বিবেকানন্দ ও বাংলাদেশের কট্টর মুসলমান

পর্ব ৩

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : জুন ০৭, ২০২১

বিবেকানন্দ বিবাহকে দুপক্ষের চুক্তি বলে মানতে নারাজ। তিনি বিবাহ বিচ্ছেদ চান না। তিনি চান সতী সাধ্বী রমণী, যিনি স্বামীর অবাধ্য হবেন না; স্বভাবতই বিবাহ বিচ্ছেদের তাহলে আর কারণ থাকে না। তিনি নারীদেরকে শিক্ষা দিতে চান ভবিষ্যতে একান্ত বাধ্যগত পতিপরায়ণা হবার জন্য; বিবাহ বিচ্ছেদের সুযোগ যখন আর সমাজে থাকবে না, যিনি স্বামীর সঙ্গে চুক্তি করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবেন না; বিবাহ করবেন পুরোহিতের মন্ত্র পাঠ দ্বারা। বিবেকানন্দ আস্ফালন করে যাই বলুন, ভারতীয়রা শেষপর্যন্ত তাঁর কথায় কর্ণপাত করেনি। বাস্তবতার পথ ধরে হেঁটেছে। বিবেকানন্দের দুর্ভাগ্য যে, ভারতে বিয়ে এখন একটা চুক্তি, বিবাহ বিচ্ছেদ করার আইন আছে। ফলে ভারতীয়রা আরবদেরকে অনুসরণ করতে বাধ্য হয়েছে; ধর্মের বন্ধন শিথিল করার জন্য। ধর্মীয় মন্ত্র পাঠ করেই অধিক বিবাহ হচ্ছে; কিন্তু তারা কেউ সীতা নন। বিবাহের সময় তাদের চুক্তি করবার অধিকার রয়েছে আর সেই সঙ্গে বিবাহ-বিচ্ছেদের। ভারতীয়রা বিবেকানন্দের আদর্শের চেয়ে আরবদের আদর্শকে সুবিধাজনক বা প্রগতিশীল মনে করেছে। নারীর সম্পত্তির অধিকার পর্যন্ত স্বীকার করা নেয়া হয়েছে ভারতীয় আইনে।

বিবেকানন্দ কীরকম গোঁড়া ছিলেন তাঁর এই প্রবন্ধের প্রতিটি বাক্যে তা স্পষ্ট। নারীর স্বাধীনতায় তিনি বিশ্বাস করতেন না, না নারীর সমান হওয়ার অধিকারে। তিনি বিশ্বাস করতেন একমাত্র নারীর ‘সীতা’ হয়ে ওঠায়; আর মহামানব বিবেকানন্দ নারীকে সেইটুকুই শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের মেয়েদের একটা শিক্ষা তো সহজে দেওয়া যাইতে পারে; হিন্দুর মেয়ে সতীত্ব কী জিনিস তাহা সহজেই বুঝিতে পারিবে; ইহাতে তাহারা পুরুষানুক্রমে অভ্যস্ত কিনা! প্রথমে সেই ভাবটাই তাহাদের মধ্যে উসকাইয়া দিয়া তাহাদের চরিত্র গঠন করিতে হইবে; যাহাতে তাহারা বিবাহিত হউক, বা কুমারী থাকুক, সকল অবস্থাতেই সতীত্বের জন্য প্রাণ দিতে কাতর না হয়।’ তিনি লিখেছেন, ‘নারীদিগের সম্বন্ধে আমাদের হস্তক্ষেপ করিবার অধিকার তাহাদিগকে শিক্ষা দেওয়া পর্যন্ত; নারীগণকে এমন যোগ্যতা অর্র্জন করাইতে হইবে, যাহাতে তাহারা নিজেদের সমস্যা নিজেরাই নিজেদের ভাবে মীমাংসা করিয়া লইতে পারে।’ ‘সীতা, সাবিত্রী, দয়মন্তী, লীলাবতী, খনা, মীরা; ইঁহাদের জীবন চরিত্র মেয়েদের বুঝাইয়া দিয়া তাহাদের নিজেদের জীবন ওইরূপে গঠিত করিতে হইবে।’

বিবেকানন্দ নারীদের স্বাধীনভাবে শিক্ষিত হতে দিতে চান না, তিনি তাদের ছাঁচে ফেলে সেই মাপে গড়ে তুলতে চান। নারীদের সেই শিক্ষা দেবার লক্ষ্যে তিনি মঠস্থাপন করতে চান। মঠস্থাপন সম্পর্কে বিবেকানন্দ কী বলেছেন। তিনি লিখেছেন, গঙ্গার ওপারে একটা প্রকাণ্ড জমি লওয়া হইবে। তাহাতে অবিবাহিতা কুমারীরা থাকিবে, আর বিধবা ব্রহ্মচারিণীরা থাকিবে; আর ভক্তিমতী গৃহস্তের মেয়েরা মধ্যে মধ্যে আসিয়া অবস্থান করিতে পারিবে। এই মঠে পুরুষদের কোনোরূপ সংস্রব থাকিবে না। পুরুষ মঠের বয়োবৃদ্ধ সাধুরা দূর হইতে স্ত্রী-মঠের কার্যভার চালাইবে। ..জপ, ধ্যান, পূজা; এইসব তো শিক্ষার অঙ্গ থাকিবেই। যাহারা বাড়ি ছাড়িয়া একেবারে এখানে থাকিতে পারিবে, তাহাদের অন্নবস্ত্র এই মঠ হইতে দেওয়া হইবে। ..মেয়েদের ব্রহ্মচর্যকল্পে এই মঠে বয়োবৃদ্ধা ব্রহ্মচারিণীরা ছাত্রীদের শিক্ষার ভার লইবে। এই মঠে ৫/৭ বৎসর শিক্ষার পর মেয়েদের অভিভাবকেরা তাহাদের বিবাহ দিতে পারিবে। যোগ্যাধিকারিণী বলিয়া বিবেচিত হইলে অভিভাবকদের মত লইয়া ছাত্রীরা এখানে চিরকুমারী-ব্রতাবলম্বনে অবস্থান করিতে পারিবে। যাহারা চিরকুমারী-ব্রত অবলম্বন করিবে, তাহারাই কালে এই মঠের শিক্ষয়িত্রী ও প্রচারিকা হইয়া দাঁড়াইবে এবং গ্রামে গ্রামে, নগরে নগরে শিক্ষাকেন্দ্র খুলিয়া মেয়েদের শিক্ষাবিস্তারে সহায়তা করিবে।’

বিবেকানন্দের শিক্ষাবিস্তার মানে সীতার সংখ্যা বাড়িয়ে তোলা। বিবেকানন্দ আশা করেন সারা ভারতের রমণীরা সকলে ‘সীতা’ হয়ে যাক। মুসলমান অনেক কট্টর ধর্মীয় নেতারা যেমন নারীর আদর্শ হিসেবে নবীর স্ত্রী ‘আয়েশা’র উদাহরণ দেন, বিবেকানন্দের কাছে নারীর উদাহরণ মানে সীতা। দুপক্ষের চিন্তায় রয়েছে নানারকম মিল, নিজ নিজ ধর্ম প্রচারের পক্ষে সেগুলিকে তারা ব্যবহার করেছেন। বাংলাদেশের মোল্লাদের সঙ্গে সেখানে নারীর জীবন যাপন প্রশ্নে বিবেকানন্দের পার্থক্য কোথায়? দুপক্ষই শেষবিচারে নারীকে পতিপরায়ণ, সতীসাধ্বী এবং সর্বসহা বলে মনে করেন। বিবেকানন্দের কাছে নারী কখনো পুরুষের সমান নয়। বিবেকানন্দ ভারতের নারীদের সম্পর্কে লিখেছেন, ‘এ সীতা-সাবিত্রীর দেশ, পুণ্যক্ষেত্র ভারতে এখনও মেয়েদের যেমন চরিত্র, সেবাভাব, স্নেহ, দয়া, তুষ্টি ও ভক্তি দেখা যায়, পৃথিবীর কোথাও তেমন দেখিলাম না। পাশ্চাত্যে মেয়েদের দেখিয়া আমার অনেক সময় স্ত্রীলোক বলিয়াই বোধ হইতো না; ঠিক যেমন পুরুষ মানুষ। গাড়ি চালায়, অফিসে যায়, স্কুলে যায়, প্রফেসারি করে! একমাত্র ভারতবর্ষেই মেয়েদের লজ্জা বিনয় দেখিয়া চক্ষু জুড়ায়।’

বিবেকানন্দ স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, নারী পুরুষের মতো গাড়ি চালাবে, চাকরি করবে, অধ্যাপনা করবে তা নারীর আদর্শ হতে পারে না। নারী হবে লজ্জাবনত। বিবেকানন্দের চরিত্রের কিছুটা স্ববিরোধিতা এখানে ধরা পড়বে। তিনি প্রবন্ধটির শুরুতে নারীর অবস্থার কথা বলতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে উদাহরণ হিসেবে টেনেছেন। তিনি দেখিয়েছেন নারীরা সেখানে কতো ভালো আছে। তিনি নারী শিক্ষার পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের নারীদের উদাহরণ দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘সেই দেশে দরিদ্র একরূপ নাই বলিলেই চলে এবং অন্য কোথাও মেয়েরা ওই দেশের মেয়েদের মতো স্বাধীন, শিক্ষিত ও উন্নত নহে। ইহাদের রমণীগণ সকল স্থানের রমণীগণ অপেক্ষা উন্নত। মহিলাগণ সমুদয় জাতীয় উন্নতির প্রতিনিধিস্বরূপ। পুরুষেরা কার্যে অতিশয় ব্যস্ত বলিয়া শিক্ষায় তত মনোযোগ দিতে পারে না। মহিলাগণ প্রত্যেক বড়ো বড়ো কার্যের জীবনস্বরূপ।..হাজার হাজার মেয়ে দেখিয়াছি। সকল কাজ তাহারাই করে। স্কুল, কলেজ মেয়েতে ভরা। আমাদের পোড়া দেশে মেয়েদের পথ চলিবার উপায় নেই।’ পরক্ষণে তিনি মনের কথাটা বলে দিয়েছেন, তেমন নারী তিনি ভারতে দেখতে চান না। তিনি চান সীতাকে, সীতার প্রতিমূর্তি গড়তে চান তিনি ভারতে।

বিবেকানন্দ বহু কিছু বলেছেন যা প্রথম বিচারে মনে হবে মহৎ বাণী। তিনি ভারতের দরিদ্র মানুষ বা নিম্নশ্রেণীর মুক্তির কথা বলেছেন। দরিদ্র মানুষের শিক্ষার কথা বলেছেন। কিন্তু শিক্ষা বলতে তিনি প্রধানত বুঝতেন আধ্যাত্মিক শিক্ষা, বেদ বেদাঙ্গ সম্পর্কে শিক্ষা। বিবেকানন্দ নারীর প্রতি সম্মান দেখিয়ে তাকে মাতৃরূপে পূজা করার কথা বলেছেন। সত্যি বলতে তাঁর এসব বক্তব্যের পিছনে ছিল চরম আবেগ, হিন্দুত্বের আবেগ। যুক্তিবোধ বা আধুনিকতার ছোঁয়া ছিল না। তিনি নারীর পক্ষে খুব জোর গলায় বলছেন, ‘যাহারা বিশুদ্ধভাবে, সাত্ত্বিকভাবে, মাতৃপূজা করিবে, তাহাদের কী কল্যাণ না হইবে?..শ্রীরামকৃষ্ণ কিন্তু নারীপূজা বলিতে বুঝিতেন, সকল নারী সেই আনন্দময়ী মা ব্যতীত কিছুই নহেন; তাঁহারই পূজা।..ইহাই আমাদের প্রয়োজন। মেয়েদের পূজা করিয়াই সব জাতি বড়ো হইয়াছে। যে দেশে, যে জাতিতে মেয়েদের পূজা নাই, সে দেশ, সে জাতি কখনও বড়ো হইতে পারে নাই, কস্মিমকালে পারিবে না।’ বিবেকানন্দের এ কথাগুলি নতুন কিছু নয়। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের কট্টর নেতা মনু ঠিক একথাগুলিই বলেছিলেন। বিবেকানন্দ তা নকল করেছেন মাত্র।

মনু বলেছিলেন, ‘যেখানে নারীরা পূজিত হন না, সেখানে দেবগণ তুষ্ট হন না। নারীকে তুষ্ট না করলে সর্ব কর্ম নিষ্ফল হয়ে যায়। নারী অসম্মানিতা হয়ে অভিশাপ দিলে সব দিক বিনষ্ট হয়।’ কিন্তু সমগ্র মনু সংহিতায় নারী বন্দনার এই শ্লোকের কোনো প্রতিফলন নেই। মনু নারীকে কোনো রূপেই স্বাধীনতা দিতে চাননি। নারী সারাজীবন পুরুষের অধীনতা স্বীকার করে বেঁচে থাকবে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত। স্বামী বা পুরুষকে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন; স্ত্রীলোকদের দিনরাত পরাধীন রাখবে। স্ত্রীলোক স্বাধীনতার যোগ্য নয়। স্ত্রীলোক কুমারী জীবনে পিতার, যৌবনে স্বামীর আর বার্ধক্যে পুত্রের অধীনে থাকবে। মনুর বিধানে নারীর নিজের দেহের উপর তার নিজের কোনো অধিকার ছিল না। মনু নারীর স্বভাবকে খুব মন্দ করে দেখিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘নারীর স্বভাবই হলো পুরুষদের দুষিত করা।’ মনু নারীদের এতটাই অবিশ্বাস করেছেন যে বিধান দিয়েছেন; মা, বোন বা মেয়ের সঙ্গে শূন্যগৃহাদিতে পুরুষ থাকবে না। (কঙ্কর সিংহ, মনুসংহিতা এবং নারী)

মানবধর্মশাস্ত্র মনুসংহিতায় কন্যা-শিশুর জন্য বিবাহই ছিল প্রথম উল্লেখযোগ্য সংস্কার। মনুর ধর্মশাস্ত্রে নারীর জন্য বিবাহ ছিল বাধ্যতামূলক। (কঙ্কর সিংহ, মনুসংহিতা এবং নারী) মনু নারীকে শিক্ষা লাভের অধিকার দেননি। তিনি বলেছেন, দ্বিজরা শিখতে পারবে; যারা উপনয়ন গ্রহণের মধ্য দিয়ে দ্বিজ হয়েছেন। নারী এবং শূদ্রদের জন্য মনু উপনয়ন এবং শিক্ষা গ্রহণ নিষিদ্ধ করেছিলেন। তিনি স্পষ্টই বলেছেন, ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় কন্যা হলেও নারী শিক্ষা লাভের সুযোগ পাবে না। (কঙ্কর সিংহ, মনুসংহিতা এবং নারী) বিবেকানন্দ নারীকে শিক্ষার অধিকার দিয়েছেন, সে কারণে মনে হতে পারে তিনি বিপ্লবী। মনে হতে পারে নারীর অধিকারের প্রশ্নে তিনি মনুর বিধানকে উল্টে দিয়েছেন। বাস্তবে নারী শিক্ষা বলতে তিনি যা বুঝিয়েছেন, ঠিক তা মনুর বিধানের সঙ্গেই মানান সই। নারীকে পুরুষের অধীনতা মানবার শিক্ষাদানের কথা তিনি বলেছেন। তিনি শিক্ষাদানের মধ্য দিয়ে নারীকে পতিপরায়ণা বা ধর্মপ্রচারের পুরোহিত বানিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন। নারীকে তিনি বিয়ে করে সংসার ধর্ম পালন করার চেয়ে বৈরাগ্য পালনে অধিক উৎসাহ যুগিয়েছেন। তিনি বৈরাগ্য পালনকে ধর্মরক্ষার পথ হিসেবে বিবেচনা করেছেন। চলবে