্যগ্রন্থে, এবং যে ছবিগুলো কবিতায় বিনয় মজুমদার নিয়ে এলেন, তা বাস্তব জগতের, চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা নয়, অবলোকিত বাস্তব:

বেশ কিছু কাল হল চলে গেছ, প্লাবনের মতো
একবার এসো ফের; চতুর্দিকে সরস পাতার
মাঝে থাকা শিরীষের বিশুদ্ধ ফলের মতো আমি
জীবন যাপন করি; কদাচিৎ কখনো পুরোনো
দেওয়ালে তাকালে বহু  বিশৃঙ্খল রেখা থেকে কোনো
মানুষীর আকৃতির মতো তুমি দেখা দিয়েছিলে।
পালিত পায়রাদের হাঁটা, ওড়া, কুজনের মতো
তোমাকে বেসেছি ভালো ; তুমি পুনরায় চলে গেছ।

বিনয় মজুমদারের কাব্যসমগ্রের সম্পাদক তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় কাব্যসমগ্রের প্রথম খণ্ডে উল্লেখ করেছেন, ‘গায়ত্রীকে’ কবিতাপুস্তিকাটির নামকরণ প্রসঙ্গে বিনয় মজুমদার তাঁকে লিখেছিলেন, গায়ত্রী চক্রবর্তী প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তো এবং ১৯৬০ কি ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে বিএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে পাশ করেছিল। সে-ই আমার কবিতা বুঝতে পারবে ভেবে তাকেই উদ্দেশ্য করে ‘গায়ত্রীকে’ বইখানি লেখা। সেই হেতু বইয়ের নাম ‘গায়ত্রীকে’ রেখেছিলাম। চলবে