
ভূত বিলাসের ঘর
পর্ব ১০
শ্রেয়া চক্রবর্তীপ্রকাশিত : জুন ২৪, ২০১৮
তুমি কার সন্তান? শুধু সেই মায়ের যে তোমাকে গর্ভে ধারণ করেছে? সেই পিতার যার রক্ত তোমার ধমনীতে বইছে? নিজেকে বহুবার প্রশ্ন করে দেখেছি আমার জেনেটিক মানচিত্রের বাইরেও আমি অক্টোপাসের মতো এক ক্রমপ্রসরমাণ অস্তিত্ব, এক অথচ অনেক, আমি অসংখ্য চরিত্রের মায়াজাল। আমি কেবল তার নই যার রক্ত আমার রক্তে মিশে আছে, আমি তারও সন্তান যার ভাবনা আমার ভাবনায় মিলে আছে গোধূলির আকাশে ছড়িয়ে পড়া সূর্যালোকের মতো।
সেই অর্থে আমি বাবুইয়ের সন্তান, যে আমাকে একটি শর্তহীন বন্ধুত্বের সম্ভাবনায় অনুপ্রাণিত করে। আমি সেই বিদ্যালয়ের যে তার সবুজ মাঠ রাধাচূড়ার বেদী তার বৃষ্টি ধোয়া কাগজফুল খেলাঘর আর ক্লাসরুমের অপার মমত্বে আমাকে ভিজিয়ে রাখে আজীবন। আমি সেই স্টেজের যে আমাকে `বায়েন` বানায় আবার `পুরস্কার` এর মিঠু, যেখানে দাঁড়িয়ে জীবন আর আমার মাঝখানে রচিত হয় কাল্পনিক সংলাপের সেতু। আমি সেই সকল বন্ধুদের যারা আমাকে আশ্রয় দেয়। আমি সেই শিক্ষকদের যারা আমাকে অনুপ্রাণিত করে। আমি সেই সবার যারা আমাকে ভালোবাসে, তাদেরও যাদের ভালোবাসার যোগ্য হয়ে উঠতে পারিনি হয়তোবা। তাদের সবার অংশে অংশী আমি।
ক্লাস সিক্স থেকে টেন অবধি আমরা চারজন ছিলাম ভীষণ বন্ধু। আমি, বৃষ্টি, স্নেহ আর সোহাগ। বৃষ্টি সারাক্ষণ তিড়িংবিড়িং করতো। স্নেহ হ্যাপি গো লাকি, সময় পেলেই দেখতাম একটা ঘুম দিয়ে নিলো। সোহাগের সাথে খুনসুটি লেগেই থাকতো। আর আমার বেঞ্চ পার্টনার ছিলো রোদ। সে ছিল আমার কবিতার প্রথম পাঠক আর স্ক্রিপ্ট রাইটিংয়ের অবিচ্ছেদ্য পার্টনার। ছিল আরো অনেকেই, যাদের তুমি ফুল পাতা গাছ কিংবা আকাশ যেকোনো নামেই ডাকতে পারো। যাদের নিয়ে আমার জীবনের ঝাপসা হয়ে যাওয়া ছবিটা একটু একটু করে বর্ণময় হয়ে উঠছিল। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে একলা ঘরে বইখাতা আর টুল বিছিয়ে এদের সাথে মনে মনে চলতো কতই না কথোপকথন। বসন্তের মাঠে যখন গোল হয়ে বসতাম সবাই, ফুলের ডিমান্ড ছিল ওই গানটাই গাইতে হবে,
আহা আজি এ বসন্তে
এত ফুল ফোটে
এত বাঁশি বাজে
এত পাখি গায়...
সখীর হৃদয় কুসুম কোমল
কাহার অনাদরে আজি ঝরে যায়?
সখীদের অনাদরে হৃদয় ঝরে যেতো বৈকি। চলতো কত অহেতুক দুষ্টুমি, মান অভিমান আর মান ভাঙানোর পালা। বৃষ্টি স্নেহ কিংবা সোহাগের বাড়ি চলে যেতাম কতদিন, তাদের মা বাবারাও আমাকে নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসতেন। সেসব বিকেলের কত ঝরে পড়া আলোয় ভিজেছিলাম আমরা নীরবে, যে আলো কখনো মরেনা, তোমার ভেতরের দমবন্ধ হাঁপিয়ে ওঠা ভেঙে যাওয়া শৈশবকে হার মানতে দেয় না, নীরবে কান্নার কাঁধটুকু রাখে অবিরাম।
ক্লাস এইটে আমার বেস্টফ্রেন্ড ছিল চাঁদ। অফ পিরিয়ডে আমি হয়তো দাঁড়িয়ে আছি দরজার কাছে, আমার হাত ধরে সে টেনে নিতো বারান্দায়, তারপর মাঠে। কোনোদিন স্কুলে গিয়ে যদি দেখতো আমি আসিনি, বাড়ি ফিরেই হাঁপাতে হাঁপাতে টেলিফোন, ‘কিরে তোর কি হয়েছে?’ আমি অন্য কাউকে গুরুত্ব দিলে তার ঈর্ষা হতো। আর কানে কানে ফিসফিস করে জগতের কত তথ্যই যে দিতো তার কোনো শেষ নেই। ভালোবাসাবাসি ছিল খুব। তারপর হঠাৎ একদিন কি হলো ঠিক মনে নেই। সরে আসাটা আমার দিক থেকেই ছিল। কেন তার প্রতি রূঢ় হয়েছিলাম জানি না, তবে কষ্ট দিয়েছিলাম ভুল বুঝেই। কিন্তু যেদিন তা বুঝেছি, যে এ আমার ভুল ছিল, তারপর থেকে বহুদিন কেবল একটা সুযোগ খুঁজেছি তাকে `সরি` বলার। বলেওছিলাম। সেদিন সে বদলে গিয়েছিল নিশ্চয়ই, কিন্তু সেই বদলে যাওয়া আমার কাছে প্রাসঙ্গিক ছিল না।
কাউকে কষ্ট দিয়েছি এ অনুভবের বোঝা বয়ে বেড়ানো বড় শক্ত। এমন বোঝা বোধ হলে মুক্ত হওয়া উচিত, নিজের ইগোকে প্রায়োরিটি না দিয়েই। দেখো আমিও তো অনেক ভুল করেছি। বুঝে বা না বুঝে কিছু মানুষকে হয়তো কষ্টও দিয়েছি। তাই তুমি যখন আমাকে ভুল বোঝো ব্যথা দাও কষ্ট হয় বৈকি, কিন্তু তার জন্য মনে মনে তোমার ওপর রাগ পুষে রাখা আমাকে মানায় না। যখন তুমি আমার হাত ছেড়ে দিয়ে চলে যাও, কষ্ট পাই, কিন্তু রাগ করি না, আমিও তো অমন ছেড়ে চলে গেছি কারো কারো হাত। ক্ষমা তো তারই প্রাপ্য হয় যে ক্ষমা করতে জানে। স্কুলজীবনে যে মেয়েটাকে মনে হতো খুব ইন্ট্রোভার্ট শুধু গাছের সাথে কথা বলে, সেই নদীর সাথে যখন পরে মিশেছি বুঝতে পেরেছি সেও ভালো বন্ধু হতে পারে। তাই কেবল দূর থেকে দেখে কোনো মানুষের সম্পর্কে জাজমেন্টাল হওয়াটা ভুল। ঠিকঠাক স্পেস দিলে বুঝবে সবচেয়ে কথা কম বলা মেয়েটারও কত কিছু বলার আছে। প্রতিটা পাখি তার নিজস্ব স্বরে কথা বলে, প্রতিটা ফুলের সুগন্ধ আলাদা, কেউ কারো মতো নয়।
তাই আমি জানলা দরজা খোলা রাখি। যাতে হাওয়া চলে, আলোর অভাব না হয় কখনো। সারা জীবন একটা বন্ধুত্বের ইকুয়েশন বহুবার বদলায়। তবু ভালোবাসে তারাই যারা শেষ অবধি ভালোবাসতে পারে। যারা বিশ্বাসে থাকে তারা শেষ অবধি রাখার চেষ্টা করে। একবার কোনো ম্যাগাজিনে কবিতা ছাপানো নিয়ে এক বন্ধুর সাথে বেশ রাগারাগি হয়েছিল। সে বেশ শ্লেষ নিয়ে আমাকে বললো, ‘তাহলে তুই বরং `দেশ` এ দে।’ তখন দেশে কবিতা পাঠানোর বয়স হয়নি। পরবর্তী কালে `দেশ` এ কবিতা বেরিয়েছে আমার একাধিকবার। কিন্তু তার থেকেও বেশি আনন্দ পেয়েছিলাম যখন একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি সেই বন্ধুর ম্যাসেজ,
হার আইটি ফ্রেন্ডস টিজড হার ফর
টেকিং হনার্স ইন লিটরেচার.
অ্যাট দ্য এইজ অফ সেভেন্টি, হার নভেলস
বিকেম দ্য অনলি কম্পেনিয়ান
অফ দেয়ার রিটায়ার্ড লাইফ।
এর নিচে লেখা ছিল,
ফর ইউ... মাইট বি নট এক্স্যাক্টলি সেম অ্যাজ
ইউ ওয়্যার নেভার ট্রলড বাট হনেস্টলি
সামটাইমস উই রিগ্রেটেড দ্যট আ সুপার্ব
স্টুডেন্ট লাইক ইউ টুক লিটরেচার।
বাট ইয়েস... ইউ মেইড আস প্রাউড
লাভ ইউ।
কেন লিটরেচারে এসেছিলাম সে কথায় আসবো পরে। তাকে গর্বিত করার মতোই বা আমি কি করেছিলাম! সত্তর বছরে সে আমার লেখা পড়বে কীনা তাও জানি না। কিন্তু এই ম্যাসেজে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল শেষ শব্দ দুটো, লাভ ইউ। ভালোবেসে যারা আমাকে হেরে যেতে দেয়নি কোনোদিন, সবকিছুর শেষে আমার শব্দেরা তাদের কাছে ঋণী হয়ে থাকে।
মনে মনে তখন গিয়ে বসি নীরবে সেই পুকুরধারের ক্লাসরুমটায়। একঝাঁক মাথা খাতার ওপর নুয়ে পড়ে কী যেন লিখছে। ভাস্বতী দিভাই তখন পড়াচ্ছেন, `লেটার ফ্রম আ ফাদার ট্যু হিজ ডটার`। মুগ্ধ হয়ে শুনতে থাকি। পাশের বারান্দায় তাকিয়ে দেখি, সুচিত্রা দিভাই বাঙলার টেক্সট বুক হাতে নিয়ে চলে গেলেন। মুখে লেগে আছে মাতৃসুলভ হাসি। রমাদিভাই যার ঋজুতা দেখে বরাবরই মনে হতো যেন একজন সাধিকা অঙ্কের বই নিয়ে অপেক্ষা করছেন এর পরের ক্লাস তার। দূর থেকে ভেসে আসে সুদীপ্তা দিভাইয়ের কণ্ঠস্বর, ‘এই সবাই চুপ চুপ চুপ।’ মাথার ভেতর এতক্ষণ কথা বলছিল যারা, হঠাৎ চুপ করে যায়। এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা আর নস্টালজিয়ায় শিহরিত হতে হতে দেখি, আমি দাঁড়িয়ে আছি খেলাঘরে সেই স্টেজের পাশটায়। যে আমি এখনো এ জীবনের খেলাঘরে একা একা অন্ধকারে কতই না সংলাপ বলে চলি, দেখি কোনোরকমে মেকাপটা কমপ্লিট করে তাকে ঠেলেঠুলে স্টেজে তুলে দিলো পারোদি, স্টেজের পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে রোদ। সংলাপ ভুলে গেলেই ধরিয়ে দেবে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে মৃদু মৃদু হাসছে পল্লবিতাদি। ভাবছে, উঁহু যেমন শিখিয়েছিলাম পারবে কি? এবার বোধহয় ডুবিয়ে দিলো। পাশ দিয়ে কে যেন মুচকি হেসে বেণী দুলিয়ে চলে গেল, তারপর কে যেন বলে উঠলো ফিসফিস করে, ‘এই এই শুরু কর... ম্যাকবেথ...।’ আলো নিভে যায়। আমি বলতে থাকি,
টুমরো টুমরো অ্যান্ড টুমরো
ক্রিপস ইন দিজ পেটি পেস ফ্রম ডে ট্যু ডে
ট্যু দ্য লাস্ট সিলেবল অফ রেকর্ডেড টাইম
অ্যান্ড অল আওয়ার ইয়েসটারডেজ হ্যাভ
লাইটেড ফুলস
দ্য ওয়ে ট্যু ডাস্টি ডেথ
আউট আউট ব্রিফ ক্যান্ডেল
লাইফ ইজ বাট আ ওয়াকিং শ্যাডো
আ পুয়োর প্লেয়ার
দ্যট স্ট্রাটস অ্যান্ড ফ্রেটস হিজ আওয়ার
আপঅন দ্য স্টেজ
অ্যান্ড দেন ইস হার্ড নোমোর।
ইট ইস আ টেল
টোল্ড বাই অ্যান ইডিয়ট
ফুল অফ সাউন্ড অ্যান্ড ফিউরি
সিগনিফাইং নাথিং।
হলজুড়ে কারা যেন হাততালি দিয়ে ওঠে।
চলবে