
বেশ্যাকন্যা
পর্ব ৪৮
সরদার মেহেদী হাসানপ্রকাশিত : এপ্রিল ২০, ২০১৮
আমরা রাতিয়ার ঘরে গিয়ে বসলাম। রশিদ ভাই বরাবরের মতো আমাকে রাতিয়ার ঘরে বসিয়ে রেখে অফিসে চলে গেলেন। আমি বসে আছি, রাতিয়া দোকানে কিছু একটা নিতে গেল, আমি ঘরের মধ্যে রাখা কিছুটা অগোছানো খাটের উপর বসে পড়লাম। ভাবলাম রাতিয়ার কথা, মেয়েটি প্রচণ্ড খিটমিটে স্বভাবের হলেও মনের দিক দিয়ে অনেকটা নরম। এদের মতো অসংখ্য মেয়ে রয়েছে যারা স্বাধীন দেশে পরাধীনতার সুখ উপভোগ করে। একটি শিশু জন্মগ্রহণের সময় থেকেই এখানে বেড়ে উঠতে পারে, তার কাছে মনে হবে এটিই তার পৃথিবী। পল্লীর সীমানা জুড়েই তার স্বাধীনতা। তার স্বাধীনতা মানেই সে বড় হবে, যৌন কর্মী হবে, বাড়িওয়ালী হবে, স্বামী-সংসার বলে এদের কিছু থাকতে নেই।
বাবা শব্দটি এদের কাছে আহামরি কোনও গুরুত্বপূর্ণ শব্দ নয়। কাুকে মা বলে ডাকাটা অনেকটাই ধারাবাহিক জীবিকার বহিঃপ্রকাশ। বাইরে থেকে বিভিন্ন সময়ে চুরি হওয়া শিশুরা যদি এখানে এসে থাকে তাহলে তাকে চিলের চক্ষু দ্বারা পর্যবেক্ষিত মানুষ রূপে বেড়ে উঠতে হয়। বেড়ে উঠে নিজেকে প্রস্তুত করতে হয় একজন যৌনকর্মী হিসেবে। কারণ তার ছোটবেলা থেকে যৌবনপ্রাপ্ত হওয়া পর্যন্ত বাড়িওয়ালীকে প্রচুর অর্থ ঐ শিশু মেয়েটির পিছনে লগ্নি করতে হয়। আর তাই মেয়েটি তার জীবদ্দশায় যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করে বাড়িওয়ালীর লগ্নিকৃত অর্থ পরিশোধের ব্যবস্থা করে। যে মেয়েটি একেবারেই যৌবনপ্রাপ্ত অবস্থায় প্রতারিত হয়ে এই নিষিদ্ধ পল্লীতে এসে পড়ে, তাদের পিছনে বহুদিন ধরে বাড়িওয়ালীর অর্থ লগ্নির বিষয় কাজ করে না, এখানে মেয়েটির প্রতারক ব্যক্তিটির দ্বারা বিক্রয় হয়।
আর তাকে কিনে নেয় বাড়িওয়ালী। বাড়িওয়ালী যে অর্থ লগ্নি করে মেয়েটিকে ক্রয় করেছে তার লভ্যাংশসহ একটি নির্দিষ্ট পরিমানের অর্থ পরিশোধের পর ঐ মেয়েটি নিজেই স্বাধীনভাবে একজন যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করতে পারে। বিভিন্নভাবে প্রতারিত হয়ে যে সমস্ত মেয়ে-নারীরা এখানে এসে জড়ো হয়, তারা ইচ্ছে করলেই এখান থেকে বের হতে পারে না। প্রশাসনিকভাবে অনেক সময় এসব পল্লীতে খোঁজ করে পুশিল অপ্রাপ্ত কিংবা চুরি হওয়া শিশু-মেয়েদের উদ্ধারের কাজ করে থাকে। একজন নারী, মানুষ হিসেবে এখানে যতটা স্বাধীন, একজন যৌনকর্মী হিসেবে ততটাই পরাধীন। সেইদিক থেকে রাতিয়ার কিছু চলার বাধা-নিষেধ থাকতেই পারে। যেহেতু রাতিয়ার ব্যাপারে বাড়িওয়ালীর সাথে আমার আলোচনা হয়ে গিয়েছে, সেহেতু রাতিয়ার আচরণগত কিছু পার্থক্য আসবে আমার ক্ষেত্রে সেটাই স্বাভাবিক।
রাতিয়া চা-বিস্কিট নিয়ে এসেছে। আমাকে চা খেতে দিয়ে বাইরে কোথাও যাচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় যাও? বললে পিঠা খাওয়াবে। এখন দিচ্ছো চা, সমস্যা কি?
হা হা হা... আগে চা খেয়ে গলা ঠিক করে নেন। যাতে পিঠা খাইতে সমস্যা না হয়।
আচ্ছা ঠিক আছে, তাই বলে তুমি আমাকে ঠাণ্ডা চা খেতে দিবে?
বলেন কি? আমি না গরম চা নিয়ে আসলাম।
ঠিক আছে, তোমার হাতে যতক্ষণ ছিল চা ততক্ষণ গরম ছিল। আমার হাতে আসা মাত্র ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।
মসকরা করেন?
মসকরা করব কেন? চা এ হাত দিয়ে দেখো।
সে অনেটা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো। তারপর গুটিগুটি পায়ে আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। আমার দিকে চোখ তুলে তাকাতেই বললাম, কি? চোখ তুলে তাকালেই হবে? চায়ে হাত দিয়ে দেখো। সে কিছুটা আনমনে তার হাতটি চায়ের কাপে ছোঁয়ানোর জন্য বাড়াতেই আমি হাতটি ধরে চায়ের কাপে চেপে ধরলাম।
আ...উ... ওরে বাবা, প্রচণ্ড গরম, মিথ্যা কথা বললেন কেন?
মিথ্যা না বললে কি তুমি সামনে এগিয়ে এসে চায়ের কাপে হাত দিতে চাইতে?
চাইতাম না। তাই বলে আপনে এভাবে গরম দিবেন?
আমি তো গরম দেইনি। চায়ের কাপ দিয়েছে।
চায়ের কি হাত আছে? আপনেই তো হাত চেপে ধরে গরম দিয়েছেন।
গরমটা কি আমার শরীর থেকে পেয়েছো? নাকি চা থেকে পেয়েছো?
আপনার শরীর থেকে পাব কেন? চা থেকে পেয়েছি।
তাহলে চাকে কোনও কিছু বলে লাভ নাই। সে তো কোনো কিছু বোঝে না।
সে না বুঝুক, আপনে তো বুঝেন?
হ্যাঁ, বুঝি বলেই তো হাত চেপে ধরেছি। তুমি আমাকে গরম পিঠা খাওয়াতে পারলে না কিন্তু আমি তোমাকে গরম চায়ের ছ্যাঁকা খাওয়ালাম। কেমন লাগল?
গরম ছ্যাঁকা কখনও ভালো লাগে?
কষ্ট পেয়েছো?
না, মজা পেয়েছি। ইশ, গরম লাগছে।
দাও, মালিশ করে দেই।
বাহ! মালিশ করার কথা বলে শরীর স্পর্শ করার মতলব, তাই না?
মতলব হবে কেন? মালিশ করতে গেলে তো হাতটা একটু ছুঁতেই হবে।
না থাক। এতে আরও কষ্ট বাড়বে।
তা কি করে?
চায়ের গরমের উপর আপনার হাতের গরম সহ্য করা মুশকিল।
আমার হাত তো ঠাণ্ডা। তুমি গরম বলছো কেন?
আপনার হাত ঠাণ্ডা কিন্তু অনুভূতির স্পর্শটা অনেক গরম হবে।
দিনে তো অনেকজন খদ্দের তোমাকে স্পর্শ করে, তাতে তোমার গরম অনুভূতি হয় না?
যে লোকটির নিজের মিষ্টির ব্যবসা থাকে, সে কি সব সময়ই মিষ্টি খায়?
সব সময় খায় না, তবে কখন কখন খায়।
খদ্দেরের অনুভূতি খদ্দেরের মতোই হয়। তখন স্পর্শের চেয়ে অর্থ আমাদের কাছে বড় হয়ে থাকে। আমাদের মাথায় একটাই চিন্তা, বসা শেষ হওয়া মাত্র টাকা পাব। আমাদের কাছে শরীরের অনুভূতির চেয়ে অর্থের অনুভূতিটাই বড়। সেক্ষেত্রে আপনার স্পর্শের অনুভূতিটা একেবারেই আলাদা। এখানে নেই কোনও অর্থের লেনদেন। এ কারণেই আপনার স্পর্শটা আমার কাছে গরম লাগবে।
তুমি অসম্ভব সুন্দর করে কথা বলতে পার। উপর থেকে শুকনো খটখটে মনে হলেও ভিতরের রস কিন্তু বেশ মিষ্টি।
মানে? কি বলেন?
মানে হচ্ছে, আখগাছ দেখতে চিকন ঠিক তোমার মতো। পাতাগুলো বেশ ধাড়ালো তোমার কর্কশ কথার মতো। গাছের কচি পাতাগুলো তোমার সুন্দর হাসির মতো। গাছের ময়লা গোড়ালি দেখতে তোমার শরীরের উগ্র মেকাপের মতো। আর আখের ভিতরের চিপানো মিষ্টি রস তোমার মনের ভিতর লুকিয়ে রাখা সুন্দর প্রতিচ্ছায়ার মিষ্টি অনুভূতির মতো।
আমার তো পাগল হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে। আমাকে পাগল হবার ওষুদ দিবেন?
চলবে