
বেশ্যাকন্যা
পর্ব ২০
সরদার মেহেদী হাসানপ্রকাশিত : মার্চ ১৬, ২০১৮
শিউলী বলল, শুইতে পারবা?
বললাম, কেন নয়?
তোমরা বড় মানুষ...
বড় মানুষ বলেই কি তুমি আমাকে আলাদা করতে চাও?
আমরা চাই না, তোমরা চাও।
আমি শিউলির খাট থেকে দুটো বালিশ টেনে নিয়ে তাতে বাম কনুইয়ের ভর দিয়ে কিছুটা আয়েসী দেহে শুয়ে পড়লাম। জিজ্ঞেস করলাম, কী খাওয়াবে বলো?
হা হা হা হেসে উঠল শিউলী। জিজ্ঞেস করল, কি খাবে বলো?
আমি জিজ্ঞেস করলাম, হাসলে কেন?
না এমনিই।
মশকরা করো? হাসলে কেন বলো।
তুমি খেতে চাইলে, তাই হাসলাম।
আমি খেতে চাইলেই কি তুমি হাসবে?
কেউ তো আমার কাছে খেতে চায় না। সবাই বসতে চায়। তুমি খেতে চেয়েছ, তাই হাসলাম।
তোমরা কি হাসার সময় পাও?
সবাই টাকা দিয়ে ঘরে ঢোকে। বইতেই সময় যায়, হাসবো কখন?
হা হা হা... দারুণ বন্ধু... যাও, কাউকে পাঠায়ে দাও। জুস=বিস্কিট নিয়ে আসুক।
আমি টাকা দিতে গেলে সে জোর করে টাকা ফিরিয়ে দিয়ে একটি ছোট মেয়েকে দোকানে পাঠালো। এর মধ্যে রশিদ ভাই সিগারেট ধরিয়েছে। সে রশিদ ভাইয়ের কাছে একটা সিগারেট চাইল। আমি রশিদ ভাইকে না করলাম যাতে তাকে কোনও সিগারেট না দেয়। কারণ মেয়েদের ঠোঁটে আমি সিগারেট পছন্দ করি না।
শিউলী প্রতিবাদ করল, বন্ধু, তুমি আমাকে সিগারেট খেতে দিবা না?
দিব না বলছি না, আমার সামনে সিগারেট খেও না।
সিগারেট খেলে কি হবে?
সিগারেট খেলে ক্যানসার হয়। তার চেয়েও বড় কথা, তুমি আমার দোস্ত। তোমার মুখে আমি সিগারেট দেখতে চাই না।
আচ্ছা ঠিক আছে। তোমার সামনে আমি কখনও সিগারেট খাব না। তোমার কথাগুলো খুব ভালো লাগল। তোমাকে খুব কাছের মনে হয়।
কাছের মনে হয় কেন?
ক্যামন জানি। সবাই আসে, টাকা দেই, বসে। কেউ টিভির জন্য ভিডিও করে, চলে যায়। কেউ তো তোমার মতো এভাবে নিজের করে কথা বলে না।
সবার চিন্তা-ভাবনা, চাহিদা-কামনা কি এক হয়?
তা হয় না, কিন্তু...
বাদ দাও এসব কথা, তোমার বাবু কখন আসবে?
ও আজকে আসবে না।
কেন?
তুমি আসবা এই কারণে।
বলো কি? আমি কি তোমার ঘরে এসে অন্যায় করলাম?
আরে না না। সে আসলে তোমারে খুব পছন্দ করে এবং লজ্জা পায় তোমার সামনে পড়তে।
তোমার দেশের বাড়ি কোথায়?
সেইটি না বলি।
অনিচ্ছা থাকলে বলো না, তুমি এখানে আসলে কিভাবে?
আমাকে আমার গ্রামের এক লোক ঢাকাতে চাকরি দেয়ার কথা বলে এখানে এনে তুলেছে। এরপর ইতিহাস...
তোমার দেশে যেতে মন চায় না?
চাইলেই আর কি হবে, তোমাদের সমাজ কি সহজেই এখন আমাকে মেনে নিবে?
কেন নেবে না?
সেইটা তুমি তোমাদের সমাজকে জিজ্ঞেস করো।
বাবু তোমাকে খুব ভালোবাসে, তাই না?
ভালোবাসে বলেই তো আমাকে তার নিজের জমির ওপর ঘর বানিয়ে থাকতে দিছে।
আজকে যেহেতু বাবু আসবে না, আজকে আমি ঢাকাতে না ফিরে তোমার এখানেই থেকে যাই, কি বলো?
তাহলে খুব মজা হবে। থেকে যাও, সারারাত গল্প করব।
কি বলো তুমি? সারারাত গল্প করব, তো খাব কখন?
কি খাবা?
কি খাওয়াবা?
তুমি যা চাইবা আমি তাই খাওয়াব।
সত্যি?
সত্যিই বলছি...
তুমি খাওয়াতে পারবা না...
মেজাজ গরম করাবা না। আমি কিন্তু একখুনি ইলিশ মাছের ডিম রান্না দোকান থেকে আনাব।
হা হা হা... আমি যে ইলিশ মাছের ডিম পছন্দ করি, তা তোমাকে কে বলল?
গত সপ্তাহে রশিদ ভাইয়ের সাথে তুমি হোটেলে অনেকগুলো ইলিশ মাছের ডিম খাইছ। তুমি যাওয়ার পরের দিন দুপুরে অফিসের কাজে রশিদ ভাই আমাদের এখানে আসলে আমি তাকে কইছিলাম, ভাই দুপুরের ভাত খেয়ে যান, ইলিশ মাছের ডিম আছে। তখন রশিদ ভাই কইল, আরে রাখো। গতকাল মেহেদী ভাইয়ের সাথে কয়েক পিচ ইলিশের ডিম খাইছি। মেহেদী ভাই ইলিসের ডিম খুব পছন্দ করে।
ও তাই। আমি তো অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।
একজন বেশ্যাও যে আমাদের মতো সভ্যসমাজের মানুষদের সাথে অতি ভদ্র ভাষায়, সুন্দর করে কথা বলতে পারে তা আমি/আমরা বুঝি না। কিংবা বুঝার চেষ্টাও করি না। আমরা তাদেরকে নিয়ে দু’একটা টিভি রিপোর্ট করতে পারি। তাদের মানবাধিকার নিয়ে কথা বলতে পারি। তাদের নিয়ে বিখ্যাত ঔপন্যাসিকের লেখা কোনও উপন্যাস পড়তে পারি। তাদের নিয়ে রচিত কোনও রসালো চটি পড়তে পারি। কিন্তু তাদের প্রাত্যহিক জীবনের উন্নতি সাধন করতে পারি না। পারি না তাদের পেশার বিলুপ্তকল্পে কোনও পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিতে। যদিও প্রশাসন ও কিছু এনজিও তাদের নিয়ে কাজ করছে। তবে তা সীমিত আকারে। এদের জীবনে কান্নার কোনও মূল্য নেই। কেউ কেউ তাদের চোখের পানিকে কাজল ভেবে নিয়েছে। এরা কাঁদতে ভুলে গেছে। এ পল্লীর জীবন শুরুর প্রথম ‘নারিকের ভাঙা’র দিনে যে নারী জীবনের সমস্ত চোখের পানি অঝোর-ধারায় প্রবাহিত করে শেষ করে ফেলেছে, তার জীবনে প্রাত্যহিক কান্নার কি বা মূল্য আছে!
আজকে অনেকটা সময় শিউলীর ঘরে বসলাম। সন্ধ্যা হতে চলল। আমি আর রশিদ ভাই সেদিনের মতো বিদায় নিয়ে পল্লী থেকে বের হয়ে এলাম। রশিদ ভাই ওনার বাসায় রাতে থেকে যেতে বললেন, আমি না করলাম। ওনার ৭/৮ বছরের ছেলের সাথে মোবাইলে আমার প্রায় দিনই কথা হয়। অন্তত তার জন্য হলেও একদিন ওনার বাসায় যাব।
চলবে...