ভূত বিলাসের ঘর

আত্মজীবনী ১১

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : জুন ২৭, ২০১৮

মনের মধ্যে বয়ে বেড়াচ্ছো অনেক উঁচু উঁচু পাহাড়— এক একটা মিথ— যেগুলো ভাঙা বড় দরকার। নিজের মুখোমুখি হওয়া, নিজের ভেতর নামা, সে বড় ব্যথার, তবু দরকার।

ভয়
আমাদের যাবতীয় ভয়। এগোতে ভয়, পিছোতে ভয়, সত্যের সামনে দাঁড়াতে ভয়, অসফল হওয়ার ভয়— এসবের ভেতর লুকিয়ে আছে মৃত্যুভয়। যেকোনো কষ্টই তো আসলে এক একটা মৃত্যু।

`মৃত্যু` অর্থাৎ যা কীনা একটা দীর্ঘ অভ্যেস থেকে হঠাৎ বিচ্যুতি। একলা হয়ে পড়া এমনই এক দূরবর্তী স্টেশন, যেখান থেকে আর কাউকে কোনো কিছুকেই স্পর্শ করা যায় না। জীবন একটা অভ্যেস। তোমার বাড়ির বারান্দায় নুয়ে পড়েছে যে পাতাঝরা গাছটি, তোমার জানালায় বসে থেকে থেকে যে পাখিটি উড়ে গেল এইমাত্র সামান্য শিহরণে, সেও জীবন। কিন্তু ওরা তেমন করে মৃত্যুকে রেসিস্ট করে কই, যেভাবে মানুষ করে?

মানুষ সেই সবকিছুকেই রেসিস্ট করে যা মৃত্যুর মতো। কারণ সে একা হয়ে যেতে ভয় পায়। অথচ এর চেয়ে গূঢ় সত্য আর কী আছে যে, সে একা এবং মরণশীল?

ছেলেটি ছোটবেলায় আমার সাথে আঁকা শিখতো। নিজের ড্রইংবুকে তার মতি ছিল না। নিজের রঙবাকসো ছেড়ে সে বারবার আমার খাতায় ঝুঁকে পড়তো। তারপর বেঁকে যাওয়া ছাতার হ্যান্ডেল, নুয়ে পড়া তালগাছের পাতা, গোল হতে হতে না হওয়া বালিকার মুখ ঠিক করে দিত পেন্সিল ঘষে ঘষে। তারপর একদিন কোথায় হারিয়ে গেল।

বছরখানেক আগে হঠাৎ তার ফোন, কেমন আছিস? ছবি আঁকিস এখনো? একদিন দেখা কর। কিছু বলার ছিল।
আমি চিরদিনই সে মানুষের অনুরাগী, যার ভেতর এমন কোনো আলো আছে যা দিয়ে সে আমাকে ছুঁয়ে দিতে পারে। সবসময় সজাগ থাকি, হয়তো সে মানুষটি আমার পাশ দিয়েই চলে যেতে যেতে স্মিত হেসে গেল। অথচ আমি তাকে চিনতে পারলাম না! সেদিন সন্ধ্যার কফিশপে সেই ছেলেটিকে আমার এমনই আলো বলে মনে হয়েছিল। জীবনের সবচেয়ে কঠিন লড়াই লড়তে লড়তে সে নিজের মধ্যে সেই আলো জ্বালিয়েছিল, যার হদিশ আমি পেয়েছিলাম।

আমার লিউকেমিয়া হয়েছে।
স্ত    ব্ধ    তা
কীরে কিছু বলবি না?
আমার ভয় করছে।
কীসের ভয়? আমারও ভয় করতো। এখন আর করে না।
কাকু কাকিমা কেমন আছে? আর তোর সেই বান্ধবী?
ও বিয়ে করেছে। বিদেশে আছে। কী হবে আর আমার সাথে থেকে? ওর মা এখানে একা, খুব অসুস্থ ছিলেন মাঝখানে। যেটুকু দরকার করেছি, সুপর্ণা আমেরিকা থেকে ফোন করে থ্যাঙ্কস জানিয়েছে।

স্ত    ব্ধ    তা
কীরে কিছু বল। আমি এখন ভালো আছি। আমার আর ভয় করে না।
সেদিন আমার আর তার ভয় পাওয়া আর না পাওয়ার মাঝখানের গ্যাপটুকু একটি কঠোর সত্যকে গ্রহণ করতে পারা আর না পারার মধ্যে ন্যস্ত ছিল। সে তার আর তার মৃত্যুর মাঝামাঝি দূরত্বটুকু সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল আর আমি ছিলাম সম্পূর্ণ অজ্ঞাত। সেই না জানার অন্ধকারটুকু কেটে গেলে আর ভয় থাকে না। যেদিন ভয় সামনে এসে দাঁড়ায়, তার চোখে চোখ রেখে দেখতে শিখলে ভয় ভেঙে যায় চিরদিনের মতো।

তাই যেদিন বুঝবে তুমি আসলে একাই, সেদিন আর একা হতে ভয় কিসের? এই ব্রহ্মাণ্ডে কত যে একা তুমি! নো ওয়ান ক্যান ওয়াক ইন ইওর স্যুজ। কেউ তোমাকে ভালোবাসবে কেউ তোমার বন্ধু হবে এমন অপেক্ষায় থেকো না। ধরে নাও, ওটা হবে না। আর যদি বিশ্বাস করো ওটা হবে, তাহলে আগে নিজে ভালোবাসো, আগে নিজে বন্ধু হয়ে দেখাও।

বিশ্বাস
যে বিশ্বাস ভাঙে সে আমাদের একটা চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড় করায়। সে শুধু আমার সাথে তার সম্পর্ক নয়, সে অন্য যে কোনো সম্পর্ককে একটা প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করায়। কিন্তু যে বিশ্বাস ভাঙে দায় শুধু তার? যে বিশ্বাস করে তার কোনো দায় নেই? যে বিশ্বাস নিয়ে এত মাথা কুটে মরো, আগে তো জানো যে সেই `বিশ্বাস` আসলে এক কল্পনা। যাকে বিশ্বাস করেছিলে বলে তোমার খুব গর্ব, তার থেকে কিছু কিছু রঙ নিয়ে তার ছবি এঁকেছিলে তুমি তোমার মনের মতো করে, যেমনটা হলে তোমার খুব ভালো লাগে ঠিক সেভাবেই। এখন আঁকাটা যদি তোমার ভুল হয়, আঁকার পর যদি দেখো মানুষটার সাথে মিলছে না, সে দায় কি পুরোপুরি তার হয়? চিত্রকরের একবারেই নয়? যার থেকে ব্যথা পাও তাকে ছেড়ে দাও। ছবিটা না-হয় নাই ছিঁড়লে। ছবির মতো একটা মানুষ কোথাও আছে হয়তো, দেখা হলে চিনে নিও।

মেয়েটির নাম মৌ। এক অনুষ্ঠানে তার সাথে আমার আলাপ, বন্ধুত্ব। সে একটি ছেলেকে ভালোবাসতো। বাড়ির লোক জোর করে অন্য কারোর সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়। তারপর একদিন আমাকে ডাকলো। তখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ি।
আমি ভালো নেই। অ্যাডজাস্ট করতে পারছি না।
কেন?
আমি এখনো সুমনকে ভালোবাসি। ফিরে যেতে চাই।
তুই সিওর?
হ্যাঁ। কিন্তু কেউ আমাকে বিশ্বাস করছে না। বাবাও নয়।
কেউ তোকে অবিশ্বাস করছে এমন নয়। তারা তোকে যা ভাবে তোকে নিয়ে মনে মনে যে ছবিটা এঁকেছে সেটাই আঁকড়ে থাকতে চায়। তুই তো তুই। আর কে তোকে কী ভাববে সেটা তার দায়।

তারপর মাঝেমাঝেই ওর ফোন আসতো। কিছু বলতে চাইতো, কেঁদে ফেলতো। শেষে একদিন সাহস করে এগিয়ে গেল ভালোবাসার কাছে, ভালো থাকার কাছে।

সাফল্য
ক্লাস সেভেন। শিক্ষিকা ঘুরে ঘুরে ক্লাসের সব ছাত্রীদের জিজ্ঞেস করছিলেন কার কী সমস্যা হচ্ছে লেখাপড়া সংক্রান্ত। কেউ কেউ নিজের সমস্যা জানাচ্ছিলো, তখন শিক্ষিকা অন্য একজন ছাত্রীকে দাঁড় করিয়ে তার মতো করে সমাধান দিতে বলছিলেন। দারুণ ইনট্যারকশন হচ্ছিলো।

একজন উঠে দাঁড়িয়ে বললো, দিদিভাই রেজাল্ট খারাপ হচ্ছে। আমি কিছু মনে রাখতে পারছি না। একবার পড়লেই ভুলে যাই।
উনি এবার আমাকে দাঁড় করালেন। বললেন, তোমার কিছু বলার আছে ওকে? আমি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, আসলে আমিও ভুলে যাই। তখন আবার পড়ি। তারপরেও ভুলে গেলে আবার।

অর্থাৎ আমি একবার ভুলে গেলে দ্বিতীয় বার তৃতীয় বার পড়ার জন্য নিজেকে মোটিভেট করতে পারতাম, আর সে হয়তো পারতো না। আসলে স্কুল কলেজ লেভেলের ভালো রেজাল্ট তৎপরবর্তী নিজের গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য মানুষ যেসব সামাজিক কাজগুলো বেছে নেয় তার কোনটা করার জন্যই রবীন্দ্রনাথ বা আইনস্টাইনের মতো ট্যালেন্টেড হওয়ার দরকার হয় না। সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের মতো বুদ্ধি, আর অধ্যাবসায় থাকলে অনেকেই সেটা পারে। যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো, মোটিভেশন। সবাই সব কাজের জন্য নিজেকে মোটিভেট করতে পারে না। যেকোনো পথই তো কোনো না কোনো একটা সীমানার দিকে নিয়ে যায়। সেই সীমানায় নিজেকে দেখে মনে মনে অ্যাপ্রিশিয়েট না করা গেলে সেই কাজের দিকে নিজেকে টেনে নিয়ে যাওয়া যায় না। তাই আমার কোনো বন্ধু যেমন দ্বিতীয়বার একই চ্যাপটার পড়ায় নিজেকে মোটিভেট করতে পারতো না, আমিও তেমনি স্পোর্টসের মাঠে কোনোদিনই নিজেকে উদ্বুদ্ধ করতে পারিনি। চিরদিন গোল্লা খেয়ে বাড়ি ফিরেছি।

প্রত্যেক মানুষের কাছেই এমন একটা স্কিল আছে যা অন্যের কাছে নেই। মধ্যবিত্ত সমাজে কাজের বেসিসে যে ধরনের ডিমার্কেশন চলে আবার কোন কোন কাজ করলে সমাজে প্রায় কুলীন ব্রাহ্মণের মর্যাদা পাওয়া যায়—  এসবই মেন্টাল ব্লক এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে অধুনা অর্থনীতিতে মার্কেটিং স্ট্রাটেজির অবদান। নৌকো চালাতে একটা স্কিল লাগে আবার প্লেন চালাতেও। তা’বলে মাঝি আর পাইলটের মধ্যে এত ফারাক কেন? আকাশ পেরোনো থেকে নদী পার হওয়া অনেক সহজ বুঝি? সামান্য একপারানির খেয়া আর সে মাঝি যে বসে আছে অনন্তের হাল ধরে, সে আর কী জানে আকাশের অসীমতা! কিন্তু আমার কাছে তো দুজনেই এক। আমি না পারি আকাশে উড়তে, না পারি জলে সাঁতার দিতে। দুই ক্ষেত্রেই একই রকম অসহায় আমি। তাই পাখিদের দেখি, মাছের দিকে চেয়ে থাকি অপার মুগ্ধতায়!

একবার এক প্রাজ্ঞ ব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করেছিলাম সফল মানুষ কে? তার উত্তরে তিনি যা বলেছিলেন সে প্রায় কবিতার মতো, ‘যে সত্যের খুব কাছাকাছি, যেন দুজনেই দুজনের প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে পায়। যে এই নশ্বর জীবনের যাবতীয় বিষামৃত তাবিজের মতো ধারণ করেছে। হু ইজ ট্রান্সফর্মড ইনট্যু লাইট ট্যু ইলুমাইন অল দ্য ডার্কনেস অ্যারাউন্ড। যে আলো সেই তো ঈশ্বর। সফল যে মানুষ সাফল্যের মানে ভুলেছে সে অক্লেশে।’

কবিতা লিখছি তখন নিজেকে খুঁজে বেড়ানোর মতো করে। তখন বয়ঃসন্ধি। জীবন কত নতুন নতুন রূপ রস সুগন্ধ নিয়ে আসছে প্রতিদিন। আগে যাদের সহপাঠী ছাড়া কিছুই ভাবিনি কখনো, সেইসব সদ্য গোঁফের রেখাওঠা ছেলে বন্ধুদের কী আশ্চর্য রকমের ভালো লাগছে, যেন কত রহস্য ভরে রেখেছে ওদের গোপন আতরের শিশিতে।

আত্মসচেতন হয়ে উঠছি ক্রমশ। আমার ঘোরলাগা একা একা কথা বলে চলা জীবনের পোস্টবক্সে তখন নতুন নতুন চিঠির সমারোহ। দরজায় কান পেতে বসে থাকার সময় তখন। খুট করে আওয়াজটাকেও ছাড়া যায় না। খাম খুলে পড়তে থাকি সদ্য কৈশোর পার হতে থাকা সে জীবনের গোপন জবানবন্দি।

কোচিং ক্লাসে আসতো একটি ছেলে। পিঠে ব্যাগ। স্ট্রেট হ্যান্ডেল সাইকেল। নাম ছিলো রঙিন। আমি তখন ক্লাস এইট অ্যান্ড হি ওয়াজ মাই ফার্স্ট এভার ক্রাশ। বন্ধু ছিল সে আমার। প্রেমিক হয়নি কোনদিন। মাঝে মাঝে কথা হতো। মাঝে মাঝে দেখা। মাঝে মাঝে হাঁটতাম তার সাথে কোচিংফিরতি কিছুটা পথ সন্ধ্যার পালকের নিচে। আর তার অদ্ভুত মিষ্টি হাসি, নিচু নিচু স্বরে বলা কথার অনুরণণ আমাকে ঘিরে রাখতো বহুক্ষণ। এ এক নেশার মতো। যেন এক না লেখা কবিতার মাঝে বুঁদ হয়ে থাকা অপরিণত জীবনের প্রশ্রয়ে। সে আমাকে ভালোবাসতো কীনা তাও জানা হয়নি। শুধু একটি কার্ড তার সৃজনশীল উষ্ণতার ছোঁয়ায় সে রেখে গিয়েছিল আমার হাঁ করে বসে থাকা মুগ্ধতম অপার কৈশোরের নাম ঠিকানাহীন পোস্টবক্সে, আর তাতে লেখা ছিল,
হোয়াট ট্যু ডু মোর ফর ইওর আইজ অনলি
ট্যু শ্রেয়া,
ইচ্ছে করলো তোকে কিছু একটা দিতে...
পকেটে হাত দিতেই বুঝতে পারলাম, এখনও সময় হয়নি...
তবু মন চাইছিল কিছু দিইই...
হাতের কাছে পেলাম কতগুলো পুরনো ম্যাগাজিন। কাঁচি আঠার সাহায্য পেলাম আর বানালাম `এটা`...
যার মাথামুণ্ডু আমারও অজানা....

সেই মাথা মুণ্ডুহীন গন্তব্যহীন নাম না-জানা ব্যথা, ভালোলাগা আর অপার বিস্ময়ের ওড়নার নিচে আমার বয়ঃসন্ধি আড়মোড়া ভাঙছিল সেদিন, আর অপেক্ষা করছিল একগোছা রজনীগন্ধা হাতে সাইকেল নিয়ে তার দরজায় অপেক্ষমান কোনো রঙিন বিকেলের জন্য। ❤

চলবে