বিশ্বে খাদ্যে পরাশক্তি রাশিয়া খাদ্য দিয়েই বদলা নেবে

রেজা ঘটক

প্রকাশিত : মে ২৩, ২০২২

২০১১ সালের ২ জানুয়ারি ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানে একটি নিবন্ধে বলা হয়, ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীতে তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দেবে। ততদিনে পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা দাঁড়াবে ৯০০ কোটি। এই বিপুলসংখ্যক মানুষের জন্য এখনকার চেয়ে আরও ৫০ শতাংশ বেশি খাদ্য উৎপাদন করতে হবে।

ওই নিবন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করা হলো এই বলে যে, ওই দশকের (২০২০ থেকে ২০৩০) মাঝামাঝি নাগাদ পৃথিবীর সিংহভাগ মানুষকে অনাহারে থাকতে হবে। তখন আর সাম্রাজ্য বিস্তার কিংবা আধিপত্য বিস্তার নিয়ে যুদ্ধ হবে না, যুদ্ধ হবে খাদ্য নিয়ে।

পৃথিবীর রুটির ঝুড়ি হিসেবে বিখ্যাত ইউক্রেন। রাশিয়ার ইউক্রেন অভিযানের কারণে ইউক্রেনের বিস্তৃীর্ণ অঞ্চলে খাদ্যশস্য উৎপাদন হুমকির মুখে। ফলে ইউক্রেন থেকে খাদ্যশস্য রপ্তানিও হুমকির মুখে। এখন মনে হচ্ছে, ২০৩০ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না, তার আগেই বিশ্বে খাদ্য সংকট তৈরি হবে।

১৮ মে বুধবার জাতিসংঘ বলেছে, আমরা যদি যুদ্ধ থামাতে না পারি, তাহলে সামনের মাসগুলোতে খাদ্যের সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। যদি ইউক্রেন খাদ্যশস্য রপ্তানি পুনরায় শুরু করতে না পারে, তাহলে বিশ্বজুড়ে দুর্ভিক্ষ নেমে আসতে পারে। আর তা বছরের পর বছর স্থায়ী হতে পারে। এই সংঘাত লাখ লাখ মানুষকে অপুষ্টি, অনাহার ও দুর্ভিক্ষের দিকে ঠেলে দেবে।

পৃথিবীর উন্নত দেশগুলো এরই মধ্যে দেশজ উৎপাদন বাড়ানো এবং আমদানি নির্ভরতা কমানোর দিকে মনোযোগী। কিন্তু চাইলেই তো আর রাতারাতি আমদানি নির্ভরতা কমানো যায় না। পৃথিবীর ৩০ শতাংশ গমের চাহিদা পূরণ করত ইউক্রেন। কিন্তু যুদ্ধের কারণে এখন তা সম্ভব হচ্ছে না।

পরিবর্তিত এই পরিস্থিতিতে ক্রেতা দেশগুলো বিকল্প দুই দেশ চীন ও ভারতের দিকে ঝুঁকছে। কিন্তু ভারতে তীব্র দাবদাহে চলতি বছর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে কম পরিমাণ গম উৎপন্ন হওয়ায়, দেশটি গম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। ফলে বিশ্বজুড়ে ভবিষ্যৎ খাদ্য সরবরাহ নিয়ে সংশয় আরও বেড়েছে।

ব্রিটিশ নাগরিক জে রেনার টেলিভিশন উপস্থাপক ও খাদ্য বিশেষজ্ঞ। তিনি বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দক্ষিণ ইউরোপ ও উত্তর আফ্রিকার বিস্তীর্ণ ফসলের খেতগুলো পরিত্যক্ত বর্জ্যের ভাগাড়ে পরিণত হচ্ছে। ফলে গম, ভুট্টা, বার্লির বৈশ্বিক উৎপাদন দিনকে দিন কমবে।

একই কারণে (জলবায়ু পরিবর্তন) রাশিয়া হয়ে উঠবে খাদ্যে বৈশ্বিক পরাশক্তি। কারণ, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে হিমায়িত খাদ্যের চাহিদা ভয়ংকরভাবে বাড়বে। তখন রাশিয়ার দখলে থাকা বিশাল সাইবেরিয়ান প্রেইরি অঞ্চল খাদ্য উৎপাদনের জন্য উন্মুক্ত করবে রাশিয়া।

জলবায়ু পরিবর্তন রাশিয়ার কপালে আশীর্বাদ হিসেবে নেমে এসেছে। সে কথা স্বীকার করে রাশিয়ার বিশিষ্ট কলাম লেখক লিওনিদ বারশিদস্কি বলেছেন, বিশ্বের বৃহত্তম গম রপ্তানিকারক দেশ রাশিয়া। দেশটির শস্য পরাশক্তি হয়ে ওঠার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠছে।

২০২০ সালে ১ হাজার কোটি ডলারেরও বেশি গম রপ্তানি করেছে রাশিয়া। মার্কিন কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে রাশিয়া ৩ কোটি ৮৫ লাখ মেট্রিক টন গম রপ্তানি করেছে। আর ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশটি ৩ কোটি ৬৫ লাখ মেট্রিক টন গম রপ্তানি করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এক বছরের ব্যবধানে শুধু গম রপ্তানি থেকেই রাশিয়ার বাণিজ্য উদ্বৃত্ত ৪৫ কোটি ২০ লাখ ডলার।

রাশিয়া সবচেয়ে বেশি গম রপ্তানি করে মিসর, নাইজেরিয়া, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে। দেশটির রপ্তানি বাজার ক্রমশ বাড়ছে। দ্রুত বর্ধনশীল এ রপ্তানি বাজারের মধ্যে রয়েছে মিসর, পাকিস্তান ও তুরস্ক। শুধু গমই নয়, ভুট্টা, বার্লি এবং ওটস রপ্তানির দিক থেকেও রাশিয়া এখন বিশ্বের এক নম্বর দেশ।

২০১৫-১৬ সালের দিকে রাশিয়ার তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী আলেক্সান্ডার তাকাচেভ বলেছিলেন, তেল নয়, শস্য রপ্তানিতে বিশ্বে এক নম্বর দেশ হবে রাশিয়া। আমরা শস্য উৎপাদনে প্রযুক্তিকে কাজে লাগাচ্ছি। সাত বছর পর তাকাচেভের ভবিষ্যদ্বাণী সত্যে পরিণত হয়েছে। রাশিয়া এখন সত্যি সত্যিই বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় শস্য রপ্তানিকারক দেশ।

জলবায়ু পরিবর্তন রাশিয়ার জন্য শাপে বর হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় ব্যাপক খরা দেখা দিচ্ছে। ফসলের উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। অন্যদিকে এই জলবায়ু পরিবর্তনই রাশিয়াকে এশিয়ার নতুন রপ্তানি বাজার দখল করতে সাহায্য করছে।

জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রুশ কৃষকেরা তাদের খামারগুলো উত্তর দিকে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। উত্তরের বিস্তীর্ণ ভূমি বছরের পর বছর ধরে পতিত পড়ে ছিল, যে জমিগুলো আগে কখনো শস্য আবাদের জন্য ব্যবহৃত হয়নি। সেসব জমিতে এখন ফসল ফলানো হচ্ছে। ১৯৯১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত রাশিয়া ৫ কোটি ৬৬ লাখ হেক্টর পতিত জমি পুনরুদ্ধার করেছে। সোভিয়েত-পরবর্তী সময়ে এই জমিগুলো পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল। এখন প্রযুক্তির অগ্রগতির কারণে এই জমিগুলো চাষ উপযোগী করা গেছে।

রাশিয়া তার দেশে ফলন বাড়াতে পশ্চিমা প্রযুক্তি গ্রহণ করেছে। ২০০৫ সাল থেকে কৃষিকে ‘জাতীয় অগ্রাধিকার’ ঘোষণা করেছে ক্রেমলিন। এর পর থেকে কৃষিতে অব্যাহতভাবে সহযোগিতা বাড়াচ্ছে সরকার। রাশিয়া দেখিয়ে দিয়েছে, সরকারি সমর্থন পেলে করপোরেশনগুলোর চেয়ে ছোট ছোট খামারগুলো দক্ষতার সঙ্গে অনেক বেশি ফসল উৎপাদন করতে পারে।

২০০০ সালের গোড়ার দিকে ভূমি আইন সংস্কার করে ভূমির মালিকানা উদার করেছে রাশিয়া। এটিও দেশটির ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির একটি বড় কারণ বলে মনে করা হয়। অন্যদিকে ইউক্রেনে অব্যাহত আগ্রাসন জারি রেখেছে রাশিয়া। এই যুদ্ধে ইউক্রেনের যেসব অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ রাশিয়া নেবে, সেসব অঞ্চলের আবাদি জমিতে ফসল উৎপাদন বাড়াবে রাশিয়া।

জলবায়ু পরিবর্তন, বিশ্বের জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং সোভিয়েত-পরবর্তী সময়ে কৃষিতে পশ্চিমা প্রযুক্তির ব্যবহার রাশিয়া, ইউক্রেন ও কাজাখস্তানের জন্য শস্য উৎপাদনে বিশাল সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচন করেছে। আর এ সম্ভাবনার সবচেয়ে সদ্ব্যবহার করতে পেরেছে রাশিয়া। তাই দেশটি ক্রমশ শস্যে পরাশক্তি হয়ে উঠছে।

রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ যত দীর্ঘস্থায়ী হবে, বিশ্বে খাদ্য সংকট ও ব্যাপক মহামারী লাগার সম্ভাবনা তত বেশি হবে। খাদ্যে পরাশক্তি রাশিয়া তখন পশ্চিমাদের দেওয়া হাজার হাজার নিষেধাজ্ঞার বিপক্ষে খাদ্যশস্য দিয়েই উল্টো রাজত্ব করবে বিশ্বে। খাদ্য নিয়ে শুরু হবে কাড়াকাড়ি।

রাশিয়া হচ্ছে বিশ্বের শ্বেত ভাল্লুক। শ্বেত ভাল্লুক বরফে থাকতে ভালোবাসে। শ্বেত ভাল্লুককে নিপীড়ন করলে ওরা লোকালয়ে ঢুকে সবকিছু তছনছ করে দেয়। আমেরিকার নেতৃত্বাধীন পশ্চিমাদের ন্যাটো জোটের এই শ্বেত ভাল্লুককে বিরক্তির একটা তীব্র ফলাফল গোটা বিশ্ব খুব শীঘ্রই টের পাবে। খাদ্যশস্য দিয়েই পাল্টা বদলা নেবে রাশিয়া। এমনটাই ধারণা করছেন খাদ্য বিশেষজ্ঞরা।

সূত্র: গার্ডিয়ান, ব্লুমবার্গ, অবজারভেটরি অব ইকোনমিক কমপ্লেক্সটি (ওইসি), এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল ও আজকের পত্রিকা

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা