
সংগৃহীত
বেশ্যাকন্যা
পর্ব ৪
সরদার মেহেদি হাসানপ্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০১৮
শিউলির ঘর থেকে বের যখন বের হচ্ছি, সে বলল, চলো বন্ধু, তোমাকে পল্লী ঘুরে দেখাই।
রাজি হয়ে গেলাম আমি। বললাম, চলো।
আমরা এগিয়ে চলছি অতি সরু গলিপথ পেরিয়ে। অজস্র নরনারীর গাদাগাদি পেরিয়ে হাজির হলাম এক বাড়িওয়ালির ঘরের সামনে। ঘরের দরজার বাম পাশের একটি জিনিস আমাকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো আকর্ষণ করল। তিনটি বাঁশের সংযুক্ত মাথার কাঠের পাটাতনের উপর বসানো রয়েছে একটি প্লাসটিকের জগ। তার ওপরে নিচে ছোট্ট ছিদ্রযুক্ত বালিভর্তি মাটির কলস। তার ওপর বসানো রয়েছে একই ধরনের অন্য আর একটি পানিভর্তি মাটির কলস। এটা এক ধরনের পানি পরিষ্কারকরণ প্রক্রিয়ার দেশীয় প্রযুক্তি। জিনিসটি দেখে বেশ মজা পেলাম এবং এক গ্লাস পানি পান করলাম। বাড়িওয়ালি খালার সঙ্গে শিউলির খালাতো ভাই হিসেবে পরিচিতি লাভের পর আমাকে বিভিন্নভাবে কাজের সহযোগিতা করার ইচ্ছা তিনি ব্যক্ত করলেন। এরমধ্যে আমাদের মাঝে উপস্থিত হলো একই ধরনের শার্ট পরিহিত দুজন ব্যক্তি। তারা আমার টিকেট কাটা হয়েছে কীনা, প্রশ্ন করতেই শিউলি উচ্চস্বরে বলে উঠল, কিরে... তোরা দেখিস না? সে কার সঙ্গে আছে? সে আমার খালাত ভাই, মুখ চিনে রাখ। পরে এলে টিকেটের কথা জিগাবি না।
আচ্ছা ঠিক আছে, বলে লোক দুটো অন্যদিকে চলে গেল। তখন আমার পেটের মধ্যে চো চো করছে খাদ্য গ্রহণের জন্য। কারণ তখন দুপুর-বিকেল সময় পেরিয়ে সন্ধ্যার দিকে এগিয়ে চলেছে। আমরা এর-ওর ঘর পেরিয়ে মূল রাস্তার দিকে এগিয়ে গেলাম। তখন মাগরিবের আজান দেবার সময় হয়েছে মাত্র। রাস্তার পাশে দাঁড়ানো প্রায় সকল মেয়েরাই একটি ছোট্ট পাত্রে পানি নিয়ে নিজের দাঁড়ানো জায়গায় পানি ছিটিয়ে দিচ্ছে নতুন খদ্দের প্রাপ্তির শুভ চিন্তায়। তারা মনে করে, সন্ধ্যার এ লগ্নে নিজের দাঁড়িয়ে থাকার স্থানকে পানি ছিটিয়ে পবিত্র করলে খদ্দের বেশি পাওয়া যায়। আমি রিক্সায় উঠে বাসস্টান্ডের দিকে রওনা দেব, এমন সময় শিউলি বলল, বন্ধু, তোমার ব্যবহার আমার খুব ভালো লাগল।
ধন্যবাদ বন্ধু তোমাকেও।
তুমি কি ডাব খাবে?
মমম.....ভাবছি।
ভেব না, খুবই কচি, হা হা হা
খেতে পারি, টাকা আমি দেব।
কেন? আমার কি টাকা নেই?
না, ঠিক তা নয়।
আমি বেশ্যা বলে ঘৃণা করছো?
ঘৃণা করলে তো তোমাদের কাছে আসতাম না কিংবা তোমাদের নিয়ে কোনও কাজও করতাম না।
তাহলে?
না, বলছিলাম, আমি তো চাকরি করি। টাকাটা আমিই দেই।
কেন? আমিও তো ব্যবসা করি। আমার শরীর বিক্রির টাকা দিয়ে ডাব খেতে তোমার ঘৃণা করছে?
ছি ছি, কি বলো?
তোমরা চুত.....আমাদের চু..... তোমাদের খারাপ লাগে না, আমাদের সঙ্গে জনসম্মুখে কথা বলতে লজ্জা লাগে, আমাদের নাম বেশ্যা মুখে নিতে লজ্জা লাগে, তোমরা তো নিজের বউরেও বেশ্যা বলে গালি দাও। তখন তো তোমাদের খারাপ লাগে না?
তোমার কি খিস্তি-খেউর শেষ হয়েছে?
না, এখনও শেষ হয়নি।
আচ্ছা, তোমার টাকায় ডাব খেতে খেতে তোমার মুখের খিস্তি-খেউর শুনি, কি বলো?
আচ্ছা। ওই মিয়া, আমার বন্ধুরে একটা আনকোরা কচি ডাব দাও, তো?
তুমি ডাবের মধ্যে আনকোরা পাইলা কই?
তোমরা শালা, ওইটাই তো বেশি পছন্দ করো। লজ্জা চো....ক্যা?
লজ্জা করি না। লজ্জা থাকলে কি তোমাদের নিয়ে কাজ করতে আসি? আসি বন্ধু, ঢাকায় ফিরতে হবে, অন্যদিন কথা হবে।
এক সপ্তাহ পর আবার গেলাম। দেখা হলো শিউলির সঙ্গে। ঘুরতে বের হলাম পল্লীর এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত। কারণ একটাই, আগামী ছয়-সাত মাসের মধ্যে এ পল্লীর কিছু প্রভাবশালী বাড়িওয়ালির সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপন করা। যাতে আমি আমার শুটিং ইউনিট নিয়ে কোনোরকম ঝুটঝামেলা ছাড়াই ডকুমেন্টরির কাজটি করে ফেলতে পারি।
কোনও এক সপ্তাহে ঘুরতে গিয়েছি পতিতাপল্লীত। আমি ও মামুন ভাই যাচ্ছিলাম নার্গিস আপার সঙ্গে দেখা করতে। গলি দিয়ে হাঁটছি, হঠাৎ কানে এলো, খা...পো.... মুখে নিয়ে খেলার আর জিনিস পাইলি না?
আমরা সামনে এগুতে গিয়ে পিছন ফিরে তাকাতেই দেখি, কয়েকটি ছোট্ট শিশু ছোট্ট একটি ঘুপরি ঘরের জানালার বাহির দিকের নোংরা ড্রেনের ওপরে পরে থাকা কয়েকটি বেলুন মুখে নিয়ে ফুলিয়ে খেলা করছিল। তা দেখে তাদের মা উত্তেজিত হয়ে ওই কথাগুলো বলছিল। এখন বাচ্চাগুলোকে মারার জন্য এগিয়ে যেতেই মামুন ভাই মহিলাটিকে কিছুটা ধমকের সুরে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করল। আসলেই, এখানে জন্মগ্রহণকারী শিশুরা তাদের জীবনের প্রাপ্ত অধিকারগুলির কত অংশ ভোগ করার সুযোগ পাচ্ছে, তা আমার মাথার মধ্যেই ঢুকছে না। যদিও কিছু এনজিও তাদেরকে নিয়ে কাজ করছে। নার্গিস আপার সঙ্গে দেখা করার পর সেইদিনের মতো ঢাকাতে ফিরে আসলাম। আগামীবার যখন আসব তখন যাব এসএসএস চাইল্ড হোমে। সেখানে কান্দাপট্টি পতিতাপল্লীর নারীদের শিশুরা জন্মের পর থেকে একেবারে স্বাভাবিক পরিবেশে, স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ পায়। পরবর্তী দিন সেখানেই যাব।
চলবে...