বিশ্বাস বনাম জাতীয়তাবাদের সংঘর্ষ

সাঈফ ইবনে রফিক

প্রকাশিত : মে ১২, ২০২৫

সাদা ধোঁয়ার ছায়ায় যখন রোমের সিস্টিন চ্যাপেল থেকে ঘোষণা আসে Habemus Papam তখন তা শুধু ধর্মীয় গির্জার জন্য নয়, বরং গোটা বিশ্বের রাজনৈতিক মানচিত্রেও পড়ে এর প্রতিধ্বনি। পোপ লিও চতুর্দশ, যিনি জন্মসূত্রে মার্কিন নাগরিক, তার উত্থান যেন ভ্যাটিকান থেকে ট্রাম্পপন্থী রাজনীতির বিপরীতে প্রতীকী জবাব।

এই নির্বাচন কেবল ক্যাথলিক গির্জার নেতৃত্ব পরিবর্তন নয়, বরং এটি হয়ে দাঁড়িয়েছে বিশ্বাস বনাম জাতীয়তাবাদের নীরব সংঘর্ষের সূচনা।

এক আমেরিকান, কিন্তু বিপরীত ধারার
পোপ লিও চতুর্দশ বা রবার্ট ফ্রান্সিস প্রেভোস্ট যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হলেও আদর্শিকভাবে তিনি পুরোপুরি ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিপরীত। অভিবাসী অধিকার, জলবায়ু ন্যায়বিচার, আফ্রিকান-আমেরিকানদের বিরুদ্ধে সহিংসতা, এমনকি ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে তিনি বহুবার সোচ্চার হয়েছেন।

ডানপন্থী মার্কিন ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলো তাকে এরই মধ্যে ‘ওয়োক’, ‘মার্কসিস্ট’, এমনকি ‘অ্যান্টি-ক্রিশ্চিয়ান’ বলে আক্রমণ করতে শুরু করেছে। কারণ তারা আশা করেছিল, একজন শ্বেতাঙ্গ মার্কিন পোপ মানেই একজন রক্ষণশীল পুঁজিবাদ-সমর্থিত গির্জার অভিভাবক। কিন্তু পোপ লিও চতুর্দশ সেই প্রত্যাশা ভেঙে দিয়েছেন।

হোয়াইট সুপ্রিমেসির শূন্যতা ও নতুন আদর্শের সন্ধান
এক দশকে যুক্তরাষ্ট্রে যে ধরনের জাতীয়তাবাদী ধর্মরাজনীতি মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে God Bless America ও Christian Nation স্লোগানে মিশে থাকা শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদ—তাতে ধর্ম একটি বৈষম্যমূলক শক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে পোপ লিও চতুর্দশের মতো একজন অন্তর্ভুক্তিমূলক ও মানবিক নেতৃত্ব বিশ্ব ক্যাথলিকিজমের জন্য নতুন ব্যাখ্যা হাজির করেছে।

এটা যেন এক বিপরীতধর্মী আমেরিকান মুহূর্ত, যেখানে মার্কিন পোপ হোয়াইট সুপ্রিমেসি নয়, বরং বহুস্বরতার পক্ষে অবস্থান নিচ্ছেন।

ইউরোপ বনাম আমেরিকা: চার্চের ভেতরের ভূরাজনীতি
এই নির্বাচন শুধু আমেরিকান আদর্শ ও ট্রাম্পের দ্বৈরথ নয়, এটি ইউরোপীয় ধর্মীয় অভিজাতত্ব বনাম যুক্তরাষ্ট্রের নবধারারও সংঘর্ষ। ইউরোপ দীর্ঘদিন ধরে ক্যাথলিক নেতৃত্বের কেন্দ্র ছিল, ল্যাটিন ঐতিহ্য, রোমান ক্যুরিয়ার নিয়ন্ত্রণে। পোপশিপ সাধারণত ইউরোপীয়দের মধ্যেই আবদ্ধ ছিল।

তবে এই প্রথম একজন মার্কিন নাগরিক, যিনি ইউরোপীয় অভিজাত কাঠামোর বাইরে— গির্জার শীর্ষে এলেন এবং সেইসঙ্গে এক নয়া আদর্শিক ভাষ্য প্রতিষ্ঠা করলেন।

গির্জার ঘণ্টা বাজছে কার জন্য?
এই প্রশ্ন এখন পুরো বিশ্বজুড়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে— ক্যাথলিক চার্চ কি শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের বন্ধন ছিন্ন করে এক নতুন বহুত্ববাদী, ন্যায়নির্ভর ও মানবিক গির্জার পথ দেখাবে?

নাকি পোপ লিও চতুর্দশের এই উত্থান হবে শুধুই প্রতীকী, যেটি ধীরে ধীরে চাপা পড়ে যাবে অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধ আর ভ্যাটিকানের পুরনো অভিজাত ব্যুরোক্রেসির ভারে?

যে যুগে ধর্মকে অস্ত্র বানিয়ে রাজনীতি চালানো হচ্ছে, সেই যুগে ভ্যাটিকান এক অসাধারণ বার্তা পাঠিয়েছে— পবিত্রতার নাম ব্যবহার করে বৈষম্য নয়, বরং মানুষের পাশে দাঁড়ানোই প্রকৃত খ্রিস্টধর্ম। ট্রাম্পের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেখানে ধর্মকে বিভাজনের হাতিয়ার করেছে, সেখানে ভ্যাটিকানের পোপ বেছে নিয়েছেন তা ঐক্যের ভাষা বানাতে।

ভ্যাটিকানের পতাকা এখন একজন আমেরিকানের হাতে। কিন্তু সেই হাত থেকে উঠে আসছে সেই বার্তাই যা ট্রাম্পপন্থী শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদকে উল্টো প্রশ্ন করে: ‘ধর্ম কি রাষ্ট্রের সেবক, নাকি মানুষের রক্ষক?’

লেখক: কবি, সংবাদকর্মী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক