বিশ্বজয়ী হও

পর্ব ১১

অমিত কুমার কুণ্ডু

প্রকাশিত : জুলাই ০৬, ২০২০

একবার ভাবো, পাঁচ মিনিটের জন্য একটি দূরপাল্লার ট্রেন ফেল হয়ে গেলে কত ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয় পুনরায় ওই স্থানের ট্রেন পাবার জন্য! আর কত ভোগান্তিই না পোহাতে হয় তখন! জীবনটি এমনই, সময়ের কাজ ঠিক সময় মতো করতে না পারলে জীবনটা এলোমেলো, বিপর্যস্ত ও ব্যর্থ হয়ে যায়।

যেমন প্রাতঃকাল ধর্ম-কর্মের কাল, মধ্যাহ্ন কাল অর্থ উপার্জনের কাল, এবং রাত্রকাল নিদ্রা যাপনের কাল। যদি তুমি মনে করো, আমি রাত্রে না ঘুমিয়ে কাজ করব, তবে তুমি একদিনেই অসুস্থ হয়ে যাবে, কারণ প্রকৃতি ঘুমানোর জন্য রাতকেই নির্দিষ্ট করে রেখেছে।

ইউটিলিটি সার্ভিস (যেমন- জল, বিদ্যুৎ, গ্যাস), নিরাপত্তা, পরিবহন, হাসপাতাল ইত্যাদি বিশেষ বিশেষ পেশার মানুষজন ছাড়া, রাত্রে কোনো সাধারণ মানুষ কাজ করে না। তেমনি প্রাতঃকালে তুমি যত স্নিগ্ধতার সাথে শান্ত চিত্তে প্রার্থনা করতে পারবে, দুপুরের কোলাহলে অর্থাৎ কর্মব্যস্ত দুপুরে তা কখনই সম্ভব নয়। অর্থাৎ সমস্ত কাজের একটি সময় আছে এবং এই সময়ের কাজ সময় মতো করার নামই সময়ানুবর্তিতা।

অ্যালবার্ট বার্নেট বলেছেন, ‘সকালে ঘুম ভাঙলেই দেখতে পাবে, কোনো জাদু বলে যেন তোমার ব্যাগটি ভরে গিয়েছে, তাতে জমা রয়েছে চব্বিশটি ঘণ্টা-সব চেয়ে মূল্যবান সম্পদ। এখন কিভাবে এই সম্পদকে তুমি কাজে লাগাবে তা নির্ভর করছে তোমারই উপর।’

তোমরা যারা শিক্ষার্থী, তোমরা সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠবে। সকাল সকাল পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে পড়তে বসবে। পড়া শেষে স্নানাহার সেরে স্কুলে যাবে। আবার বিকালে স্কুল থেকে ফিরে মাঠে বা বাড়ির আঙিনায় খেলবে বা কমপক্ষে আধা ঘণ্টা হাঁটবে। খেলা বা হাঁটা শেষে সন্ধ্যা হবার পূর্বেই ঘরে ফিরবে। এরপর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে সন্ধ্যা হবার পরপরই প্রার্থনা করতে বসবে। প্রার্থনা (জপ-ধ্যান বা স্ব স্ব ধর্ম মতো অনুসারে) দ্বারা দেহ মনে শক্তি জাগে, পড়াশুনায় মনোনিবেশ ভাল হয়। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যা (বা স্ব স্ব ধর্ম মত অনুসারে) প্রার্থনা শেষে একটু ধর্মীয় গ্রন্থ পড়ে নিয়ো। তবে খেয়াল রেখো, এক এক বারে প্রার্থনা ও ধর্মীয় গ্রন্থ পড়া বাবদ যেন আধা ঘণ্টার বেশি সময় ব্যয় না হয় এবং ধর্মচর্চা যেন ধর্মান্ধের মতো না হয়। ধর্মচর্চার প্রাথমিক উদ্দেশ্য সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস, নীতিশিক্ষা, পরমতসহিষ্ণুতা, মানসিক প্রশান্তি ও একাগ্রতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা উচিত। কখনই অপর ধর্মে অশ্রদ্ধা বা অসহিষ্ণুতার মধ্যে নিয়ে যাওয়া উচিত হবে না।

এ প্রসঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন, ‘যত লোক দেখি, ধর্ম ধর্ম করে এ ওর সঙ্গে ঝগড়া করছে, ও ওর সঙ্গে ঝগড়া করছে। হিন্দু, মুসলমান, ব্রহ্মজ্ঞানী, শাক্ত, বৈষ্ণব, শৈব, সব পরস্পর ঝগড়া। এ বুদ্ধি নাই যে, যাঁকে কৃষ্ণ বলছ, তাঁকেই শিব, তাঁকেই আদ্যাশক্তি বলা হয়; তাঁকেই যীশু, তাঁকেই আল্লা বলা হয়। এক রাম তাঁর হাজার নাম।(যেমন পুকুরে জল আছে, এক ঘাটের লোক বলছে জল, আর এক ঘাটের লোক বলছে ওয়াটার, আর এক ঘাটের লোক বলছে পানি, হিন্দু বলছে জল, খ্রিস্টান বলছে ওয়াটার, মুসলমান বলছে পানি, কিন্তু বস্তু এক।) এরকম মনে করা ভাল নয় যে, আমার ধর্ম ঠিক, আর অন্য সকলের ধর্ম ভুল। সব পথ দিয়েই তাঁকে পাওয়া যায়। আন্তরিক ব্যাকুলতা থাকলেই হল। অনন্ত পথ, অনন্ত মত।’ তিনি আরও বলতেন, ‘যে ধর্মই হোক, যে মতই হোক, সকলেই সেই এক ঈশ্বরকে ডাকছে; তাই কোনও ধর্ম, কোনও মতকে অশ্রদ্ধা বা ঘৃণা করতে নেই। সব ধর্মই সত্য।’

এমনকি যারা বিশ্বাসী নয়, তাদেরকেও তাদের মতো থাকতে দেয়া উচিত। কারো প্রতি বিদ্বেষ নয়, সকলের প্রতি ভালোবাসার নামই শান্তি। সকলের প্রতি প্রেমের নামই কল্যাণ। সুতরাং আমাদের কল্যাণের দিকে যেতে হবে। আমাদের শান্তির পথে হাঁটতে হবে। পরমতসহিষ্ণু হলে পৃথিবীটা স্বর্গ হয়ে যায়। পৃথিবীটা বাসযোগ্য হয়।

বন্ধুরা, মনকে এভাবে উদার করে প্রার্থনা করলে তোমার মনে আসবে প্রশান্তি আর জীবনে আসবে শান্তি। তখন তুমি খুব সহজেই সব কাজ শেষ করতে পারবে। তাই প্রার্থনা শেষ হবার পর এক গ্লাস দুধ বা একটু হালকা কিছু খেয়ে পুনরায় পড়তে বসবে এবং রাত্রে খাবার পর পুরাতন পড়া রিভিশন দিয়ে আগামীকালের কাজের একটা পরিকল্পনা তৈরি করে ঘুমিয়ে পড়বে। যারা এখন শিক্ষার্থী নয়, তাদের নিজের নিজের কাজে পূর্ণ মনোযোগ দেওয়া উচিত। পরিপূর্ণ মনোযোগ দিলে সব সমস্যারই সমাধান আসে।

একবার ভাব এই সব সময়ের কাজ সময় মত না করে, তুমি যদি সকালে দেরি করে ঘুম থেকে ওঠ। স্কুলে না যেয়ে বন্ধুদের নিয়ে ঘুরতে যাও। সন্ধ্যায় পড়তে না বসে যদি টিভি দেখ, কিংবা বিকালে না খেলা করে যদি ঘুমাও। তবে আমি নিশ্চিত বলতে পারি; তুমি নিমেষেই ধ্বংস হয়ে যাবে এবং তোমার অবস্থান হবে সমাজের আস্তাকুড়ে। যেমন প্রতিদিনের পড়া প্রতিদিন পড়লে পরীক্ষায় এমনিতেই ভাল রেজাল্ট হয়, তেমনি সারা বছর না পড়ে পরীক্ষার পূর্বে এক সপ্তাহ দিনরাত একাকার করে পড়লেও ভাল রেজাল্ট হয় না। যেমন সুস্থ থাকতে চাইলে প্রতিদিনের খাবার প্রতিদিন খেতে হয়, একদিনে এক মাসের খাবার খেয়ে রাখা যায় না। আবার এক মাস পর একদিন খেয়েও জীবন বাঁচে না। তেমনি প্রতিদিনের পড়া প্রতিদিন না পড়ে পরীক্ষার পূর্বে সব পড়ে শেষ করতে চাইলে ফল হয় শূন্য। কাজের ক্ষেত্রেও কথাটার কোন ব্যতিক্রম নেই।

জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রেও সময়ের গুরুত্ব অসীম। প্রবাদ আছে,‘সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়।’ সময়মত শুরু না করলে, তা পড়াশুনা হোক, ব্যবসা, চাকরী বা বিয়ের তোড়জোড়, জীবনটা ওলটপালট হয়ে যায়। প্রতিদিন সূর্য উঠছে আবার অস্ত যাচ্ছে। এভাবে দেখতে দেখতে চোখের নিমিষে দিন, সপ্তাহ, মাস, বছরের পর বছর চলে যায়। চলে যায় নিষ্পাপ শৈশব থেকে দূরন্ত কৈশর। ফেলে আসি দামাল যৌবনের অমূল্য সব সময়।

জীবনের প্রতিটি ধাপের কাজ ভিন্ন, প্রত্যাশা ভিন্ন, প্রাপ্তিও ভিন্ন। এখন যা না করতে পারবে, ভবিষ্যৎ এ তা করার জন্য সময় পাবে না। কারণ ভবিষ্যতেও করার জন্য অনেক কাজ অপেক্ষা করছে। তাই যে সময় আজ হারাচ্ছ, তা চিরকালের জন্য হারাচ্ছ। জীবন গঠনে সময়ানুবর্তিতার গুরুত্ব অসীম।

জীবনের সবক্ষেত্রে সব কাজ ঠিকঠাক সুনিপুন ভাবে সম্পাদন করার জন্য চাই সময়ানুবর্তিতা। কাজ ঠিকঠাক ভবে সম্পাদনা করার ফলেই জীবনে আসে সফলতা। তাই, যদি সফল হতে চাও; অলসতা ত্যাগ কর, ওঠ, বীরদর্পে সব কাজ সময়মত শেষ কর। আমি বলছি তুমি সফল হবেই হবে, তুমিও বিশ্বাস করো তুমি সফল হবে। তোমার আত্মবিশ্বাস জাগ্রত হলে, তুমি নিশ্চয় জয়ী হবে। হবেই হবে। চলবে