
বিশ্বজয়ী হও
পর্ব ১৩
অমিত কুমার কুণ্ডুপ্রকাশিত : জুলাই ১১, ২০২০
তুমি বহু কষ্টে সফল হলে কিন্তু যদি নীতিপরায়ণ না হও তবে তোমার সমস্ত অর্জন অনৈতিকতার অন্ধকারে বিসর্জন হয়ে যাবে। আমি একজন বনরক্ষককে চিনি, যিনি সফল হতে হতে তার দপ্তরের প্রধান পর্যন্ত হয়েছিলেন, কিন্তু পরিশেষে দুর্নীতির দায়ে তাকে কারাগারের অন্ধকারে জীবন কাটাতে হয়েছিল। ওই বনরক্ষককে সকলেই সম্মান করেছিলেন, সকলেই সফল বলেছিলেন, যখন তিনি স্বীয় পদে আসীন ছিলেন। কিন্তু যখন তার অনৈতিকতার বিষয়টি জনসম্মুখে প্রকাশ পেল, তখন সকলেই তার নাম স্মরণ করে ঘৃণার বিষবাষ্প নিক্ষেপ করেছে। তাইতো আমরা যদি সত্যই চিরকালের মতো বড় হতে চাই, অমর হতে চাই, তবে স্বামীজি ভাষায় বলতে হয়, ‘বড় হইতে গেলে কোনো জাতির বা ব্যক্তির পক্ষে এই তিনটি প্রয়োজনঃ
১. সাধুতার শক্তিতে প্রগাঢ় বিশ্বাস।
২. হিংসা ও সন্দিগ্ধভাবের একান্ত অভাব।
৩. যাহারা সৎ হইতে কিংবা সৎ কাজ করিতে সচেষ্ট, তাহাদিগের সহায়তা।’
বন্ধুরা, আমরা বড় হয়েও যদি সাধুতার শক্তিতে বিশ্বাস না করে অসাধু হই, আমাদের মনে যদি হিংসা ও সন্দিগ্ধভাব থাকে এবং যারা সৎ হতে বা সৎ কাজ করতে চাই তাদেরকে সাহায্য না করে অসহযোগিতা করি, তবে মানব সমাজে আমরা খারাপ মানুষ হিসাবে পরিগণিত হব। তখন সামনে ভয় পেয়ে সম্মান করলেও, পেছনে কেউ আর আমাদের সম্মান করবে না।
যেমন, একজন অধ্যক্ষ যখন পাগল হয়ে যায় তখন কেউই তাকে অধ্যক্ষ বলে না, পাগল বলে। তেমনি একজন সফল ব্যক্তি যখন সকলের অশ্রদ্ধার পাত্র হয়ে যায়, তখন তিনি আর সফল থাকেন না, তার পদস্খলনের সাথে সাথেই তিনি ব্যর্থ অসফল ব্যক্তিতে পরিণত হন। ধরুণ আপনি পৃথিবীতে সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত হলেন কিন্তু সকলেই আপনাকে দুর্জন ভাবতে থাকল, এসব বলতে থাকল, তাহলে ওই সম্মানের কি মূল্য থাকল? প্রবাদে আছে, ‘দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য।’ মনে রেখো, সফল হওয়া খুব সহজ, কিন্তু তাকে ধরে রাখা খুব কঠিন।
স্বামীজির ভাষায়,‘সামাজিক বা রাজনীতিক সকল বিষয়ের সফলতার মূলভিত্তি মানুষের সততা। পার্লামেন্ট কর্তৃক বিধিবদ্ধ কোনো আইন দিয়ে কখনও কোনো জাতি উন্নত বা ভালো হয় না, কিন্তু সেই জাতির অন্তর্গত লোকগুলি উন্নত ও ভালো হলেই জাতির ভাল হয়ে থাকে।’
বন্ধুরা, পৃথিবীর প্রতিটা দেশেই অসংখ্য অইন আছে, আছে আইনের ফাঁক-ফোঁকড়ও, তাই আইন দিয়ে নয়, মানুষের অন্তর্নিহিত মূল্যবোধকেই জাগিয়ে তুলতে হয়। যদি সে বোধ জাগে তবে স্থায়ী উন্নতি হয় ব্যক্তির, ব্যক্তির সমষ্টিই যেহেতু জাতি, তাই উন্নতি হয় জাতিরও।
এজন্য আমাদের নীতিপরায়ণ হতেই হয়, নতুবা সব অর্জন বিসর্জন হয়ে যায়। প্রমাণ স্বরূপ তোমরা তোমাদের চারপাশে তাকিয়ে দেখলে এরকম অনেককেই দেখতে পাবে, যারা জীবনে সফল হয়েছেন। কিন্তু ক’জন তাদের নাম মনে রেখেছে! ক’জন তাদের স্মরণ করে! তাদেরকে মানুষ মনে রাখেনি, কারণ তারা শুধু সফল হয়েছিলেন, মহৎ হননি।
প্রথমে মানুষ হতে হয়, তারপর সফল হতে হয়, পরিশেষে হতে হয় মহৎ; এবং এই মহৎ হতে হলে সম্পূর্ণ নীতিপরায়ণ সত্যনিষ্ঠ হতে হবে। তুমি তখনই নীতিপরায়ণ হচ্ছ বোঝা যাবে যখন তোমার শত্রুও বলবে তুমি সৎ। তুমি তখনই ধার্মিক হচ্ছ বোঝা যাবে যখন তুমি সম্পূর্ণ রূপে স্বার্থত্যাগী হবে। আমাদের এহেন অবক্ষয়ের কারণ কি? উত্তর পাবে দুর্নীতি। এ দুর্নীতির কারণ কি? উত্তর পাবে দেশপ্রেমের অভাব। এ দেশপ্রেমের ঘাটতি কি কারণে? উত্তর পাবে নীতিশিক্ষার অভাব।
স্বামীজির ভাষায়, ‘নাহং নাহং, তুঁহু তুঁহু’, এটিই নীতিশাস্ত্রের চিরন্তন বাণী। নীতিশাস্ত্রের উপদেশ, স্বার্থ নয়, পরার্থ।’ নীতিশাস্ত্র বলে, সেই অনন্ত শক্তি বা অনন্ত সুখকে ইন্দ্রিয়ের মধ্য দিয়ে লাভ করতে মানুষ নিজের স্বাতন্ত্র্য সম্বন্ধে একটা যে মিথ্যা ধারণা আঁকড়ে থাকে, তা ত্যাগ করতেই হবে। নিজেকে সর্বপশ্চাতে রেখে অন্যকে প্রাধান্য দিতে হবে। ইন্দ্রিয়গুলি বলে, ‘আমারই হবে প্রথম স্থান।’ নীতিশাস্ত্র বলে, ‘না, আমি থাকব সর্বশেষে।’ সুতরাং সকল নীতিশাস্ত্রই এই ত্যাগের, জড়জগতে স্বার্থবিলোপের উপর প্রতিষ্ঠিত, স্বার্থরক্ষার উপর নয়।’
তাইতো, যেখানে মানুষ স্বার্থপরের মত শুধু নিজেরটাই ভাবে না, নিজের উন্নতির পাশাপাশি সম্মিলিত উন্নতির কথাও ভাবে, যেখানে নীতিশিক্ষা আছে, যেখানে গুণীর সমাদার আছে, যেখানে আইনের শাসন আছে এবং সেখানে মানুষের পরিচয় হয় সে শুধু মানুষ, সেখানে কেও কখনও পিছিয়ে থাকতে পারে না।
পুরাতন খরগোশ ও কচ্ছপের গল্পে খরগোশ বিশ্রাম নেয়াতে কচ্ছপ জয়ী হয়েছিল। সেখানে কোনো নদী ছিল না। নতুন গল্পে নদী আছে এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পৌঁছানোর শর্ত আছে। এখানে খরগোশ বিশ্রাম নেয় নি, বরং সাঁতার না জানাতে নদীর পারে আটকে যায়। অন্যদিকে কচ্ছপ সাঁতার জানাতে নদী সাঁতরে গন্তব্যে পৌঁছায়, কিন্তু ধীরে পৌঁছানোর কারনে সে ও ডিসকোয়ালিফাইড হয়। পক্ষান্তরে কেউ জয়ী হতে পারে না।
এখন নতুন গল্প শেখাচ্ছে, যদি এমন হয়, খরগোশ কচ্ছপকে পিঠে নিয়ে দ্রত নদীর ধারে পৌঁছায়, এরপর কচ্ছপ খরগোশকে পিঠে নিয়ে নদী পার হয় এবং পুনরায় খরগোশ কচ্ছপকে পিঠে নিয়ে দ্রুত দৌড়ে গন্তব্যে পৌঁছায়, তাহলে দুজনেরই জয় হয়। দুজনই প্রথম হয়।
এখন বলা হয়, সমাজের সবাই মিলে একত্রে উন্নত না হলে সামাজিক মস্তিষ্কের উন্নতি হয় না। আর সামাজিক মস্তিষ্কের উন্নতি না হলে, নিজে উন্নত হলেও সমাজে বা নিজের জীবনে তা ফলপ্রসু হয় না। তাই আমাদের সকলকে সাথে নিয়ে উন্নত হতে হয়। এর জন্য দরকার হয় পারস্পরিক সহযোগিতা। একজন ব্যক্তি সব বিষয়ে দক্ষ হয় না, কিন্তু বিভিন্ন বিষয়ের দক্ষ দশজন মানুষ এক প্লাটফর্মে এলে সমাজটাই বদলে যায়। কাজটাই সর্বাঙ্গিন সুন্দর হয়ে ওঠে।
আর এই দশজন মানুষ এক জায়গায় তখনই মিলিত হবে যখন তারা নীতিগতভাবে এক হবে। স্বামী বিবেকানন্দের ভাষায়, ‘নীতিপরায়ণ ও সাহসী হও, হৃদয়ে ভয় পর্যন্ত রেখো না। ধর্মের মতামত নিয়ে মাথা বকিও না। কাপুরুষেরাই পাপ করে থাকে, বীর কখনও পাপ করে না। মনে পর্যন্ত পাপ চিন্তা আসতে দেয় না।’
তোমরাও কখনও মনে পাপ চিন্তা আসতে দিও না। ভেবে দেখ-আমরা সকলেই যদি সৎ হয়ে যায়, যদি আমরা সকলেই কর্মবীর হয়ে যায়, তবে এ দেশকে সবার সেরা করতে, আমাদের সাধের সোনার বাংলা গড়তে মাত্র কয়েকটি দিনের প্রয়োজন। আমি বিশ্বাস করি তোমরা সকলেই সফল হবে, বিশ্বাস করি তোমাদের মাঝে কখনই নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটবে না। এ বিশ্বাস বলেই বলছি, যদি এমনটিই হয়, তবে কেন তোমরা জগদ্বিখ্যাত হবে না?
আমদের মা- বাবা স্বপ্ন দেখে সন্তান ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হোক, কেউ কেউ স্বপ্ন দেখে সন্তান জগদ্বিখ্যাত হোক কিন্তু খুবই কমসংখ্যক জন স্বপ্ন দেখে সন্তান মহৎ হোক। কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, তোমরা শুধু জগদ্বিখ্যাতই হবে না। তোমরা মহৎও হবে। মানবীয় গুণাবলির প্রবাদ পুরুষ হবে তোমরা। তোমরা হবে সমাজের এক একটি নক্ষত্র। নিজে আলো হয়ে আলোকিত করবে সমস্ত চরাচর।
স্বামীজি বলতেন, ‘সৎ হও ও সৎ কার্য কর। সমুদয় নীতিপ্রণালীর তাৎপর্য কি? সকল নীতিপ্রণালীতে একটি মূল ভাবই ভিন্ন ভিন্ন আকারে প্রকাশিত হয়েছে, ভাবটি, অপরের উপকার করা। মানবজাতির সকল সৎকর্মের মূল উদ্দেশ্য: মানুষ, জীব, জস্তু, সকলের প্রতি দয়া।’
শুধু দয়া নয়, বন্ধুরা, ভালবাসা, মানুষকে যদি সত্যিকার ভালবাসতে পার, তখন দেখবে তোমাদের চিন্তা হবে মানুষকে নিয়ে, তোমাদের ভাবনা হবে মানুষকে নিয়ে। পৃথিবীর সমস্ত গরীব, অসহায়, দুঃখী মানুষ হবে তোমাদের ভাই। তোমরা অশিক্ষিতদের শিক্ষা দেবে। অনাহারীদের অন্ন দেবে। পৃথিবীকে স্বর্গে পরিণত করবে তোমরা। তোমাদের পরিচয় হবে ‘তোমরা মানুষ’। মনে রেখ-‘সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’
স্বামীজি ভাষায়, ‘পরোপকারই ধর্ম, পরপীড়নই পাপ। শক্তি ও সাহসিকতাই ধর্ম, দুর্বলতা ও কাপুরুষতাই পাপ। স্বাধীনতাই ধর্ম, পরাধীনতাই পাপ। অপরকে ভালবাসাই ধর্ম, অপরকে ঘৃণা করাই পাপ। ঈশ্বর এবং নিজ আত্মাতে (স্ব-স্বরূপে) বিশ্বাসই ধর্ম, সন্ধেহই পাপ। অভেদ-দর্শনই ধর্ম, ভেদ দর্শনই পাপ।’
বন্ধুরা, তোমরাও কোন ভেদাভেদ না করে, নিজ মূল্যবোধ, নিজ নৈতিকতা অক্ষুন্ন রাখলে তোমাদের সফলতা কে আটকাবে? আর কেই বা মুছতে পারবে তোমাদের কীর্তিগাথা। তোমরা হবে এ পৃথিবীর সফলতম ব্যক্তি। তোমরাই হবে বিশ্বজয়ী। চলবে