
ভূত বিলাসের ঘর
আত্মজীবনী ১২
শ্রেয়া চক্রবর্তীপ্রকাশিত : জুন ৩০, ২০১৮
যে কোনো অনুভূতি যা গভীর অথচ নতুন তার একটা আবেশ থাকে। সে আবেশ যেন কোনো অলৌকিক সরোবরে স্থির হয়ে থাকা জল। যার ভেতরে নামতে ইচ্ছে হয়, স্নান করতে ইচ্ছে হয়, স্নান করতে করতে চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রু মেখে নিতে ইচ্ছে হয় আলোর মতো নরম সাবানের ফেনায়। তারপর সে মানুষ বীতশোক হয়। মুগ্ধতার আভরণ ছেড়ে সেও নেয় গৈরিক তপবেশ, কমণ্ডল হাতে এগিয়ে যায় অন্তঃস্থ নির্জন অরণ্যবাসে।
আমার সেদিনের সে জীবন, আবেশ ও অসহায়তার বহমানতায় আলুথালু দুলছিল তরঙ্গ যাপনের দোলাচলে। অজ্ঞতাই যদি সবচেয়ে বড় অসহায়তা হয়, তবে তাও ছিল। একটা একক নৌকোর মতো চলেছিলাম হেলেদুলে নদীপথ বেয়ে, যে নৌকোর কাণ্ডারি আমি, পথ হারালে বলে দেয়ার কেউ ছিল না। কোথায় পৌঁছতে হবে, কোন সে ঘাট, তাও জানা ছিল না। চলেছিলাম স্রোতের অপার রহস্যের টানে। যেন এই নদী এই আকাশ জলে ভেসে যাওয়া ধুয়ে যাওয়া জীবনের দাগ আর এই অনন্ত জীবনের সমারোহ দেখাবে বলেই কেউ আমাকে ডেকেছিল, বাকি সবটাই ইনসিডেন্টাল।
ওই নৌকোর মধ্যেই যেন ছিল এ জীবনের যাবতীয় দাঁড় টানা, কখনো স্রোতের অনুকূলে কখনো স্রোতের বিপরীতে কখন দিনের আলোয় কখনোবা রাতের অন্ধকারে, কখনো ঝড় উঠলে মনে হতো এই বুঝি নৌকো আমার টলে গেল। কিন্তু ওই একাকিত্বের মধ্যেও কেউ যেন আমার সাথে ছিল, যে অদৃশ্য। যে আমাকে দিয়ে কবিতা লেখাতো, যে আমাকে বিস্মিত হতে শিখিয়েছিল, আর ঘুমিয়ে পড়লে যে আমার নৌকোখানা বাইতো।
বাড়ির পরিস্থিতি ছিল একইরকম বিতৃষ্ণাময়। বাবা থেকেও না থাকার মতো। মা সারাদিন ব্যস্ত, যেন একটা চাপিয়ে দেয়া জীবন তার, যে জীবনের ভারে মনে মনে হয়তোবা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। মাঝে মাঝেই আমার দিদিমাকে ভর্ৎসনা জানাতেন তিনি যেন এই অসহনীয় জীবনের যাবতীয় দায় তারই। কেবলমাত্র মা যার কাছে নিজের সবচেয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়া সবচেয়ে কদর্য রূপটুকুকেও প্রকাশ করা যায়, পৃথিবীর সেরা শক অ্যাবসর্ভার তিনি, সবটুকু গিলে নিতে পারেন। দিদিমাও তাই সবটাই গিলে নিতেন। মাঝে মাঝেই বাড়িতে চলতো তীব্র অশান্তি চিৎকার চেঁচামেচি এমনকি ভাঙচুর। আর এসবের মাঝখানে অসহায় আমি কেবলই ভাবতাম, `বাবা` বলে মানুষটা এ জীবন থেকে দূরে থাকলে হয়তোবা আমি একটু শান্তিতে থাকতে পারতাম।
শুনেছি মেয়েরা নাকি বাবাকে একটু বেশিই ভালোবাসে। বাবাদের অনেক দোষ তারা দেখেও দেখে না, শুনেও শোনে না। কিন্তু আমি আমার বাবার প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারিনি, কারণ একটাই, তিনি আমার জীবনে একটা সম্পর্কের নাম বহন করছিলেন মাত্র, যা দিয়ে কিছু কলাম ভরানো যেত। কিন্তু ওই সম্পর্কের জায়গায় আসলে বসেছিল ব্ল্যাকহোলের মতো এক অতীন্দ্রিয় মহাশূন্যতা। যখন আস্তে আস্তে বড় হতে থাকলাম, ওই মহাশূন্যতাই আমার মনে এক অদ্ভুত `ফাদার্স কমপ্লেক্সের` জন্ম দিলো। প্রকৃতিতে কোনো জায়গাই তো আসলে শূন্য থাকতে পারে না। মানুষও তার জীবনের অপূর্ণ অধ্যায়গুলো নিজের মতো করে ভরিয়ে তুলতে চায়। আমার মনের ভেতর কোথাও সেই রসায়নই হয়তো চলছিল আমার অজান্তেই। তাই আমি আকৃষ্ট হতাম সেইসব পুরুষদের প্রতি যারা ঠিক আমার সমবয়সী নয়, সমবয়সীর আশপাশেও নয়, যারা প্রায় আমার বাবার বয়সী।
আমি বেশ কিছু গৃহশিক্ষকের কাছে পড়েছি। আমার স্কুলের বন্ধুদের পর এদের মধ্যে কেউ কেউ ছিলেন আমার কাছে উন্মুক্ত বন্ধু অবকাশ। এদের মধ্যে প্রায় সকলেই ছিলেন পুরুষ এবং আমার কাছে সিলেবাস পাঠের পাশাপাশি পুরুষচরিত্রের পাঠও। তেল মাখানো বাঁশে বাদরের ওঠানামার গণিত শিখতে শিখতে জীবনের গণিতও শেখা হতো বৈকি। কোনো অঙ্কের উত্তর না মেলা অবধি শান্তিতে ঘুমোতে পারতাম না। হাতে ধরে যিনি শিখিয়েছিলেন ক্লাস ফাইভে তার ছিল এক আজব আবদার, তার পা নাকি টিপে দিতে হবে। প্রাচীনকালে গুরুগৃহে নাকি এমনটাই হতো। তো সেই আবদার তো কেবল পা অবধি সীমাবদ্ধ ছিল, ক্লাস সিক্সে বাঙলার মাস্টার, ওমা তোমার গায়ে ওটা কি, পোকা নাকি... বলতে বলতে সোজা আমার জামার ভেতর হাত ঢুকিয়ে দিলো। ছিল আরো এক মক্কেল মাস্টার। একদিন কামাই করলে পরের দিন এসেই আমার হাতটা টেনে নিয়ে, ‘এই তুমি কি আমাকে খুব মিস করছিলে?’ বলতে বলতে প্রায় কেঁদে ফেলতো। সরকারের কাছে যথাসময়ে রিপোর্ট হলে এদের সকলকেই চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল।
তবে সকলেই এমন ছিলেন না ভাগ্যিস। এইসব গৃহশিক্ষকদের বেশিরভাগই ছিলেন ভদ্র, জ্ঞানী, আমার প্রতি যথেষ্ট স্নেহশীল এবং উন্মুক্ত মনের মানুষ। ক্লাস সিক্সে পাড়ার বসন্তোৎসবে যখন গান গাইছিলাম, ‘ও চাঁদ তোমায় দোলা দেবে কে...‘ সেই গানের সাথে মঞ্চে রাজার ভূমিকায় অভিনয় করছিলেন যিনি, সেই অমৃত স্যার এলেন আমাকে ইংলিশ পড়াতে। সেই ক্লাস ইংলিশ গ্রামারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলো না আর। জানলা দরজা উধাও। ঘর হয়ে গেল অনন্ত বেদীমূল। আর অমৃত স্যারের ইংলিশ ক্লাস হয়ে গেল জীবন শিক্ষার ক্লাস। স্যার এলেই বইখাতা না খুলে আমি খুলে বসতাম কবিতার খাতা। স্যারও খুব আগ্রহ নিয়ে শুনতেন আমার কবিতার ভাঙাগড়া। আমার ডায়েরির পর ডায়েরি ভরানো সেদিনের কবিতাযাপন যার হদিশ ছিল না প্রায় কারো কাছেই, তার প্রথম উৎসাহী আর সমঝদার পাঠক ছিলেন এই অমৃত স্যার। বলতেন আরো নানা কথা, তার ঈশ্বরবোধ ও জীবনদর্শনের কথা। সবথেকে কাছের বন্ধু বলতে যদি কেউ ছিল যার কাছে নির্দ্বিধায় সবটা বলা যেত, যেমন বন্ধু আর কেউই হয়ে উঠতে পারেনি সেদিন এমনকি মাও নয়, সে জায়গা নিয়েছিলেন অমৃত স্যার। তার কাছে আমার দুর্গম ছায়াচ্ছন্ন অরণ্যময় পর্বতসঙ্কুল মনের হদিশ কিছুটা হলেও হয়তো ছিল।
মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, এ জীবন এ জেগে ওঠা আসলে একটা প্রাচীর। যা হয়তো অখণ্ড যা অনন্ত এ জীবন প্রাচীরের মতো আমাদের সেই চিরসত্যের থেকে আড়াল করে রাখে হয়তোবা কোনো ম্যাজিক দেখাবে বলে। সে প্রাচীরের গায়ে কত মানুষের স্পর্শ কিছু থেকে যায় কিছু বা ধুয়ে যায় কিছু কিছু স্পর্শ গভীর অমানিশাতেও ফুল হয়ে ফুটে থাকে। এমনই মানুষ ছিলেন অমৃত স্যার।
দু’হাজার এক সাল। মাধ্যমিক পরীক্ষার অঙ্ক পরীক্ষার দিন সকালে হঠাৎ আমার বাবা বাড়িতে ভুল ঠিকানা রেখে অদৃশ্য হয়ে যান। দিশেহারা অবস্থার মধ্যেও দিশা ঠিক রাখার বাধ্যতা, এই তো জীবনের পরীক্ষা। রেজাল্ট বেরনোর কিছুদিন আগে বাবা হঠাৎ ফিরে আসেন। মনে আছে সেই দৃশ্য। দরজা খুলে কাউকে কিছু না বলে তিনি গটগট করে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে গেলেন।
যেদিন রেজাল্ট বেরলো, আমি জানার আগেই বৃষ্টির টেলিফোন, কিরে কি করেছিস? ফাটিয়ে দিয়েছিস তো... বলতে বলতে সে উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠে।
হুগলি জেলায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম, রাজ্যে প্রথম কুড়ি জনের মধ্যে যতদূর মনে আছে চোদ্দতম স্থানাধিকারী সেই মেয়েটি সেদিন জানতো না, ঠিক দরজার বাইরেই তার জন্য আরো কত ইন্দ্রজাল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মহামান্য জীবন! এই খবরে হয়তো খুশি ছিল না অনেকেই। খুশি হওয়ার মতো কীবা ছিল! তবু আমার সাথে সারা জীবনে মাত্র গোটা দশেক কথা বলেছেন যে বাবা যিনি আমার জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষার সময় কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে হাওয়া হয়ে গেছিলেন। মনে আছে তিনি সেদিনও কোনো কথা না বলে চুপচাপ আমার হাতে একটা ঝকঝকে নতুন টাইটানের ঘড়ি ধরিয়ে দিয়েছিলেন। সে আমার সারাজীবনের পুরস্কার ছিল, বন্ধ হয়ে যাওয়া ঘড়িখানা এখনো আছে আমার কাছে। খুশি হওয়ার খবর দিয়েছিল আমার এক জামাইবাবু, ছেলেবেলা যার কোলে উঠে নির্লজ্জের মতো টেনেটুনে পাঞ্জাবি ছিঁড়ে দিয়েছিলাম, আমার সেই জেঠু যাকে ভালো লাগতো বলে ভালোজেঠু বলে ডাকতাম। বাকিরা যারা নীরব ছিল। তাদের ভালোবাসার যোগ্য হয়ে উঠতে না পারা এই অপারগ আমি বুঝতে পেরেছিলাম, কত অর্থবহ কিছু কিছু নীরবতা, যেন ঠিক একটু পরেই বৃষ্টি নামার তোড়জোড়।
সেদিন আমার জীবনের সামান্য আলোক কণার অংশে অংশী হয়েছিলেন তাও বা যে কেউ কেউ। প্রদীপ শিখার তলানিতে অন্ধকারটুকুর খবর কেই বা রাখতো? কেবল দেখেছিলাম এক বাবুইকে, যে আলো অন্ধকারে সাফল্যে অসাফল্যে রোদ বৃষ্টিতে ঝড়ে সেই একই ভাবে দাঁড়িয়েছিল, অবিচল।
উৎসবে ব্যসনে চৈব দুর্ভিক্ষে রাষ্ট্রবিপ্লবে
রাজদ্বারে শ্মশানে চ যস্তিষ্টতি স বান্ধব
বন্ধু তো তাকেই বলে, ঠিক। লেখক: কবি, পশ্চিমবঙ্গ
চলবে