
বেশ্যাকন্যা
পর্ব ৫
সরদার মেহেদি হাসানপ্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০১৮
মানুষ মানেই কী সুস্থ-সুন্দর দেহের ফ্রেমে বাঁধা সুদর্শন নারী-পুরুষ? না, মানুষ সে-ই, যার মধ্যে কোনও পশুত্ব থাকে না। যে তার বিচার-বিবেক বুদ্ধি দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে চলে। অন্ধকারের আলো শিরোনামে আমার ডকুমেন্টরির মূল বিবেচ্য বিষয় হচ্ছে, জন্ম হোক যথা-তথা, কর্ম হউক ভালো।
সম্ভ্রান্ত একটি পরিবারে জন্ম নেয়া শিশুটি যদি খারাপ পরিবেশে বেড়ে ওঠে তাহলে সে খারাপ হতে বাধ্য। তেমনই রাস্তার নোংরা পরিবেশে জন্ম নেয়া শিশুটি যদি সমাজের আদর্শবান কোনও পরিবারে বেড়ে ওঠার সুযোগ পায়, তবে সেও একদিন সুন্দর মানুষ হিসেবে গড়ে উঠবে। এটাই স্বাভাবিক। পতিতাপল্লীতে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে জন্ম নেয়া শিশুরা ভালো পরিবেশে বেড়ে ওঠার সুযোগ পেলে সভ্য সমাজের একজন আদর্শবান মানুষ হিসেবে কি গড়ে উঠতে পারবে? পতিতাপল্লীর নব-যৌবনা নারীরা যেমন বলে, ওই বেডা ওই, বসবি?
ওরে... এই, শোন শোন...
এই... যাও যাও, তোমারে নিয়ে আমাগো পিঠা খাওয়ানোর শখ নাই... যাও যাও... বাড়িতে গিইয়া ঘুমাও গিয়া...
বার বেডার সামনে সায়া (পেটিকোট) উঁচাইলে দোষ হয় না, হেতেরা ভিডিও করলেই দোষ! এমন হাজারো মনের নবীন-উচ্ছ্বাসে নারীরা তাদের খদ্দের প্রাপ্তির চাহিদার কথা প্রকাশ করে। পাশাপাশি বুকের সুগভীর সীমানাজুড়ে বইতে থাকে হাজারো না বলার কষ্ট-কাহিনি। ‘আমাগো দশজনের দরকার নাই। আমরা এক ব্যাটার পায়ের নিচেই ভাত খাইবার চাই। সমাজ কি সে সুযোগ দেবে?’ ছোট্ট শিশুটি বলে, ‘আমার এ পরিবেশ ভালো লাগে না। আমাকে এখান থেকে বাইরে নিতে পারেন?’
‘আমি ত্রিশ-চল্লিশ বছর ধরে এখানে আছি। না, আমি এ জায়গায় খারাপ বানামু না। একটাই মেয়ে আমার, আমি কিতা করতাম?’ স্কুলে যেতে ইচ্ছুক শিশুটি। সে বলে, ‘আমি পড়ালেখা করে অনেক বড় হতে চাই, আমার কি দোষ?’ কেউ কি দিতে পারে তাদের এসব প্রশ্নের উত্তর? আমিও পারিনি। চেষ্টা করেছি তাদের কষ্টের জীবন-জীবিকা সেলুলয়েডে তুলে ধরতে। ‘ছি! ছি! তুই ওদেরকে নিয়ে কাজ করিস? তুই তো বেশ্যা হয়ে গেলি রে। তুই তো প্রচুর মাগি লাগাইসস। তোর রুচি হয় কিভাবে?’ আরও কত প্রশ্ন আর অভিব্যক্তি!
পৃথিবীর সু-প্রাচীন এ পেশাকে ধরেই তাদের জীবিকা। কেউবা মায়ের পেশাকে গ্রহণ করে। কেউ ভালোবাসায় প্রতারিত হয়ে। কেউবা কিছু অসভ্য কালো হাতের আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত হয়ে ঠাঁই নেয় এ নিষিদ্ধ পল্লীতে। এরা সবাই মানুষ হয়ে জন্মেছে। কিন্তু হারিয়েছে মানুষ হয়ে বাঁচার অধিকার। এরপরও তারা নিজেকে সাজায়। সাজে নিত্যনতুন সাজে। আর এভাবেই স্বপ্ন দেখে নতুনভাবে বেঁচে থাকার। ‘আমি এখানে বিশ বছর থেকে আছি। বাইরে যাবার চেষ্টা করেছি। এখান থেকে বের হয়ে যামু কই? খামু কি? দুইডা ছেলেমেয়ে আছে। ছেলেডা আমার কাছে থাকে, আর মেয়েটা এসএসএস হোমে দিয়েছি।’
‘আগের মতো এখন লোক-টোক আসে না। আমরা মুখ বানাই (মেকাপ করি), লিপিসটিক-টিপিসটিক দেই। গেটে গিয়ে দাঁড়াই। লোকদের বুঝায়ে ঘরে নিয়ে আসি। ঘরে খদ্দের এসে বসে, তারপর খুশি হয়ে টাকা দেয়।’ এ ধরনের হাজারো প্রশ্ন-উত্তর নিয়ে একদিন সকালে গেলাম এসএসএস অফিসে। যেতেই দেখা হলো এসএসএসের নির্বাহী পরিচালক জনাব আব্দুল হামিদ ভূঁইয়ার সঙ্গে। শুভেচ্ছা বিনিময় শেষে তিনি অফিসের রুমি ভাইকে দিয়ে মটরসাইকেলে করে যাবার ব্যবস্থা করে দিলেন তাদের সোনার বাংলা চিলড্রেন হোম কুইজবাড়ী, মুগডা, টাঙ্গাইলে। আমরা পৌঁছলে আমাকে সাদরে গ্রহণ করলেন হোমের প্রিন্সিপাল আমার মিতা জনাব মেহেদী আনোয়ার ভাই। তিনিই একমাত্র এই হোমে ফ্যামেলি নিয়ে থাকেন, অন্য কারো এখানে নির্দিষ্ট সময় ছাড়া অবস্থান করার সুযোগ নেই। মেহেদী ভাই আমাকে ওনাদের সমগ্র প্রজেক্টটি ঘুরিয়ে দেখালেন, এবং ওনার রুমে নিয়ে গিয়ে চা পানের পাশাপাশি আমার আগমনের হেতু জানার চেষ্টা করলেন। আমি তাকে বললাম, ভাই, আমি মেরিকে নিয়ে একটি ডকুমেন্টরি করতে চাই।
মেরি?
হ্যাঁ।
বলেন কি??
আপনাকে কি অফিস থেকে জানানো হয়নি?
হ্যাঁ, হয়েছে। তবে তা সম্ভব হবে না।
আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, আমার গত কয়েক মাসের পরিশ্রম বৃথা হতে চলেছে। মেহেদী ভাই, আমার মেরিকেই লাগবে। তাকে ছাড়া আমি এ ডকুমেন্টরি করব না। তার কথা চিন্তা করেই আমি ঢাকা থেকে এখানে এসেছি।
না-না, আপনি অন্য কোনও মেয়েকে সিলেক্ট করুন।
অন্য মেয়েকে দিয়ে আমার কোনও কাজ হবে না, মেরিকেই দরাকর।
না-না, মেরির সামনে এসএসসি পরীক্ষা।
সমস্যা নেই, তার পড়ালেখার কোনও ক্ষতি আমি করব না।
আচ্ছা ঠিকাছে, মেরি আসুক। তার সঙ্গেই কথা বলুন সে আপনার কাজ করবে কীনা।
মেরিকে ডাকা হলো। আমাদের সামনে এসে সালাম দিয়ে সে বসলো। মেহেদী ভাই আমার কাজের ব্যাপারে বিস্তারিত তাকে বুঝিয়ে বললেন। এরপর জিজ্ঞেস করলেন, মেরি, তুমি কি ডকুমেন্টরিটি করবে?
জি না স্যার।
মেহেদি ভাই, সে তো করতে চাচ্ছে না। আপনি এখন কি করবেন?
আমি মেহেদী ভাইকে অনুরোধ করলাম, আমাকে মেরির সঙ্গে দু’এক মিনিট কথা বলতে দেবার জন্য। ওনি রাজি হলেন এবং রুম থেকে বাইরে বেরিয়ে গেলেন। মিনিট পাঁচ-দশেক পর ফিরলেন উনি।
রাজি হলো?
আমি বললাম, আপনিই জিগেশ করুন।
মেরি, তুমি কি ওনার ডকুমেন্টরিটি করবে?
জি স্যার।
হা হা হা... মিতা ইউ আর এ গ্রেট।
হা হা হা... মিতা, আমি ঢাকা থেকে এখানে এসেছি শুধুই তার জন্যে। আমার সকল চিন্তাই তাকে ঘিরে। তাকে নিতে না পারলে আমি ডকুমেন্টরিই করব না। সে তো এখন আমার স্বপ্নের নায়িকা, তাকে ছাড়া কি সম্ভব?
ঠিক আছে মেহেদী ভাই, এখন আমরা আপনার কাজের জন্য কি কি করতে পারি?
আমি সেই দিনের মতো স্ক্রিপ্ট বুঝিয়ে দিয়ে ঢাকায় ফিরলাম।
এখন, আমার নয়, আপনাদের প্রশ্ন, কে এই মেরি?
মেরি ব্রথেল বেবি। সে পাঁচ বছর বয়স থেকে এই হোমে থেকে বেড়ে উঠছে। সে ক্লাস টেনে পড়ছে। এবার সে এসএসসি পরীক্ষা দেবে। তার রোল নম্বর, ক্লাস ওয়ান থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত এক। সে কখনও দ্বিতীয় হয়নি। সে যথেষ্ট সুন্দরী। মার্শাল আর্টে সে ব্রাউন বেল্ট অর্জনকারী। সে নেপাল মার্শাল আর্ট প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার সুযোগ পেয়েছে। তার মা যৌনকর্মী ছিলেন, তার জন্মের সময় অবশ্য তিনি মারা যান। জন্মের পর প্রথম পাঁচ বছর সে তার নানির কাছে বড় হয়েছে। তার নানিও ছিলেন যৌনকর্মী। তিনি এখনও বেঁচে আছেন এবং থাকেন কান্দাপট্টিতে। মেরি ভবিষ্যতে ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়। সে সুন্দর নাচতে পারে। ভালো গানও গাইতে পারে। সে ভবিষ্যতের সুন্দর, কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন দেখতে ভালোবাসে। আর এ কারণেই আমি মেরিকে চাই আমার গল্পের নায়িকা হিসেবে।
এর কিছুদিন পর আমি রুমি ভাইকে নিয়ে দেখা করতে গেলাম মেরির নানির সঙ্গে। সে পল্লীর এক বাড়িওয়ালির একটি ঘর নিয়ে বসবাস করছে। আমরা তার ঘরে গেলাম। উনি আগে থেকেই আমার নাম জানতেন। কারণ মেরি তার নানিকে আমার বিষয়ে বলে রেখেছে। নানি আমাদেরকে বিছানায় বসতে বললেন, আমি ও রুমি ভাই বসলাম। নানি আমাদেরকে মেরির বাবা-মা`র ছবি দেখালেন। কাঁদলেন। বললেন অনেক অজানা কাহিনি।
নানি কত বছর ধরে এখানে আছেন?
ত্রিশ-চল্লিশ বছর হবে।
আপনার ছেলেমেয়ে ক’জন?
একটাই মেয়ে ছিল, মেরির মা।
এখন তো আপনার বয়স হয়েছে, চলছেন কিভাবে?
আল্লাহই য্যামনে চালায়, চলি।
তা বুঝলাম, আপনাকে খরচ দ্যায় কে?
বাবারে, বয়স হইছে। খদ্দের তো আগের মতো আসে না।
তাহলে চলেন কিভাবে?
ওই দু’একজন যা দ্যায়।
আচ্ছা, তাহলে দু’একজন খদ্দের এখনও আসে?
আরে না, তারা খদ্দের নয়, বাবু।
আচ্ছা, এখনও বাবু আসে?
তুই কি তোর বউ বুড়া হলে বাড়ি থেকে বের করে দিবি?
তা কি করে হয় নানি?
তাহলে?
তাহলে বলতে চান, তাদের সঙ্গে আপনার ভালোবাসার সম্পর্ক আছে?
না থাকলে কি তারা এখনও আসে?
তা অবশ্য ঠিক, তারাই কি সব খরচ দেয়?
তারা দেয়, আমি নিজেও কিছু কাপড় সেলাই করি, তা দিয়েই কোনোমতে জীবন চলে।
আমি মাঝে মধ্যে ভাবি, এখানে আমি কেন আসছি? ভুলে যাই। ভুলে যেতে বাধ্য হই। আবার মনে করে আবার লিখব।
চলবে...