ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ এবং ভার্চুয়াল লাইফ

ইবনে আদম

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ২৪, ২০১৯

প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ আমাদের পৌরুষকে প্রবলভাবে প্রভাবিত করেছে, এবং নারীদের নারীত্বকেও। আধুনিক যুগের রিক্রিয়েশনাল এক্টিভিটির যে ধারণা সেটা অবশ্যই প্রাক-আধুনিক যুগের ধারণার চেয়ে ভিন্ন। প্রাক-আধুনিককালে ছেলেদের খেলাধুলা, শরীরচর্চা, সমরবিদ্যার ট্রেইনিং ইত্যাদি এক্টিভিটিজ কিংবা মেয়েদের নকশা-কারুশিল্প, বাগান করা, রান্নাবান্না-মেহমানদারি ইত্যাদি এক্টিভিটিজের উদ্দেশ্য কেবলই হালযামানার মতো বিনোদনমূলক ছিল না; বরং সেগুলোর মূলে নিজেদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ এবং সৌন্দর্যবোধের ধারণাই প্রধান ছিল। এগুলো তাদের জেন্ডার রোলকে ডিফাইন করতো; তাদের মানবিক সক্ষমতাকে প্রমাণ করতো। আর বিনোদন (সুস্থ আনন্দ অর্থে) এগুলোর বাই-প্রোডাক্ট হিসেবে আসতো।

বর্তমানে আমাদের তরুণদের প্রায় সবাই-ই মোবাইল পিসিতে বিভিন্ন একশন, স্ট্র্যাটেজি, স্পোর্টস জনরার গেইমিং এ আসক্ত; অথবা অন্তত জীবনের একটা সময়ে আসক্ত ছিল। তরুণীরাও কম মাত্রায় হলেও বিভিন্ন এডভেঞ্জার, রোমান্টিক জনরার গেইম অথবা টিভি-সিরিয়াল/রিয়ালিটি শো/এনিমেতে আসক্ত। আমাদের এই আসক্তির মূল কারণ— প্রথমত, আমরা ছেলেদের বাস্তব জীবনে খেলাধুলা, শরীরচর্চা ইত্যাদি পুরুষোচিত এক্টিভিটিজের সাথে অসম্পৃক্ততা; মেয়েদের হস্তশিল্প, নকশা, বাগান, রান্নাবান্না ইত্যাদি নান্দনিক ও মননশীল কাজগুলোর কম অনুশীলন। দ্বিতীয়ত, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বোধের ফলে আমাদের পারিবারিক-সামাজিক সম্পর্কের ও দায়িত্বের যে নতুন আদল এতে করে আমাদের হাতে এখন প্রচুর অলস সময় এবং একই সাথে আমরা অনেক বেশি নিসঙ্গ। তৃতীয়ত, একই কারণে সামষ্টিক বোধের অবমনন এবং ব্যক্তি ধারণার যে কর্তৃত্ব, তাতে আমাদের সবাই নিজেদের আলাদা ডিভাইস, গেজেট ইত্যাদির মালিক; ফলে আমরা সেগুলোকে আমাদের মত করে ব্যবহার করি।

কিন্তু আমাদের এইসব গেইমিং কিংবা যে-কোনও ম্যাস-এন্টারটেইনমেন্টে আসক্তি মুশকিলের দাঁড়ায়, কারণ এই আসক্তিই মূলত আমাদের রিয়েল লাইফ এক্টিভিটিজগুলো থেকে এলিয়েনেশন ঘটায়। আবার রিয়েল লাইফের সে সমস্ত এক্টিভিটিজ থেকে দূরে থাকার ফলেই আমরা মূলত এইসব গেইমিংমের মতো ঠুনকো রিক্রিয়েশনাল এক্টিভিটিজ বা মাস-এন্টারটেইনমেন্টে আসক্তি হয়ে পড়ি। এইটা একটা লুপ-হোল। একটা অপরটার কারণ এবং ফলাফল।

মুশকিলটা আরো বেড়ে যায়, যখন এইসব গেইমিংকে আমরা রিয়েল লাইফ স্পোর্টস/শরীরচর্চার পরিপূরক মনে করি; আর সেটা আমরা অবচেতন মনেই করি। মানুষ তার ফিতরাতের কারণেই বয়স-সংস্কৃতি-জীবনাচার ভেদে এসাইনড জেন্ডার রোল এবং রেসপনসিবিলিটিগুলো পালন করার তাড়না অনুভব করে। পুরুষ তার ফিতরাতি তাড়নার কারণেই পুরুষ হয়ে ওঠে, তেমনি নারীও নারী হয়ে ওঠে তার ফিতরাতি তাড়নার বোধ থেকেই।

আমরা গেইম খেলার সময় প্রতিটা গেইমের প্রোটাগনিস্ট আমরা নিজেরাই, গেইমগুলোর আদলই এরকই। ফলে আমরা যখন কোন মিশন সফল করি বা যুদ্ধ করতে করতে জিতে যাই কিংবা রেইসে প্রথম হই, তখন আমরা সত্যিকার অর্থেই বাস্তব জীবনের কোন সাফল্যের মতই আনন্দিত হই। গেইমে জিতে যাওয়ার মাধ্যমে আমরা যেন আমাদের পৌরুষকে ফিল করি, এনজয় করি! অথচ এটা হলো বাস্তব জীবনে আমাদের পুরুষোচিত অক্ষমতা, অযৌগ্যতা, আলসেমিগুলোকে ঢাকতে চাওয়া, ভুলতে চাওয়ার প্রবণতা; একটা মিথ্যে সান্ত্বনা।

একই কথা মুভি/টিভি সিরিয়ালের ক্ষেত্রেও খাটে। আমরা সেখানে হয়তো নিজেরা প্রোটাগনিস্ট নই, তবে প্রায়শই আমরা নিজেদেরকে সেই প্রোটাগনিস্টের আসনে বসিয়ে নিয়ে আমাদের ফ্যান্টাসি/রোমান্টিসিজমকে যাপন করি। নারীরা কল্পনায় নারীত্বের স্বাদ নেয়।

যে মানুষ বাস্তব জীবনের রোল এবং রেসপনসিবিলিটি থেকে যত বেশি দূরে অথবা যত বেশি অক্ষম, সে ব্যক্তি তত বেশি মাস-এন্টারটেইনমেন্ট/কালচার ইন্ডাস্ট্রির কাছে জিম্মি। যে পুরুষ বাস্তব জীবনে খেলাধুলা, শরীরচর্চা থেকে যত দূরে, সে তত বেশি ভার্চুয়াল ভিডিও গেইমে আসক্ত। যে নারী যত বেশি গৃহস্থালি কাজ ও নান্দনিকতার চর্চা থেকে থেকে সে তত বেশি সিরিয়াল/রিয়ালিটি শো-তে আসক্ত। কারণ, মানুষ বাস্তবে না পারলেও কল্পনা বা ভার্চুয়ালি নিজের অক্ষমতাকে সক্ষমতায় রূপ দিতে চায়। ভার্চুয়াল এ জগত তার ফ্যান্টাসি পূরণ করার একটা ভার্চুয়াল স্বাদ মানুষকে দেয়।

অথচ মানুষ চেষ্টা করলে, সময় দিলে বাস্তব জীবনেই যে কোন সক্ষমতা অর্জন করতে পারে; অন্তত বর্তমান অবস্থার উন্নতি করতে পারে।