
বেশ্যাকন্যা
পর্ব ১৮
সরদার মেহেদী হাসানপ্রকাশিত : মার্চ ১৪, ২০১৮
পরের সপ্তাহে দৌলৎদিয়া ঘাটে পৌঁছেই আমি ফোন দিলাম রশিদ ভাইকে। উনি দৌলৎদিয়া ট্রাকস্ট্যান্ডে এগিয়ে এলেন। আমরা একসঙ্গে চা-পানি খেয়ে এগিয়ে গেলাম পল্লীর প্রধান রাস্তার দিকে। রেললাইনের ডানপাশে অসংখ্য টিনশেডের মার্কেট, বিভিন্ন প্রকারের দোকান। রেললাইন থেকে বামের অংশের সরুপথ পেরিয়ে সামনে এগোলেই একটি সিনেমা হল। দুপুরের দিকে লোকের ভিড়ভাট্টা তেমন না থাকলেও সন্ধ্যার পর হলের সামনে থাকে প্রচণ্ড ভিড়। রেললাইনের বাম পাশের অনেকটা জায়গা নিয়ে গড়ে উঠেছে ছোট ছোট বাঁশ ও টিনের সমন্বয়ে গড়া দ্বিতল হোটেল। হোটেলের ভিতরের বর্ণনা পরে দেব। আপাতত সামনের দিকে এগিয়ে যাই। মেইন গলিটির চওড়া প্রায় বিশ ফিট। গলির দু’ধারে অসংখ্য দোকান। সবই যৌন কর্মীদের দ্বারা পরিচালিত। মেইন গেটের একটু ভিতরের ঢোকার পথেই রয়েছে কিছু নির্দিষ্ট পোষাক পরিহিত গার্ড। তারা পল্লীর ভিতরে প্রবেশরত সকল মানুষের নির্দিষ্ট পরিমান অর্থের বিনিময়ে একটি করে টিকেট ধরিয়ে দিচ্ছে। বলে রাখা ভালো, এখানে প্রবেশের জন্য টিকেট কাটতে হয়। আমরা গেটের সামনে যেতেই একজন হাত তুলে আমাকে টিকেট নিতে বললেন। রশিদ ভাই আমাকে ওনাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন এবং আমরা টিকেট ছাড়ায় ভিতরে ঢুকলাম। সামনে এগিয়ে যাচ্ছি, প্রচুর লোকের ভিড়, বিভিন্ন শ্রেণি মানুষের সমাগম। কিছুটা পথ এগিয়ে যেতেই কানে এলো, বাবা কেমন আছ? দেখলাম, আনোয়ারের নানি কয়েকটা ডাব নিয়ে ছোট্ট একটি টিনের ঘরে বসে আছেন।
আমি বললাম, নানি, স্লামালেকুম।
ওয়ালাইকুমুস সালাম, নাতিরা কেমন আছ?
জি নানি, ভালো আছি। আপনার কথা রশিদ ভাইয়ের কাছ থেকে অনেক শুনেছি।
হ বাবা, রশিদ খুব ভালো পোলা।
হ্যাঁ নানি, সে খুব ভালো মানুষ। আনোয়ার কোথায়?
তা তো কইতে পারি না বাবা। তয় এহানেই কোথাও আছে।
তাহলে আসি নানি।
কও কি? ডাব খাইয়া যাও।
না নানি, এখন ডাব খাব না।
আমরা গরিব দেইখা ডাব খাবা না...
ছি ছি নানি, কি বলেন? ডাব কাটেন, ডাব খাব।
উনি বয়সের ভারে অনেকটা দুর্বল। শরীরের চামরা গুটিয়ে গিয়েছে। সময়ের পরিবর্তক হিসেবে উনি দাঁড়িয়ে আছেন এই পল্লীর জীবন্ত সাক্ষী হিসেবে। উনি ওনার সমস্ত জীবন অতিবাহিত করেছেন যৌনকর্মী হিসেবে। গর্ভে ধরেছেন আনোয়ারের মাকে। আনোয়ারের মাও ছিলেন এ পল্লীর যৌনকর্মী। কয়েক বছর আগে তিনি ইন্তেকাল করেছেন। আগে এখানকার মানুষদের মাটি দেয়ার অবস্থান ছিল না। পরবর্তীতে প্রশাসনের সহোযোগিতায় এ পল্লীর মৃত মানুষদের জন্য একটি কবরস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। নানি দুটো ডাব কেটে আমাদেরকে দিলেন। আমরা খেলাম। খাওয়া শেষে টাকা দিতে গেলে উনি টাকা নিতে চাইলেন না। আমি অনেকটা জোর করেই তার হাতে টাকা ধরিয়ে দিলাম।
আমি তো ওদের কেউ নই। এরপরও কেন জানি না, তারা আমাকে অতি সহজেই নিজের করে নেয়। জানি না, মানুষ বলেই কি সম্ভব? এরা পছন্দের মানুষদের জন্য অতি সহজেই জীবন দিয়ে দিতে পারে। এদের সুদূর-প্রসারী উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই। এদের আছে দু’বেলা আধাপেটা কিছু খাবারে আকুতি। এদের শরীরের উপরিভাগে অশ্লীলতার ছড়াছড়ি। দেহপ্রসারণীর দুর্গন্ধের কালিমা। কিন্তু রক্তের প্রতিটি কণায় মানুষের অনুভূতি বিরাজমান। এরা বিশ্বাস করে, এরা বিশ্বাসের চূড়াই বসে জীবনের সামান্যতম উপার্জনও আপনার/আমার হাতে তুলে দিতে পারে। এরা ভালোবাসতে জানে। কিন্তু ভালোবাসার সীমানা প্রাচীর টপকানোর মতো সাধ্য তাদের নেই। এরা মা হতে পারে কিন্তু সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করতে পারে না। পৃথিবীর সকল মানুষ আত্মার আত্মীয়তাতে আবদ্ধ, কিন্তু এরা শুধুই যৌনকর্মী... যৌনকর্মী এবং যৌনকর্মী। আমরা এখন নানির দোকান থেকে সরে এসে অসংখ্য মানুষের ভিড় ঠেলে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি...
চলবে...