বিশ্বজয়ী হও

পর্ব ৯

অমিত কুমার কুণ্ডু

প্রকাশিত : জুলাই ০৩, ২০২০

কচ্ছপ ও খরগোশের গল্পটি মনে আছে তো? কচ্ছপ ছিল ধীর, কিন্তু লক্ষ্যে স্থির। সর্বদা শান্ত থেকে গন্তব্যের দিকে ননস্টপ এগিয়ে গিয়েছিল এবং বিজয়ী হয়েছিল। অন্যদিকে খরগোশ ছিল দূরন্ত অস্থির চিত্তের। লক্ষ্যকে করায়ত্ত করার জন্য ভবিষ্যৎ না ভেবেই অশান্ত হয়ে দৌড়েছিল, ক্লান্ত হয়েছিল এবং অলস হয়ে বিশ্রাম নিয়েছিল। বিশ্রাম শুধু অলসতার কারণেই নেয়নি, বরং কচ্ছপের প্রতি একটা তুচ্ছতাচ্ছিল্যের ব্যাপারও ছিল। তাই অনেক আগে অনেকটা পথ পৌঁছিয়েও, খরগোশ বিজয়স্তম্ভ ছুঁতে পারে নি। ফলাফলে কচ্ছপ বিজয়ী হয়।

পুরাতন গল্পটি এখানে এসেই শেষ হয়েছে। নতুন গল্পটি এখানে এসে শেষ হয়নি। নতুন গল্পে গন্তব্যের পথে একটা খাল এসে পড়ে। নতুন গল্পে খরগোশ বিশ্রাম নেয় না, কচ্ছপকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যও করে না। তবুও খরগোশ যেতে পারে না। কারণ পথে খাল। খরগোশ তো সাঁতার জানে না, সে খাল পার হবে কীভাবে? সে খাল পাড়েই আটকে পরে। লক্ষ্য ছুঁতে পারে না। এখানেও কচ্ছপ খাল পার হয়ে বিজয় স্তম্ভ স্পর্শ করে, তবুও সে বিজয়ী হতে পারে না। কারণ সময় শেষ। গতি কম থাকাতে সময়ের আগে সে পৌঁছাতে পারে নি। এই গল্পের ফল কেউই বিজয়ী হতে পারে নি।

আধুনিক গল্পে খরগোশ কচ্ছপকে পিঠে নিয়ে দৌড় শুরু করে খালপাড়ে পৌঁছায়। সেখানে কচ্ছপের পিঠে চড়ে খরগোশ খাল পার হয়। তারপর আবার খরগোশের পিঠে চড়ে কচ্ছপ-খরগোশ একসাথে বিজয় স্তম্ভ স্পর্শ করে। এ গল্পে সময়ের পূর্বেই একসাথে দুইজন বিজয়স্তম্ভ স্পর্শ করাতে দুজনেরই একসাথে বিজয় নিশ্চিত হয়। ফল দুজনেই বিজয়ী।

আধুনিক শিক্ষা বলছে, তোমরা একসাথে এগিয়ে যাও। তোমার ঘাটতি অপরের থেকে পূরণ করে, অপরের ঘাটতি তুমি পূণণ করে দিয়ে, জোটবদ্ধ হয়ে, সংঘবদ্ধ হয়ে, একসাথে এগিয়ে যাও। যাতে উভয়ের কল্যাণ হয়। আধুনিক শিক্ষা প্রতিযোগিতাকে এড়িয়ে, প্রতিপক্ষকে এড়িয়ে, বন্ধুত্ব ও সহমর্মিতার পথে এগিয়ে চলতে বলছে। কারণ আধুনিক পথে প্রতিবন্ধকতা বেশি। এখন একা বেশি দূর এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। পরস্পরের শক্তি, বুদ্ধি, বিবেচনাবোধ একত্রে মিলিত হলে, তবেই জটিল থেকে জটিলতর সমস্যা সমাধান করা সম্ভব। লক্ষ্যের পথে অবিচল থেকে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব।

মানুষের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সুসম্পর্ক বর্তমানে একটি শক্তি, একটি গুণাবলি হয়ে দেখা দিয়েছে। মানব জীবনটিও এমনই। হতাশ হয়ে গন্তব্যকে অস্পর্শনীয় ভেবে বসে থাকলে যেমন চলবে না, তেমনি বালক সুলভ চপলতায় চাঁদকে এখনই আমার হাতের মুঠোয় চাই—এমন বললেও চলবে না। উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে যে কাজ করা হয়, তা কখনই সফল হয় না। মনে রাখবে— অধৈর্য, রাগ, বিদ্বেষ, ঈর্ষা কোনো কাজে সফল হবার প্রধান অন্তরায়। কোয়ান্টাম মেথড বলে, রেগে গেলে তো হেরে গেলে।

স্বামীজি এ বিষয়ে বলতেন, ‘ধীর, নিস্তব্ধ অথচ দৃঢ়ভাবে কাজ করতে হবে। খবরের কাগজে হুজুগ করা নয়। সর্বদা মনে রাখবে, নামযশ আমাদের উদ্দেশ্য নয়। খবরের কাগজের আহাম্মকি বা কোনো প্রকার সমালোচনার দিকে মন দিও না। মন মুখ এক করে নিজের কর্তব্য করে যাও, সব ঠিক হয়ে যাবে। সত্যের জয় হবেই হবে।’

তাই কোনও কাজ করতে গেলে আগে বাস্তবে তার খসড়া করে দেখ। একটি কাজ করার পূর্বে বা কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর পূর্বে চিন্তা কর, তবে সে চিন্তা যেন দীর্ঘস্থায়ী না হয় এবং সিদ্ধান্ত নিতে তুমি যেন দ্বিধা-বিভক্ত না হও। মনে রাখবে, তোমার নিজের সিদ্ধান্ত তোমার থেকে আর কেউ ভালভাবে নিতে পারবে না। কারণ তোমাকে তুমিই সব থেকে বেশি ভালবাস এবং সব থেকে বেশি চেন। তুমি যদি ধীর স্থির শান্ত না হও, তবে তুমি নিজে নিজের জন্য কল্যাণকর হবে না।

তুমি সিংহের মত শক্তিশালী হও, কিন্তু মনে রাখবে এ শক্তি সবসময় ধরে রাখতে হবে, নতুবা যখন তুমি শক্তিহীন হবে, তখন সামান্য শৃগালের আঘাতে তুমি ক্ষত-বিক্ষত হবে। আর তুমি তখনই সবসময় সমশক্তি সম্পন্ন হবে, যখন অহেতুক শক্তির অপচয় করবে না। চঞ্চল বানরের মত এক গাছ থেকে অন্য গাছে লাফানো তোমার কাজ নয়। আবার কলুর বলদের মত একই বৃত্তে সারাদিন ঘোরাও তোমার কাজ নয়। তুমি হবে সেই পিঁপড়ার মত, যে শীত আসবে ভেবে সমস্ত গ্রীষ্মকাল খাদ্য সঞ্চয়ের জন্য কঠোর পরিশ্রম করে। তুমি হবে সেই মৌমাছির মত, যে শতশত মাইল ভ্রমণ করে বিন্দু বিন্দু মধু সংগ্রহের জন্য এবং এভাবে নিরলস কাজ করে গড়ে তোলে সুবৃহৎ মৌচাক। ফুলে অতি সামান্য মধু থাকে ভেবে, যদি মৌমাছি সে মধু না গ্রহণ করতো, তবে কখনই এমন বিশাল মৌচাক হতো না। কাজ অতি সামান্য থেকেই বড় হয়।

স্বামীজির ভাষায়, ‘কাজের সামান্য আরম্ভ দেখে ভয় পেও না, কাজ সামান্য থেকেই বড় হয়ে থাকে। সাহস অবলম্বন কর। নেতা হতে যেও না, সেবা কর। নেতৃত্বের এই পাশব প্রবৃত্তি জীবনসমুদ্রে অনেক বড় বড় জাহাজ ডুবিয়েছে। এই বিষয়ে বিশেষ সতর্ক হও অর্থাৎ মৃত্যুকে পর্যন্ত তুচ্ছ করে নিঃস্বার্থ হও এবং কাজ কর। অনন্ত ধৈর্য, অনন্ত পবিত্রতা, অনন্ত অধ্যবসায়, এই তিনটি জিনিস থাকলে যে-কোন সৎ কাজে অবশ্যই সফল হতে পারা যায়; এই হল সিদ্ধিলাভের রহস্য।`

তুমি আজ একটি অধ্যায় পড়, যদি প্রতিদিন এভাবে একটি করে অধ্যায় পড়তে পার তবে ৩৬৫ দিনে ৩৬৫টি অধ্যায় পড়া হবে, কিন্তু একটিবার ভাব, তোমার সবকটি বই একত্রে মিলেও ১০০ অধ্যায় ছাড়াবে না। আবার যদি পড়া আজ না করে কাল করব, আবার কাল ভাবো পড়া আজ না করে কাল করব, তবে ওভাবে পড়া কাল-কাল করে কালের গর্ভে চলে যাবে, কিন্তু তোমার পড়া বা কাজ আর কখনই হবে না। কাজের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। কাজ ফেলে রাখলে কাজ আসতে জমতে পাহাড় হয়ে যায়। সময়ের আগে যে চলতে পারে তারই জয় হয়, সময়ের পরে পৌঁছালে কখনও এগিয়ে যাওয়া যায় না, বরং অনেকক্ষেত্রে সে পৌঁছান কোন কাজেই লাগে না।

যেমন কাজ হচ্ছিল না এক চাষির। `সেবার ভয়ানক অনাবৃষ্টি হয়েছিল। মাসের পর মাস যায়, জল তো দূরের কথা, আকাশে একটুকরো কালো মেঘও দেখা যায় না। দেশে হাহাকার পড়ে গেছে। বৃষ্টির অভাবে মাঠ শুকিয়ে একেবারে খাঁ খাঁ করছে।

মাঠের মাঝখানে ছিল একটা মস্ত পুকুর। যাদের জমি পুকুরের কাছে, তারা পুকুর থেকে নালা কেটে জমিতে জল নিচ্ছে, আর চাষের চেষ্টা করছে।

যাদের জমি পুকুর থেকে অনেকখানি দূরে, তাদেরও দু-একজন জমিতে জল দেওয়ার জন্য চেষ্টা করছে। তারা আজ একটু কাল একটু করে নালা কাটছে। আবার কেউ কেউ আজ এপাশে কাল ওপাশে নালা কাটছে। জমিতে জল নেওয়া আর তাদের হয়ে উঠছে না। তাদের একজন একদিন অনেক বেলা পর্যন্ত নালা কাটছিল। জল নেবার জন্য তার মনে একটু জেদ হয়েছে। এদিকে আসতে দেরি দেখে বাড়িতে চাষির বৌ ভারি চিন্তিত হল। কিছু সময় অপেক্ষা করে সে মাঠে এসে হাজির হল। চাষি বৌ দেখল চাষা একমনে নালা কাটছে। সে কাছে এসে বলল, এতখানি বেলা হল, নাইবার-খাবার নাম নেই, এই রোদে কোদাল মারছ! নাও আজ ঘরে চল, কাল হবে’খন।

চাষা তার বৌয়ের দিকে ফিরে চাইল, তারপর বলল, আরে তুই এসেছিস? তা তুই যখন বলছিস, চল ঘরে যাই। কাল হবে’খন। কিন্তু কাল কাল করে এ চাষারও জল নেওয়া আর হল না।

কোদালখানা কাঁধে করে চাষি রোজ সকালে মাঠে যায়। তার জমি পুকুর থেকে অনেকখানি দূরে। পুকুর থেকে জল নিয়ে চাষ করা, সেও নেহাত সোজা ব্যাপার নয়। পুকুরের পাড়ে বসে বসে ভাবে আর আকাশের দিকে চায়। তার দুটি চোখ ছলছল করে ভেবে কিছু কূল কিনারা পায় না। ছেলেমেয়েগুলো শেষকালে কি না খেয়ে মরবে!

একদিন চাষি সারারাত ভাবল। ক্ষেতের ভাবনায় আর ছেলেমেয়েদের কথা মনে করে সে একদন্ড ঘুমুতে পারল না। শেষকালে তার ভয়ানক জেদ হল, যে করে পারি কাল ক্ষেতে জল আনবই।

পরদিন সূর্য উঠবার আগেই কোদালখানা নিয়ে মাঠে রওনা হল। তারপর পুকুর থেকে জল নেবার জন্য নালা কাটতে আরম্ভ করল। নালা কাটছে তো কাটছেই! এদিকে বেলা দুপুর প্রায় অতীত, মাঠ থেকে চাষারা সব একে একে বাড়ি ফিরে গেছে।

চাষির দেরি দেখে তার বৌ ভারি চিন্তিত হল। সে তার মেয়েকে ডেকে বলল, যা তো মা, একবার মাঠে। এত বেলা হল তবু আসছে না কেন? যা তুই ডেকে নিয়ে আয়।

মেয়ে মাঠে গিয়ে দেখে চাষি একমনে মাটি কাটছে। মেয়ে বলল, বাবা, বাড়ি চল, আজ থাক কাল হবে’খন। ভাত নিয়ে মা বসে আছে।

মেয়ের কথা চাষি শুনল না। অনেক বলে কয়ে চাষি তার মেয়েকে বাড়ি পাঠিয়ে দিল। রোদে যেন মাঠে আগুন বৃষ্টি হচ্ছে। চাষির গা দিয়ে দরদর করে ঘাম পড়ছে। চাষির সেদিকে খেয়াল নেই। সে আজ ক্ষেতে জল নিয়ে তবে ছাড়বে।

আরও কত সময় চলে গেল, তবুও রামু ফিরল না দেখে রামুর বৌ আর স্থির থাকতে পারল না। রামুকে ডাকতে নিজেই সে মাঠে এল। চাষি বৌ এসেছে, চাষি এ কথাটা জানতেও পারেনি। সে শুধু মাটিই কাটছে।

চাষি বৌকে দেখে, চাষি তাকেও বুঝিয়ে বাড়ি ফেরত পাঠাল। বৌ বাড়ি গেলে আবার কাজে মন দিল।

দেখতে কেখতে সন্ধ্যা হয়ে এল। চাষির কাজও প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। নালা কাটা শেষ হয়েছে। চাষি তাড়াতাড়ি পুকুরপাড়ে ফিরে এসে নালার মুখ কেটে দিল! তখন কুলকুল করে জল যেতে লাগল। চাষি পাড়ে দাঁড়িয়ে চাষি খানিকক্ষণ তাই দেখতে লাগল।

তারপর বাড়ি গিয়ে স্নানাহার করে নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ল।’

এই চাষির মত যদি পণ করা যায় যে, যত কষ্টই হোক আর যত সময়ই লাগুক না কেন, হাতের কাজ বা আজকের পড়া শেষ করে তবেই উঠব, তাহলে আমাদের জীবনে ব্যর্থতা বলে কোন শব্দ থাকত না। ব্যর্থতার অপর নাম অলসতা। যে অলস তার ইহকালেও দুঃখ, পরকালেও দুঃখ।

মনে রাখবে, এখনই নয়তো, কখনই নয়। আমার একটি প্রাচীন ছন্দের কথা মনে পড়ছে,
উত্তম কর্ম করিতে বাঞ্ছা যবে হবে।
আলস্য ত্যাজিয়া তাহা তখনই করিবে।
হেলায় রাখিলে পরে করা নাহি হবে।

আমি বহুক্ষেত্রে এ কথার বাস্তব প্রমাণ দেখেছি, নিশ্চয় তোমরাও দেখেছ কাজ ফেলে রাখলে সে কাজটি কীভাবে আর কখনই করা হয় না। একবার চিন্তা কর, তুমি একদিন না খেলে কীভাবে দূর্বল হয়ে যাও। তেমনি একদিন না পড়লে মেধাও দূর্বল হয়ে যায়। যেমন প্রতিদিন গাছ কাটলে লোহার দাঁ আরো ধারালো হয়ে যায় এবং গাছ না কাটলে মরিচা পড়ে নষ্ট হয়ে যায়, মেধাও তেমন। মেধার ব্যবহার না করলে, না পড়ে বা না কাজ করে অলসতায় সময় কাটালে, জানা বিষয়ও মানুষ ভুলে যায়। মনে রাখবে, Practice Makes a Man Perfect, গায়তে গায়তে গায়েন। বলা হয়ে থাকে, কালকের কাজ আজকে কর, আজকের কাজ এখনই করো।

স্বামীজির ভাষায় বলতে হয়,‘কাজ চিরকালই ধীরে ধীরে হয়ে এসেছে, চিরকালই ধীরে হবে; এখন ফলাকাঙ্খা ত্যাগ করে শুধু কাজ করেই খুশি থাক; সর্বোপরি, পবিত্র ও দৃঢ়-চিত্ত হও এবং মনে প্রাণে অকপট হও, ভাবের ঘরে যেন এতটুকু চুরি না থাকে, তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। পিছু দেখতে হবে না, Go Ahead (এগিয়ে চল)। অনন্ত বীর্য, অনন্ত উৎসাহ, অনন্ত সাহস ও অনন্ত ধৈর্য চাই, তবে মহাকার্য সাধন হবে।’

পবিত্রতা, ধৈর্য ও অধ্যবসায় দ্বারা সকল বিঘ্ন দূর হয়। সব বড় বড় ব্যাপার অবশ্য ধীরে ধীরে হয়ে থাকে। সুতরাং কাজ ধীরে হচ্ছে বলে ভয় পেও না, বরং ধীর স্থির ও শান্ত হয়ে, কোন লক্ষ্যকে সফল করতে নিরলস পরিশ্রম করে যাও, নিশ্চয় তুমি লক্ষ্যে পৌঁছাবে, নিশ্চয় তুমি সফল হবে, হবেই হবে। আমি বলছি তুমি সফল হবে, তুমিও বিশ্বাস করো তুমি সফল হবে, তাহলেই হবে। চলবে