বিশ্বজয়ী হও

পর্ব ১৪

অমিত কুমার কুণ্ডু

প্রকাশিত : জুলাই ১৩, ২০২০

যে পথ চেনে তার থেকেই পথের দিশা নিতে হয়। পথিক বলতে পারে এ পথের শেষ কোথায়। প্রতিদিন যেসব কাজ আমরা করি বিশ্বজয়ীরাও কি সে সব কাজ করত? যে খেলোয়ার খুব ভালো খেলে, সে কী করে প্রতিদিন? কীভাবে খেলে?

বিজ্ঞানী নিউটন কেমন ছিলেন? সক্রেটিস কী করতেন? ইত্যাদি প্রশ্ন হয়তো আমাদের মনে আসে। আমরা জানি, স্কুল পালালেই রবীন্দ্রনাথ হওয়া যায় না। কারণ রবীন্দ্রনাথ স্কুলে যেতে না চাইলেও তিনি পড়েননি এমন নয়। জ্ঞান সাধনা তিনি করেছেন নিরন্তর। আমরা যখন সফল ব্যক্তির কথা শুনি, আমরা যখন সফল ব্যক্তিকে জানতে পারি, তখন আমরাও বুঝতে পারি সাফল্য কী? সফলতা কী? সাফল্য-সফলতা তাদের জীবনে কত কাঠখড় পুড়িয়ে এসেছে, তাও বুঝতে পারি।

তাইতো বিশ্বজয়ীর জীবনী পাঠ আমাদেরকে অনুপ্রেরণা দেয়। তাদের ধৈর্য আমাদের ধৈর্য ধরতে শেখায়, তাদের ইচ্ছাশক্তির গল্প আমাদের ইচ্ছাশক্তিকে দৃঢ় করে। তাদের পঠন-পাঠন আমাদের পঠন-পাঠনে উৎসাহ দেয়। তাদের জীবে প্রেম আমাদেরকে মহৎ মানুষে রূপান্তরিত করতে সাহায্য করে। তারা তাদের জীবন দিয়ে, জীবনের কর্ম দিয়ে, আমাদের উদ্বুদ্ধ করে।

বিশ্বজয়ীদের জীবনী পাঠে যে সব সাধারণ বিষয়গুলো আমরা লক্ষ্য করি, তারমধ্যে ঘুম অন্যতম। বিশ্বজয়ীদের প্রায় সবার সকাল সকাল ঘুমিয়ে পরা এবং সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে পরাটা পছন্দের। নিয়মিত বই পরা, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের নোট রাখা, সময় মেনে খাওয়া, প্রতিদিন নতুন কিছু শেখা, সস্তা বিনোদন এড়িয়ে চলা, রাত্রে ঘুমাতে যাবার পূর্বে পরের দিনের কাজের পরিকল্পনা করে রাখা এবং নিয়মিত ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রম করাও একইভাবে তাদের পছন্দের। তারা পছন্দ করেন জ্ঞানী ব্যক্তির সান্নিধ্য। লালন করে উন্নত ব্যক্তিত্ব। তারা তাদের জীবন ও কর্ম দিয়ে বুঝিয়ে দেয় কী করা উচিত, আর কী করা উচিত নয়। এভাবে তাদের জীবনী হয়ে উঠে একটি মূল্যবান গ্রন্থ।

মাও সে তুং, মার্টিন লুথার কিং, মহাত্মা গান্ধী কিংবা বঙ্গবন্ধু, এদের জীবনী থেকে পাই নেতা হবার শিক্ষা। সেই পুরাকালের বাল্মিকী থেকে রবীন্দ্রনাথ, শেক্সপিয়ার, শেখ সাদী হয়ে আজকের হুমায়ূন, এদের জীবনী থেকে পাই সাহিত্যিক হবার শিক্ষা। স্যার হ্যানিম্যান থেকে আজকের দেবী শেঠী এরা শেখায় ডাক্তার কেমন হওয়া উচিত। টেন্ডুলকার, লারা থেকে আজকের শাকিব শেখায় ক্রিকেটার কেমন করে হতে হয়।

কী সাহিত্য, কী বিজ্ঞান, কী রাজনীতি, কী ধর্ম; সর্বদা মানুষের গল্প, মানুষের জীবনের গল্প। ইতিহাস থেকে উপন্যাস সবখানে মানুষের উত্থান-পতনের গল্প। মানব জীবনের গল্প। মানুষের জীবনী ও কর্ম সম্পর্কে জানলে যত অনুপ্রেরণা পাই, তত অনুপ্রেরণা আর কোনো বই, এমনকি গোটা লাইব্রেরিও আমাদের দিতে পারে না। সে কারণেই সময় পেলেই আমাদের সেই সব মহৎ হৃদয়ের, সেই সব মহা বিজ্ঞানী, কিংবা জগৎবিখ্যাত মানুষের জীবনী পাঠ করা উচিত, যাদের কর্মের দ্বার আজকের এই আধুনিক সমাজ পরিচালিত হচ্ছে।

আমাদের পূর্বসুরীদের সম্পর্কে আমরা যত বেশি জানবো, তত বেশি আমরা বুঝতে সক্ষম হব, বিনা পরিশ্রমে, বিনা ক্লেশে এ পৃথিবী বর্তমানের এ অবস্থায় আসেনি। অসংখ্য মানুষের ত্যাগ, অধ্যবসায় আর নিরন্তর কর্মের মধ্যদিয়েই এ পৃথিবী আজকের এ রূপ পেয়েছে। পৃথিবীর সমস্ত মহা মানব ছিলেন উদার, তারা নিজেদের কর্ম ও ত্যাগ সবার মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছেন। যুক্তরাষ্টের অরভিল রাইট ও উইলবার রাইট ১৯০৩ সালে যে উড়োজাহাজ আবিষ্কার করেছিলেন তার সুফল আজ সবাই পাচ্ছে। সাধু-অসাধু, সাদা-কালো, হিন্দু-মুসলমান সবাই পাচ্ছে। তিনি তার অবিষ্কারকে নিজের মধ্যে রাখেননি, বা নিজের জন্য করেননি। করেছিলেন জগতের কল্যাণের জন্য, সমগ্র মানব জাতির জন্য।

যেমন সূর্য সকলকে তাপ দেয়, কোনো ভেদাভেদ করে না, বৃষ্টি সকলকে ভেজায় কোনো ভেদাভেদ করে না, নদী সকলকে জল দেয়, একই ভাবে সাগর সমস্ত পৃথিবীবিধৌত জল নিজের বক্ষে ধারণ করে। এরা মহৎ, এদের মধ্যে পক্ষপাতিত্ব নেই, তাই এরা বড়, তাই এরা বিশ্বজয়ী। বিশ্বজয়ীদের জীবনী থেকে আমরা জানতে পারি, যদি বিশ্বজয়ী হতে চাও, তবে আগে ভেদাভেদ ত্যাগ কর। সংকীর্ণতা ত্যাগ করো। উদার হও। অসাম্প্রদায়িক হও। চেতনা দীপ্ত হও।

যে বিদ্যুই ছাড়া পৃথিবী অচল, ১৫৭০ সালে যুক্তরাজ্যের বিজ্ঞানী উইলিয়াম গিলবার্ট যখন সেই বিদ্যুৎ আবিষ্কার করলেন তখন কী তিনি এটা শুধু নিজের জন্য, নিজের সুখের জন্য আবিষ্কার করেছিলেন? না, তিনি তা করেননি, তিনি করেছিলেন সকলের জন্য। সমগ্র মানব জাতির জন্য। তাই তিনি বিশ্বজয়ী। তাই তিনি অমর। তিনি কেন অমর, কী জন্য বিশ্বজয়ী সে শিক্ষা আমরা তার জীবনী থেকেই পেয়েছি।

এভাবে আমরা যত মনিষীদের জীবনী পাঠ করি, যত বিশ্বজগৎ ও তার শ্রেষ্ঠ সন্তানদের সৃষ্টিকর্ম সম্পর্কে জানতে পারি ততই আমাদের চোখ থেকে কূপমণ্ডুকতার পর্দা সরে যেতে থাকে। ততই আমাদের জগৎ ও এ জগতে বসবাসরত সকল প্রাণীকূলকে নিজের একান্ত আপন মনে হয়। যারা ভেদাভেদ করে তারা তাদের অজ্ঞানতা থেকেই করে। সীমাবদ্ধ জ্ঞান থেকেই করে। এ তাদের অজ্ঞতা। এ প্রসঙ্গে স্বামীজির কথা ও গল্পে একটি সুন্দর গল্প আছে। গল্পে, ‘সাগর থেকে একটু দূরে একটি কুয়ো ছিল। তাতে বাস করত এক মোটা কালো ব্যাঙ। কুয়োতেই তার জন্ম হয়েছিল। আর জন্মের পর থেকে কুয়োতেই তার বাস। একদিনের জন্যও সে কুয়োর বাইরে আসেনি। বাইরের জগৎটা যে কি রকম তা সে জানত না। তবুও সে নিজেকে সবজান্তা বলেই মনে করত। শুধু মনে করত নয়, প্রাণের সহিত সে তা বিশ্বাস করত।

কুয়োর জলের সব পোকা আর ছোট ছোট মাছ ধরে সে খেত। সে যখন লম্ফ ঝম্ফ করে জলের উপর সাঁতার কেটে বেড়াত, তার হাবভাব দেখে মনে হত সে একজন কম নয়। উপর থেকে মাঝে মাঝে যে সব পোকা মাকড় কুয়োয় পড়ত সেগুলোও সে ধরে ধরে খেত। একটা সাগরের ব্যাঙ একদিন সাগরের তীরে বেড়াচ্ছিল। বেড়াতে বেড়াতে সে কুয়োর কাছে এসে উপস্থিত হল আর হঠাৎ কুয়োর মধ্যে পড়ে গেল। কুয়োর ব্যাঙ ভাবল বুঝি একটা মস্ত বড় শিকার পড়েছে। লাফ দিয়ে যেমনি সে শিকারের উপর পড়ল, দেখে-ওমা, এ যে তারই মত আর একটি ব্যাঙ। ভয়ে সে তিন হাত দূরে লাফিয়ে পড়ল। সম্মান বাঁচাবার জন্য বাইরে সে এরূপ ভান করল, যেন সে সাগরের ব্যাঙকে গ্রাহ্যই করে নি।

জন্মের পর থেকে কুয়োর ব্যাঙ আর অন্য কোন ব্যাঙ দেখেনি। নতুন ব্যাঙটা তার মতো কালো নয়। তার গায়ে আবার নানা রঙ-বেরঙ দেখে কুয়োর ব্যাঙ অবাক হয়ে গেল আর বেশ একটুখানি ভয়ও পেল। সাগরের ব্যাঙ কিন্তু চুপ করে মজা দেখতে লাগল। সাগরের ব্যাঙকে দেখে কুয়োর ব্যাঙ মনে মনে বড় অশান্তি বোধ করতে লাগল। খুব গম্ভীর হয়ে মোটা গলায় সে সাগরের ব্যাঙকে জিজ্ঞেস করল, বলি বাপু হে, তোমার আগমন হচ্ছে কোত্থেকে?
আমার আগমন হচ্ছে সাগর থেকে।
সাগর থেকে? সাগর আবার কি বস্তুহে।
সাগর জলে জলময়। যেদিকে চাও, শুধু জল আর জল!
জলে জলময়। তাহলে তোমার সাগরটা কি আমার কুয়োর মতো?
তুমি কি পাগল নাকি? কি করে তুমি সাগরের সঙ্গে কুয়োর তুলোনা করছ?
আহা চট কেন? তা হলে তোমার সাগর কি এত বড়?

এই বলে কুয়োর ব্যাঙ এক লাফ দিল। সাগরের ব্যাঙ উত্তর করল, তুমি একটা আস্ত মুর্খ, কিসের সঙ্গে কিসের তুলনা করছ। কোথায় সাগর আর কোথায় তোমার কুয়ো!

আহা চট কেন বাপু! বলই না? তোমার সাগর তাহলে এত বড়?
এই বলে কুয়োর ব্যাঙ আর একটু জোরে লাফ দিল। মূর্খের সঙ্গে কথা বলে লাভ নেই। সাগরের ব্যাঙ চুপ করে রইল। তখন কুয়োর ব্যাঙ কুয়োর একধার থেকে অন্যধার পর্যন্ত লাফ দিয়ে বলল, ওগো নতুন দাদা, তোমার সাগরটা কি তাগলে আমার কুয়োর মতই বড়?
তুমি একটা গাধা। তোমার এ কুয়োর মত কোটি কোটি কুয়ো একত্র করলেও সাগরের এক কোণার সমান হবে না।
কি? তোমার সাগর আমার কুয়োর চেয়েও বড়? তা হতেই পারে না। আমাকে সোজা ভাল মানুষ পেয়ে ঠকাতে এসেছ। তুমি একটা জোচ্চোর। আমার কুয়োর চেয়ে বড় জিনিস দুনিয়াতে আর কিছু নেই, থাকতে পারে না। একথা আমি ভাল করেই জানি, প্রাণের সহিত বিশ্বাস করি। তুমি মিথ্যাবাদী, যাও পালাও এখান থেকে।

সাগরের ব্যাঙ বলল, তোমার কুয়োটি ছেড়ে একটু উপরে উঠে এস না ভায়? বেশি দূর যেতে হবে না, কাছেই সাগর। সাগর দেখলেই বুঝতে পারবে, আমার কথা সত্যি না মিথ্যে, আর তুমি একটা মূর্খ কি না।
না বাপু, তোমার সাগর দেখে আমার কাজ নেই। আমার এতখানি বয়স হল জন্ম থেকে একদিনও সাগর দেখলুম না, আর আজ তুমি এসেছ আমাকে সাগর দেখাতে! যাও যদি ভাল চাও তবে শিগ্গির পালাও বলছি।

সাগরের জল দেখলে, মূর্খের সঙ্গে কথা বলা বোকামি। ধীরে ধীরে সে কুয়ো থেকে উঠে সাগরের দিকে চলে গেল। কুয়োর ব্যাঙের তখন মহা আনন্দ। সে বলতে লাগল, বাছাধন কার সঙ্গে চালাকি করতে এসেছিলেন। কেমন জব্দ হয়ে গেছেন। সাগর ফাগর কিছু নেই, সব মিছে কথা। কোথায় থাকে, গায়ে আবার রঙ মেখে আসা হয়েছে। এসে আবার আগড়ম বাগড়ম কত কি বলা হচ্ছে। কেমন জব্দ হয়ে শেষকালে পালিয়ে গেল। যদি না যেত, তবে একবার বাছাকে দেখে নিতুম।’

যেমন, যে ব্যাঙের কুয়োতে জন্ম, কুয়োতে বেড়ে ওঠা, সে সমুদ্র কিভাবে চিনবে? সমুদ্রের গভীরতা কিভাবে জানবে? সমুদ্রের ব্যাঙ যতই তাকে বুঝাতে যাক, সে দম্ভে কুয়োর এক মাথা থেকে অপর মাথায় লাফ দিয়ে বলবে-দেখতো সমুদ্রের ব্যাঙ, তোমার সমুদ্র কী এর থেকেও বড়!

তেমনি, যারা বলে আমার মত, আমার কথা ছাড়া আর সবই মিথ্যা, তারাও কুয়োর ব্যাঙের মত। নিজের নিজের অজ্ঞান-কুয়োর ভিতর বসে বসে তারা ভাবছে, তাদেরটি ছাড়া জগতে আর ভাল কিছু নেই, বড় কিছু নেই এবং তাদের মত জ্ঞানী কেউ নেই, বুদ্ধিমানও আর কেউ নেই।

এই জাতীয় লোকদের নিয়েই জগতে যত অশান্তি। আর এ অশান্তি থেকে বেড় হয়ে আসার উপায় একটাই, সেটা এই যে যারা সুমুদ্রের সমান জ্ঞান অর্জন করে আজ অমর তাদের থেকে, তাদের জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়া। তাহলে আর অজ্ঞানতার অন্ধকারে নিমজ্জিত থাকতে হয় না।

তাইতো বন্ধুরা, মহাপুরুষ-মহিয়সীদের জীবনী ও উপদেশাবলি পাঠ করতে হবে, তবেই আদর্শ উন্নত চরিত্র গঠিত হবে। মহৎ মানুষের, মনীষীদের, বিশ্বজয়ীদের কর্ম ও জীবন আমাদের অনুপ্রেরণার আধার। আমারা সে সব অনুপ্রেরণা, প্রাণপ্রাচুর্যে পরিপূর্ণ উৎসাহ তাদের জীবনী পাঠের মধ্য দিয়েই পেতে পারি। তাদের আত্মবিশ্বাস, আত্মসম্মান আর আত্মমর্যাদা দেখে নিজেরাও আত্মবিশ্বাসি, আত্মসম্মানী ও আত্মমর্যাদা সম্পন্ন হয়ে উঠি। বন্ধুরা তোমরাও তাই আত্মবিশ্বাসি হও যে তোমরাও পারবে, তোমরাও বিশ্বজয়ী হবে। তাহলেই হবে, অবশ্যই হবে। চলবে