
ভূত বিলাসের ঘর
আত্মজীবনী ৪
শ্রেয়া চক্রবর্তীপ্রকাশিত : মে ১৮, ২০১৮
দাদুকে অর্থাৎ মায়ের বাবাকে `বুড়োবাবা` বলে ডাকতাম। বিকেল-সন্ধ্যায় সঙ্গী ছিল বুড়োবাবা। লম্বা, ফর্সা, টিকালো নাক, সুকণ্ঠের অধিকারী। বিকেলবেলা বুড়োবাবার কোলে চেপে রেলগাড়ি দেখতে যেতাম। ইঁট দিয়ে বাঁধানো টানেলের ওপর দাদু আমাকে দাঁড় করিয়ে দিতো। দূর থেকে হয়তো শোনা যাচ্ছে ট্রেনের হুইসেল, দাদু দ্বিগুণ উৎসাহে ‘ওই তো ট্রেন... দেখো... দেখো’ বলে লাফিয়ে উঠতো। নিমেষে চোখের সামনে দিয়ে ট্রেন গাড়ি হুশ করে হাওয়া হয়ে যেত। একটা একটা করে ট্রেন যেন এক একটা মুহূর্তকে ফালাফালা করে দিয়ে হারিয়ে যেত অনন্ত সময়ের গহ্বরে। সে মুহূর্তকে কল্পনা করা যায় না, অথচ সে কোনও না কোনও স্টেশনে স্থির হয়ে আছে তোমার ট্রেনের অপেক্ষায়। তুমি ট্রেন থেকে নামলেই সে তোমার হাত থেকে ছিনিয়ে নেবে পুরনো সব দলিল, তারপর একা একা তোমাকে স্টেশনে দাঁড় করিয়ে রেখে হারিয়ে যাবে সন্ধ্যার অপ্রস্তুত গলিতে, যা শেষ অবধি কোথাও গিয়ে পৌঁছোয় না।
ট্রেন থেকে কেউ কেউ হাত নেড়ে যেত। যে ট্রেন চলে যায় সে আবার কখন ফেরে? যে অপরিচিত হাত একবার মনটা নাড়া দিয়ে চলে যেত তার সাথে আর কেন দেখা হয় না কখনো? এমন অনুসন্ধিৎসা থেকে ফিরতি পথে অচেনা মানুষজনকে ডেকে ডেকে কতই না প্রশ্ন করতাম, ও দিদুন তোমাল বালি কোথায়?
ওই তো আমার বাড়ি।
তোমাল বালিতে কে আছে?
ছেলে আছে, নাতি আছে...
বৃদ্ধা গাল টিপে দিয়ে চলে যেত। আসন্ন সন্ধ্যায় ঝুম হয়ে থাকা বাড়িগুলোর কত রহস্য ছিল। বারান্দার গ্রীল ধরে চেয়ে থাকা কোনও চোখের ঔদাসীন্য, হঠাৎ ঘুরে তাকানো একঝলক গ্রীবা, জানলার উড়ন্ত পর্দা, দরজার ছিটকিনি খোলার শব্দে মনটা আনচান করে উঠতো। সে অনুভবের ভাষা ছিল না সেসময়, কিন্তু জগৎ-সংসারের প্রতি অপার বিস্ময় বোধ ছিল। সন্ধ্যাবেলা বুড়োবাবার সাথে জমে উঠতো গল্পের আড্ডা। দাদু নাকি তখন কিশোর, থাকতো সদানন্দ রোডের বাড়িতে। রাতদুপুরে কে নাকি খাটটা হিড়হিড় করে টেনে জানলার কাছে নিয়ে যেত। দাদু গ্যাছে একদিন নিমডাল পাড়তে। দাদু দাঁড়িয়ে নিম গাছের বেদির ওপর। দুটো ষাঁড় নাকি মাটি ফুঁড়ে উঠে এলো, তারপর দাদুর চারদিকে বোঁ বোঁ করে ঘুরতে লাগলো। এইসব গল্পের মাঝখানে হঠাৎ যদি ঝড় বৃষ্টিতে পাওয়ার অফ হয়ে যেতো তাহলে তো কথাই নেই। বিদ্যুৎ চমকে দেখছি হু হু করে উড়ছে জানলার পর্দা। রান্নাঘর থেকে কে নাকি তখন হাত বাড়াচ্ছে উঠোনে লেবু পাতা পাড়বে বলে। মনের ভিতরের সুড়ঙ্গে এইসব অলৌকিক চরিত্রেরা জমিয়ে বসেছিল সেইখানে, যেখানটা ঠিক আলোকিত নয় আবার পুরোপুরি অন্ধকারও নয়। সেখানে কারা যেন কথা বলাবলি করতো সারারাত। ঝরে পড়তো লেবুপাতা। হাওয়া দিতো আর লেবুপাতার গন্ধে মনের ভিতরটা কেমন মা-মা করে উঠতো।
সেই সময় হঠাৎ মনে পড়তো, মায়ের ফিরতে এত দেরি হচ্ছে কেন? সেদিন হয়তো ঝড়বৃষ্টি। দাদুর পাশে আগডুম বাগডুম হয়ে বসেছিলাম। নিঃসাড়ে উঠে গিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতাম। মা এখনো কেন ফিরছে না? মা ফিরবে তো? মা যদি আর না ফেরে? এইসব নানা সংশয়ের মধ্যে শুনতাম গেট খোলার শব্দ! হঠাৎ আলো জ্বলে উঠতো। আমাদের বাড়ির পাশে থাকতো রুণুদিরা। রুণুদির মা-বাবা রুণুদি আর রুণুদির ভাই। মা মাঝে মাঝে বিকেলবেলা আমাকে রেখে যেত রুণুদির বাড়ি। রুণুদির বাবা আমাকে তার পাহাড়ের মতো উঁচু ভুড়ির ওপর বসিয়ে কীসব অদ্ভুত খেলা খেলতো। তখন তো একেবারেই শিশু। সবাই হয়তো পাশের ঘরে। মোটা লোকটা আমার কচি হাত দুটো নিয়ে তার শরীরের কোথায় কোথায় সব ঘষতো। ওই বয়সে এসবের অর্থ বোধগম্য হতো না, কিন্তু বিষয়টা যে অস্বাভাবিক তা বুঝতাম। বড় হয়ে স্মৃতি হাতড়ে বুঝেছিলাম, লোকটা ছিল পেডোফিল, মানে শিশু নিগ্রহকারী। এইসব বিকৃত রুচিসম্পন্ন লোকেরা তো আর অন্য গ্রহ থেকে টপকায় না, এরা কারো না কারো বর ছেলে বাবা কাকা দাদু যে কেউ হতে পারে।
এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে যত রকম প্রাণ, তার আনন্দ নেয়ার রুচিও ততোধিক বৈচিত্র্যসম্পন্ন। কিন্তু কারো শরীর মনকে কষ্ট দিয়ে আত্মাকে বিকৃত করে যে আনন্দ নেয়ার ঔদ্ধত্য, তাকে সমর্থন করা যায় না। মানুষের যে দানবিক প্রবৃত্তি এবং তার চরিতার্থতার জন্য যে আয়োজন, বিশ্ব ইতিহাসে তার নজির অসংখ্য। কিন্তু মানুষের মধ্যে সুকোমল প্রবৃত্তিও আছে, প্রেম আছে, সহানুভূতি আছে। মানুষ একাধারে শয়তান আবার সে ঈশ্বরও। তুমি তোমার মধ্যে যাকে বাড়তে দেবে, তুমি আসলে সে। পেডোফিলিয়া বা চাইল্ড মোলেস্টেশনের সাইকোলজিকাল বেস কতটা জেনেটিক আর কতটা শৈশবের শিক্ষা বা অভিজ্ঞতা কেন্দ্রিক, আমি তা জানি না। কিন্তু এইসব লোকগুলো সজ্ঞানেই নিজের ভেতরের পৈশাচিক উল্লাসকে প্রশ্রয় দেয়। যৌনতাকে আমাদের সমাজে অনেকভাবেই স্যাডিজমের একটি ইনস্ট্রুমেন্ট হিসেবে ব্যবহার করা হয়, এবং যার ওপর তা অ্যাপ্লাই করা হয় সেই সাবজেক্টকে অনেকাংশেই দুর্বল বলে গণ্য করা হয়। স্বভাবতই শিশু ও নারীরাই এর ম্যাক্সিমাম ভিক্টিম। এসব মানুষগুলোর রিহ্যাবিলিটেশন দরকার। এরা অনালোকিত। এরা বর্বর। এরা অসভ্য ইতর। এরা মনোরোগী।
বুড়োবাবা খুব ভালো লিখতো। দুপুরবেলা স্নান খাওয়া সেরে বারান্দায় মাদুর বিছিয়ে সাদা পাতায় খসখস করে কেবল লিখতো। গল্প কবিতা আরো কত কী! দিস্তে পাতা সুতো দিয়ে সেলাই করে বড় বড় হরফে নাম লিখে নিজের বই নিজেই বাঁধিয়ে রাখতো। একজন মানুষের ভিতর তো আসলে বহু মানুষ বাস করে, উত্তরাধিকার সূত্রে মানুষ কেবল টাকা-পয়সা সম্পত্তি পায় না, সে সেই অসংখ্য সত্তাকে নিজের ভিতর বহন করে চলে। এর ওপর তার কোনও হাত নেই। এ সম্পদ নিতান্তই তার জন্মগত। আমি তুমি আমরা সবাই এমন অনেক চরিত্রের জটিল ক্যালাইডোস্কোপ, কত হারিয়ে যাওয়া মানুষ তাদের হারিয়ে যাওয়া কথা আমাদের রক্তের মধ্যে বুদবুদ হয়ে ভেসে বেড়ায়। আর আমার মধ্যে যে মানুষটা লেখে, লিখে চলে, কোনও হলুদ হয়ে যাওয়া খাতায় যার কলম খসখস করে এখনো অনেক অক্ষর ফুটিয়ে তোলে, সে আমার দাদু, বুড়োবাবা। রাত্রিবেলা যখন মায়ের পাশে শুয়ে থাকতাম, ফুরফুর করে হাওয়া দিত, কান পেতে শুনতাম দাদু গাইছে, শাওন রাতে যদি স্মরণে আসে মোরে/বাহিরে ঝড় বহে নয়নে বারি ঝরে।
মনে পড়ে। ঝড় হয়। জল ঝরে। সব হরফ ঝাপসা হয়ে যায়। শুধু সে তার খবর পায় না আর।
চলবে