বিনয় মজুমদার: কবিতার বোধিবৃক্ষ

পর্ব ২০

মলয় রায়চৌধুরী

প্রকাশিত : অক্টোবর ১০, ২০১৯

১৫.
মাদুলি পত্রিকার বিনয় মজুমদার সংখ্যায় (২০১০) শিমুল সালাহউদ্দিন ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ আবিষ্কার প্রসঙ্গে লিখেছেন যে, ঢাকার এক সাহিত্য আসরে একজন আবৃত্তিকার এই কবিতাটি আবৃত্তি করেছিলেন, এবং খোঁজ নিয়ে তিনি জানতে পারেন কবির নাম বিনয় মজুমদার:

বিড়িতো ফুরালো প্রায়। দুটি বিড়ি আছে
শালপাতা দিয়ে এই বিড়ি বানায়। এপর্যন্ত লিখে
মনে এলো, রেললাইনের পাশে লম্বা এক শালবন
বানিয়েছে। শালপাতাগুলির সেই শাদা শাদা ফুল।
গন্ধ আছে নাকি এই শালফুলে, ঘ্রাণ যদি না থাকে
এই শালফুলে তবে শালফুল অঘ্রাণ
এবং এই শালফুলের মানে শালফুলের মনের অনুভূতি
ধরা আছে আমাদের পৃথিবীর ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালায়’।

শিমুল সালাহউদ্দিন লিখেছেন, পড়িতে বসিলাম ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’। জীবন্ত সব ডালপালা সমেত যেন অন্ধকারে একটি মৃত গাছ আমার জানালায় নড়িয়া উঠিল। মৃতগাছ তথাপি প্রসারণশিল তার ডালপালা। জীবন্ত। নির্লিপ্ত দাঁড়িয়ে কথা কই্ছে যেন। ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’র সেই ঘোর বাধ্য করিল বিনয়ে আসক্ত হইতে, বিনয়কে ভয় পাইতে, বিনয় নিয়া পড়াশুনা চিন্তা করিতে। দেখিলাম, বিনয় পণ্ডিতরা বিবৃতি করেছেন বিনয় মানসিক অসুস্থতার কারণে কলকাতা মেডিকাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রহিয়াছিলেন। দীর্ঘ সময়। কিন্তু সেই সময়ে লিখিত এক পঙক্তির দুশো একটি কবিতার ভিতর দিয়া খেয়া-নাও পাড়ি দিতে দিতে এ অধমের কখনও মনে হয় নাই, সেই মেদুর কবিতা পঙক্তিসমূহের কোনো একটাও পাগলপ্রলাপ। বিনয়ের এ কবিতাগুলো যেন ভিন্নতর দর্শনের আয়না, জন্মশেকড় হইয়া দেখা দিলো আমার কাছে। কল্পনা, তাহার পরিচিত দৃশ্যকল্প জগতে কল্পনার স্থান বিনয়ের এ কবিতাগুলোতে নাই। যেনবা জীবনের প্রতি অনাসক্ত এক দ্রষ্টা বিপরীত আয়নায় দেখিতেছেন জগৎকে। কবিতার সবকটি লাইন জুড়িয়াই রহিয়াছে অনন্য সব বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান এবং অনুধাবন। কেবল কবিতা কেন, বিনয় গদ্য সাহিত্যও সাজান পরতে-পরতে, তাকে তাকে, থাকে থাকে, গণিত প্রভাবিত দার্শনিকতায়। প্রতিভা ও মেধার সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা জানি না আমি। কোনো লেখক বা কবিকে আমাদিগের জগতে চরিয়া খাওয়া তথাকথিত অ্যাকাডেমিশিয়ানরা যে সকল অভিধায় ভূষিত করিয়া থাকেন, তা-ও করা যায় কিনা এ-লইয়া রহিয়াছে পক্ষে-বিপক্ষে প্রভূত বিতর্ক। তবে বিনয়ের কবিতা, তামাকে ডুবিয়া গিয়া যেমন, তেমনি বিনয়ের শত্রু ধরিয়া নিয়াও নিঃসন্দেহে বলা যায়, কোনো গণিতে, কোনো ভূগোলেই কোনো কবি-লেখক-সৃষ্টিশীল সত্তাকে আটক করিয়া রাখা যায় না। দৃশ্যত এমনই এক অতিবাস্তব-অধিবাস্তব অনুধাবনের মাঝখানে নির্লিপ্ত দাঁড়াইয়া সৃষ্টি করিয়া গিয়াছেন একের পর এক। হইয়া উঠিয়াছেন রাজা। ঘোর আর প্রবণতার। আর শব্দ, ব্যঞ্জনা, উপমায় উপমিত করিয়াছেন কবিতার ঘরগেরস্থালি, শিথান-পৈঠা-উঠান। নিজস্ব ডায়েরির মতো সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র আঙ্গিকের কাব্যে হইয়া উঠিয়াছেন দৃশ্য আর বলিবার মতোন নিরাসক্ত, নির্মেদ, সাবলীল, বহমান, অক্ষরবৃত্ত ছন্দের ষোলো ঘুটির ঘরের প্রবাদপুরুষ।

‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ কবিতাটির তৃতীয় পর্ব কিছুটা পড়ে দেখা যাক, যে পর্বটি এক সম্পাদক ছাপবেন বলে নিয়ে অশ্লীলতার ভয়ে ছাপতে চাননি। কেননা তখনও হাংরি মামলা হাইকোর্টে চলছে আর বিনয় মজুমদার বছর দুয়েকের জন্য হাংরি আন্দোলনে ছিলেন। ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ রচনার পরে ‘বাল্মীকির কবিতা’কে স্বাভাবিক ও অনায়াস অগ্রগতি বলে চিহ্ণিত করা যায়, যে পথে হাঁটার সাহস আর কোনো কবি এযাবৎ দেখাতে পারেনি। বহু পরে, জ্যোতির্ময় দত্ত ওনার ‘কলকাতা’ পত্রিকায় প্রকাশ করেন তৃতীয় পর্বটি:

সকল বকুল ফুল শীতকালে ফোটে, ফোটে শীতাতুর রাতে
যদিও বছর ভর, আষাঢ়ে-আশ্বিনে, চৈত্রে বকুলের নাম শোনা যায়,
শুনি বকুলের খ্যাতি, বকুলের প্রিয়তার সকল কাহিনী
তবু খুব অন্তরঙ্গ মহলেই শুধুমাত্র আলোচিত হয়
তার ঢাকাঢাকি করে এ-সব নরম আর গোপন বিষয়;
অচেনা মহলে প্রায় কখনোই বকুলের নাম বা কাহিনী
তোলে না, শরমবোধে চেপে যায় যেন কেউ বকুল দ্যাখেনি;
তবে— তবু আমি জানি সকলেই এ-সকল মনে মনে ভাবে
বড়ো বেশি করে মনে মনে ভেবে থাকে সারাটা জীবন
ভেবে বেশ ভালো লাগে বকুল ফুলের রূপ এবং সুরভি।
আমাদের সব চিন্তা অদৃশ্য বাস্তব হয়ে পাশে চারিধারে
রূপায়িত হতে থাকে, হয়ে যায়, অবয়বসহ হয়ে যায়,
চলচ্চিত্রাকারে হয়, চিন্তাগুলি অবিকল এমন বাস্তব
বলেই হয়তো এতো ভালো লাগে বকুলের বিষয়ে ভাবনা।
বকুলের আকারের বিষয়ে ভাবনা তবু বেশি ভালো লাগে
ঘ্রাণ ও রঙের চেয়ে অন্যান্য গুণের চেয়ে ফুলের আকার
চিরকাল সকলেরই অনেক অনেক বেশি ভালো লেগে থাকে–
মাঝখানে বড়ো এক ছিদ্রপথ, ছিদ্রপথ ঘিরে
অনেক পাপড়ি আছে, এলোমেলো সরু সরু পাপড়ি ছড়ানো;
এই চেহারাটি আমি স্বভাবত সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি
এ-সকল পাপড়িকে অতিশয় সাবধানে নাড়াচাড়া করি,
এখন এই তো এই বকুলবাগানে একা অঘ্রাণের রাতে
নাড়াচাড়া করে দেখি, অতি সাবধানে টানি, ধীরে-ধীরে টানি
যাতে এ-সকল দল ছিঁড়ে বা উঠে না যায়; কী রকম লাগে,
মনে হয়, মনে পড়ে এতো বড়ো বাগানের শরীরের থেকে
শুধুমাত্র ভালো-ভালো, মূল্যবান জিনিসকে বেছে-বেছে নিয়ে
যে-রকম চর্চা হয়, সৌন্দর্যচর্চার রীতি চিরকাল আছে
তার বিপরীতভাবে গদ্যময়তার থেকে বাদ দিয়ে দিয়ে
সারহীন অঙ্গগুলি সরিয়ে-সরিয়ে রেখে ডালপালা পাতা
একে-একে বাদ দিতে-দিতে শেষে যখন এমন
আর বাদ দিতে গেলে মূল কথা বাদ যায় যার তখন থেকেই
দেখা যায় জোছনায় ফুল ফুটে আছে, এই বকুল ফুটেছে,
দেখা যায় একা-একা অঘ্রাণের জোছনায় আমি ও বকুল,
বকুলের ফাঁকটির চারধারে সরু-সরু পাপড়ি ছড়ানো
অতি সোজা সাদা কথা যেন অবশিষ্টরূপে পড়ে আছে তবু–
তবু এ তো ডাল নয়, তবু এ তো পাতা নয়, এ হলো বকুল।

‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’র ছয়টি কবিতাই বেশ দীর্ঘ, এবং একই কথা শুনতে শুনতে পাঠক আগ্রহ যাতে হারিয়ে না ফেলেন, এবং পাঠকের মনে প্রশ্নের উদয় হয়, তাই বিনয় মজুমদার ‘এলিমিনেশান পদ্ধতি’ প্রয়োগ করে মাঝে-মাঝে কবিতার মাঝখানে বাঁকবদল ঘটিয়ে দিয়েছেন। এই এলিমিনেশন পদ্ধতি সম্পর্কে তাঁর একটি প্রবন্ধ আছে, যা আমরা পরে আলোচনা করব। যেমন ওপরের ওই লাইনটির পরে একটি ভাঙন তৈরি করে তিনি আরম্ভ করছেন এইভাবে:

শতকরা একেবারে একশতভাগ খাঁটি দর্শনের নাম
সংজ্ঞা অনুসারে ধর্ম, মনে হয় চারপাশে মহাকাশময়
অনাদি সময় থেকে, গণিতেরই মতো বহু কবিতা রয়েছে
চুপচাপ পড়ে আছে কোনোদিন একে-একে আবিষ্কৃত হয়
কোনো অঘ্রাণের রাতে বকুলবাগানে খুব মৃদু জোছনায়
সুডৌল পাতার ফাঁকে গহ্বরের মতো কিংবা ছিদ্রের মতোন।

এর পরে বাঁকবদল করে কবিতাটিকে অন্যদিকে চালিত করলেন বিনয়, বা বলা যায়, যারা এতক্ষণ আঁচ করতে পাচ্ছিলেন না বকুলফুল প্রকৃতপক্ষে ঠিক কোন জিনিশ, তাঁদের নিয়ে গেলেন পথ দেখিয়ে:

ছবি আঁকবার কালে কোনো যুবতীর ছবি আঁকার সময়ে
তার সব প্রত্যঙ্গকে হাজির রাখাই হলো বেশি দরকারি–
সবচেয়ে দরকারি, কোনো অঙ্গ কোনোক্রমে বাদ চলে গেলে
অন্যান্য অঙ্গগুলি যতো ভালো আঁকিই না কেন এই ছবি দেখে
ভয় করে, সকলেরই অতিশয় ভয়াবহ বলে মনে হয়।
তাই সব প্রত্যঙ্গকে হাজির রাখাই হলো বেশি দরকারি–
দরকারি বকুলের কুঁড়িগুলি শাদা-শাদা গোল-গোল কুঁড়ি–
এই কথা বকুলের কাছে আমি চোখ বুজে বলে ফেললাম,
বলি, ও বকুল, তুমি বোঝো না কি কুঁড়িগুলি খুব বেশি ছোট,
আরো ঢের বড়ো-বড়ো নরম-নরম হবার কথা না?
এ-সকল কুঁড়ি নেড়ে টিপে-টিপে সুখ পেয়ে— পাবার পরে না?
শুনে ফুল হেসে ফ্যালে, মৃদু-মৃদু হেসে ফ্যালে, কথা সে বলে না।
হেসে ফেললেই এই ঠোঁট দুটি এতো বেশি ফাঁক হয়ে যায়
গোলটুকু এতো বেশি ফাঁক হয়ে যায় কেন বকুল-বকুল,
হাসিকান্না যাই হোক গোল ঠিক এক মাপে থাকার কথা না—
এই কথা আমি বলি, একটু বিস্মিত হয়ে বলে ফেলি আমি।

এলিমিনেশান পদ্ধতি প্রয়োগ সম্পর্কে বিনয় মজুমদার আলোচনা করেছেন তাঁর ‘ধূসর জীবনানন্দ’ গ্রন্থে। তিনি লিখেছেন, “যে-কোনো রচনা সম্পূর্ণ বিবরণ-সংবলিত হওয়ার কথা। কিন্তু তা থেকে কোনো অংশ (স্তবক ইত্যাদি) কিংবা বাক্য সুপরিকল্পিতভাবে বাদ দিলে, এই বাদ দেওয়ার ব্যাপারটিকে বলি ‘এলিমিনেশান’। যেমন রবীন্দ্রনাথের ‘পূজারিণী’ কবিতাটির শেষ স্তবক এবং ঠিক তার আগের স্তবক— এই দুইয়ের মাঝখানে ঘটনার বিবরণ মহাকবি স্বেচ্ছায় সুপরিকল্পিত ভাবে বাদ দিয়েছেন:

এমন সময়ে হেরিলা চমকি প্রাসাদে প্রহরী যত
           রাজার বিজন কানন-মাঝারে
           স্তূপপদমূলে গহন আঁধারে
জ্বলিতেছে কেন যেন সারে সারে প্রদীপমালার মতো।

মুক্তকৃপাণে পুররক্ষক তখনি ছুটিয়া আসি
            শুধালো, “কে তুই ওরে দুর্মতি,
            মরিবার তরে করিস আরতি।”
মধুর কণ্ঠে শুনিল, শ্রীমতী, আমি বুদ্ধের দাসী”।

সেদিন শুভ্র পাষাণফলকে পড়িল রক্তলিখা।
           সেদিন শারদ স্বচ্ছ নিশীথে
           প্রাসাদকাননে নীরবে নিভৃতে
স্তূপপদমূলে নিভিল চকিতে শেষ আরতির শিখা।

শেষ স্তবকের ঠিক আগের স্তবকে কবি লিখেছেন, প্রাসাদের প্রহরীরা দেখতে পেল রাজার বিজন কাননে স্তূপপদমূলে প্রদীপমালা জ্বলছে। তার পরেই শেষ স্তবক— শেষ স্তবকে শুধু লিখেছেন, সেদিন শুভ্র পাষাণফলক রক্তচিহ্ণিত হলো এবং শেষ আরতির শিখা চকিতে নিভে গেল। এতে রচনা অধিকতর হৃদয়গ্রাহী হয়েছে, বেশি সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়েছে। অনুরূপভাবে কোনো রচনার কোনো বাক্য বা বাক্যাংশ বাদ দেওয়ার উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করছি বর্তমান প্রবন্ধের রচয়িওতারই একটি কবিতা। ‘আমার ঈশ্বরীকে’ গ্রন্থের তৃতীয় সংস্করণে ছিল, ‘যে গেছে সে চলে গেছে, দেশলাইয়ের বিস্ফোরণ হয়ে/বারুদ ফুরায় যেন, অবশেষে কাঠটুকু জ্বলে/আপন অন্তরলোকে’, ইত্যাদি। পরে ‘ঈশ্বরীর কবিতাবলী’র  সংস্করণে পরিমার্জনার পর লিখি: ‘যে গেছে সে চলে গেছে, অবশেষে কাঠটুকু জ্বলে/আপন অন্তরলোকে’ ইত্যাদি। এতে কবিতাটি অধিকতর হৃদয়গ্রাহী হয়েছে বলে আমার ধারণা। চিত্রশিল্পীদেরও এই ধরণের এলিমিনেশান ব্যবহার করা ভিন্ন গত্যন্তর নেই। পিকাসোর চিত্রে (একটি উদাহরণ ‘মা ও ছেলে’), মাতিসের চিত্রে (একটি উদাহরণ সেই দীর্ঘ গ্রীবা বিশিষ্ট তরুণী মহিলা), দেখা যায় বিশদরূপে আঁকতে গেলে যত রেখা ব্যবহার করতে হয়, তত রেখা তাঁরা ব্যবহার করেননি, বহু রেখাই বাদ দিয়ে দিয়েছেন। দিয়েছেন সংক্ষেপে কাজ সারার জন্য, শ্রীমণ্ডিত করার জন্য। এলিমিনেশানের ফল রহস্যময়তা ও দুর্বোধ্যতা। জীবনানন্দের নিজেরই রচনায় এলিমিনেশানের একটি সুন্দর উদাহরণ মনে পড়ল: ‘বিবর্ণ প্রাসাদ তার ছায়া ফেলে জলে/ও প্রাসাদে কারা থাকে? কেউ নেই— সোনালি আগুন চুপে জলের শরীরে/নড়িতেছে-জ্বলিতেছে -মায়াবীর মতো যাদুবলে’ ইত্যাদি। এখানে এই আগুন কি কোনো আলেয়ার, নাকি ওই প্রাসাদ থেকে আসা আলোর প্রতিফলন, না কি অন্য কোনো স্থান থেকে আসা আলোর প্রতিফলনও হতে পারে। কবি সে কথাটি বাদ দিয়ে দিয়েছেন, যেন বিষয়টি অত্যন্ত গোপন কথা। ফলে কবিতাটির এস্থানটি রহস্যময় হয়ে উঠেছে, পাঠক উপরিউক্ত সম্ভাবনাগুলির কোনটি হতে পারে ভাবতে শুরু করেন; পথ চলতে-চলতে রহস্যের ঘ্রাণ পেয়ে থেমে পড়ার মতো, থেমে পড়ে চতুস্পার্শ্ব একটু খতিয়ে দেখার মতো। এর ফলে সেই খতিয়ে দেখা স্থানটি পথিকের মনে গেঁথে যায়, গেঁথে যায় অনুরূপভাবে কবিতাটির পঙক্তিগুলিও। ফলে দেখা যাচ্ছে, এলিমিনেশান কবিদের মস্ত সহায়, প্রায়শই ভরসা। এলিমিনেশানের ফলে রহস্যময়তা বাড়ে, দুর্বোধ্যতা বাড়ে– মাঝে-মাঝে কবিতার অর্থ ‘কোনোদিন বোঝা যাবে না’ অবস্হায়ও এসে দাঁড়ায়। কিন্তু কবির চরম উদ্দেশ্য পাঠককে ভালো লাগানো, বোঝানো নয়।

বিনয় মজুমদার ‘ধূসর জীবনানন্দ’ গ্রন্থে লিখেছেন, জীবনানন্দের ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ কবিতায় সৌন্দর্যতত্ত্বের কয়েকটি ব্যাপার অনুপস্থিত। প্রবন্ধটি ১৯৬৬ সালে লেখা।

অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই— প্রীতি নেই—
                           করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্হা আছে আজো মানুষের প্রতি
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।

এতে এলিমিনেশান নেই। আলোকচিত্রধর্মিতা থেকে চ্যুতি নেই। বিনয় বলেছেন, অঙ্কিত চিত্র যেমন আলোকচিত্র নয়, কবিতাও তেমনি সাংবাদিকতাময় মাধ্যম নয়। অর্থাৎ চিত্রশিল্পীকে ভেবে-চিন্তে সুপরিকল্পিত ভাবে আলোকচিত্র হতে চ্যুত হতে হয়— তার উদ্দেশ্য দর্শককে অধিক পরিমাণে ভালো লাগানো। তেমনি কবিকেও ভেবেচিন্তে সুপরিকল্পিতভাবে সংবাদসুলভ রচনা থেকে চ্যুত হতে হয়। ফলে জন্ম হয়েছে ইমপ্রেশনিস্ট চিত্রের, অ্যবসট্র্যাক্ট চিত্রের। ফলে জন্ম হয়েছে অ্যাবসট্র্যাক্ট চিত্রের সমধর্মী আধুনিক কবিতার। আলোকচিত্রধর্মিতা থেকে চ্যুতির একটি সুন্দর দৃষ্টান্ত জীবনানন্দে— ‘ঘাসের উপর দিয়ে বয়ে যায় সবুজ বাতাস/অথবা সবুজ বুঝি ঘাস?/অথবা নদীর নাম মনে করে নিতে গেলে চারিদিকে প্রতিভাত হয়ে ওঠে নদী’, ইত্যাদি। এখানে কবি স্বেচ্ছায় আলোকচিত্রধর্মিতা থেকে অত্যন্ত বেশি সরিয়ে নিয়ে এসেছেন রচনাকে এবং রচনাও আশ্চর্য হৃদয়গ্রাহী হয়ে উঠেছে।”

কবিতাটির বিশ্লেষণে বিনয় মজুমদার বলেছেন, মূল বিষয়বস্তু যা কবিকে ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ কবিতায় উক্ত বা ব্যক্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হতে বাধ্য করেছিল, সেই মূল বিষয়বস্তুটি নেই। অর্থাৎ সাক্ষপ্রমাণহীন অবস্থায় রয়েছে কবিতাটির বক্তব্যবিষয়। এগুলো কবিতাটির এডিটিং-এর অঙ্গ। কিন্তু এই কবিতাটিতে আছে: ১) আবিষ্কার। যে-কোনো নতুন আবিষ্কার চমকপ্রদ এবং মনকে সেহেতু নিজের দিকে আকৃষ্ট করে। ২) উপমার বদলে সাবস্টিটিউশান আছে। প্রকৃতপক্ষে মূলে সাংবাদিকসূলভ কতকগুলি বাক্য কবির লেখার ছিল; সেই বাক্যগুলির সাবস্টিটিউটরূপে কতকগুলি বাক্য কবি লিখেছেন, মূল বাক্যগুলি একদম না লিখে। মূল বিষয়বাহী বাক্যের সাবস্টিটিউটরূপে কবি অ্যানালজাস বিষয়বাহী বাক্য লিখলেন, এবং তা করতে উপমা, উপমার থেকে প্রতীক তাঁকে সাহায্য করল। ৩) বারংবার পঠনেচ্ছা-উদ্রেকের ব্যবস্থা আছে। অন্যতম প্রকৃত চিন্তনীয় বিষয় এই যে কবিতার অদ্ভূত সংসৃজন, এতে বিবৃত দার্শনিক আবিষ্কার, এর অন্তর্নিহিত এবং অনুল্লেখিত বেদনা, কবিতায় সৃষ্ট বিষণ্ণ পরিবেশ, মন্থর গতি ইত্যাদি সব মিলিয়ে পাঠককে কবি দ্বিতীয়বার পাঠে বাধ্য করতে সমর্থ হয়েছেন। এবং প্রথমে, দ্বিতীয়বার পাঠের পরে তৃতীয়বার পাঠের আগ্রহ আরো বাড়তে থাকে— কারণ পাঠক নিজে তখন পাঠক থেকে কবি হতে থাকেন, চিন্তায় পড়ে, বাধ্য হয়ে। রবীন্দ্রনাথের কবিতা পাঠ করতে করতে পাঠক নিজেকে অত্যন্ত তুচ্ছ (রবীন্দ্রনাথের তুলনায়) মনে করতে বাধ্য, আর জীবনানন্দের কবিতা পাঠ করতে করতে পাঠক নিজেকে অত্যন্ত মূল্যবান মনে করতে বাধ্য, যার ফলে পাঠকের পঠনেচ্ছা বাড়তেই থাকে। ৪) সহজে মুখস্থ করে রাখার ব্যবস্থা আছে। বারংবার পড়তে পড়তে যাতে কবিতাটি স্মৃতিস্থ হয়ে যায় সেদিকে কবি দৃষ্টি রেখেছেন। ৫) গভীরতা আছে। অর্থাৎ পাঠকের চিন্তার খোরাক প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান। ৬) সংযম আছে। সংযম কবিদের অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, এক দুরূহ তপস্যার মতো। যে-সব ব্যাপার লক্ষ্য করে কবি এই ‘সিদ্ধান্ততে’ পৌঁছেছেন, সেসব ব্যাপার অনুল্লেখিত, অলিখিত। ‘সিদ্ধান্তটিই’ কবিতা। ৭) বহুমাত্রিক চরিত্র আছে। বহুমাত্রিক শব্দটি আমি মাল্টিডাইমেনশানাল অর্থে ব্যবহার করছি। মাত্রা বা ডাইমেনশন মানে স্বয়ংসম্পূর্ণ কিন্তু একটিমাত্র বিষয় ধরছি— যেমন প্রেম, জীবনদর্শন, সমাজনীতি, রাজনীতি, বিজ্ঞান ইত্যাদি।

১৯৬৬ সালে লেখা উপরোক্ত বিশ্লেষণের মূল বিন্দুগুলো এই জন্যই উপস্থাপন করলুম যে, বিনয় সেই সময়েই লিখছিলেন ছয় পর্বে দীর্ঘ তাঁর ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’। ১৯৯৯ সালে মারুফ হোসেনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বিনয় বলেছিলেন ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা; কবিতাটি তিনি লিখেছেন তাঁর একাকিত্ব নিয়ে। আশা করি আলোচকরা বিনয়ের এই কবিতাটি এবং পরবর্তীকালে রচিত ‘বাল্মীকির কবিতা’ পড়ার সময়ে খেয়াল রাখবেন যে, বিনয় তাঁর কবিতার ক্রাফটে কেমন ধরণের বৈশিষ্ট্য বুনে দ্যান। ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’র বকুল ফুল তার ছিদ্রপথ এবং ফাঁক আর পাপড়িদের নিয়ে আরো সুস্পষ্টভাবে ফিরে এসেছে ‘বাল্মীকির কবিতা’য়। ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ কাব্যটিকে বিনয় মজুমদার বলেছেন সেটি হলো ‘ধর্মগ্রন্থ’; এই ধর্ম তাঁর ব্যক্তিগত ধর্ম, কেননা একটা আগেই পড়েছি যে ধর্ম থেকে বিনয় সাত হাত দূরে। অর্ঘ দত্ত বকসী তাঁর ‘বিনয় মজুমদার ও অঘ্রাণের অনুভূতি— বিশাল দুপুরবেলার যৌনসমীক্ষা’ নিবন্ধে বলেছেন, “জীবন থেকে, গণিত থেকে, আত্মসমীক্ষা থেকে পাওয়া যাবতীয় দর্শনের মহাবিস্ফোরণ আছে এই কবিতাগ্রন্থে।”

বিনয় মজুমদার যখন সীমান্ত পেরিয়ে পুর্ব পাকিস্তানে নিজের গ্রামে গিয়ে কিছুকাল ছিলেন, তখন তাঁর আচরণে গ্রামবাসীরা কোনো অস্বাভাবিকতা পাননি। বিনয় যখন শিমুলপুর গ্রামে পাকাপাকি বসবাস আরম্ভ করলেন তখনও তাঁর আচরণ থেকে অস্বাভাবিকতা বিদায় নিয়েছিল। তার কারণ পূর্ব পাকিস্তানের গ্রামে এবং শিমুলপুরে তিনি ফিরে পেয়েছিলেন তাঁর কৌম-প্রতিস্ব, হয়ে উঠেছিলেন প্রকৃতির সবুজ ভূখণ্ডের অঙ্গাঙ্গী। ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ বিনয়ের সেই কৌম-প্রতিস্বকে উন্মুক্ত করেছে, কোনো রাখঢাককে তোয়াক্কা করেনি। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে বেরিয়ে কলকাতা মহানগরের জটিল ও সর্পিল পথসমষ্টির বিভ্রান্তিকর রাস্তা, পথ, গলির এবং সেখানকার মানুষদের ভুলভুলাইয়ায় তাঁর কৌম-প্রতিস্ব আবছা হয়ে উঠছিল ক্রমশ। তা থেকে মুক্তি পাবার জন্যই হয়তো তিনি পূর্ব পাকিস্তানে নিজেদের ছেড়ে আসা গ্রামে চলে গিয়েছিলেন। কলকাতা মহানগরে তিনি আক্রান্ত হচ্ছিলেন পারস্পরিক দূরত্বের অসম্বদ্ধতায়, অপসৃতির বোধে। শিমুলপুরে পৌঁছে তিনি স্রষ্টাকে খুঁজে পেলেন, যা একযোগে তাঁর ভেতরে এবং বাইরে বিদ্যমান। ‘অউম’ পত্রিকার জন্য দেয়া সাক্ষাৎকারে ১৪১৩ বঙ্গাব্দে তিনি বললেন, “শরীরই অন্তর আর অন্তরই শরীর— এই অনাদি একের থেকে সৃষ্টি হয়েছিল এ বিশ্বের সবকিছু। অত্রি তারা আমাকে বলেছিল, শরীরই অন্তর আর অন্তরই শরীর। আমারও তাই মত। বেঁচে থাকতে হলে এই একটি বাক্যাংশই মনে রাখতে হবে। আর কোনও মন্ত্র নেই।” ‘ফিরে এসো, চাকা, ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’, ‘বাল্মীকির কবিতা’ ও পরের দিনপঞ্জিমূলক সাব-জনারের কাব্যগ্রন্থগুলোতে আমরা বিনয়ের এই বার্তাটিকেই প্রতিটি পঙক্তিতে প্রবহমান দেখি। চলবে