ভূত বিলাসের ঘর

পর্ব ১৩

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : জুলাই ০৫, ২০১৮

সেপ্টেম্বর ২০০১। ক্লাস ক্লাস ইলেভেন, আগামীর স্বপ্নে বুঁদ হয়ে থাকার দিন। যা অনাগত যা কাঙ্ক্ষিত যা কিছু বর্ণময় তাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখার দিন।

আমার পারমুটেশন কম্বিনেশন জাড্য ধর্মের ইকুয়েশন ফোটন কণার আলোলিকা ক্যালশিয়াম কার্বনেটের সংস্রব সালোক সংশ্লেষের রসায়ন আর বাতাসে অদৃশ্য হয়ে থাকা অজস্র উপপাদ্য আঁকা পরদা সরিয়ে আমার উল্টোদিকের চেয়ারে যিনি এসে বসলেন, রিমলেস ফ্রেমের ভিতর তার গভীর দুটো চোখ সন্ধ্যার বাতাস লাগা জলাশয়ের মতো স্থির হয়ে ছিল। বয়স পঁয়তাল্লিশ। সাধারণ চেহারা, কিন্তু অসম্ভব ইমপ্রেসিভ। ফরেন এক্সচেঞ্জে উচ্চপদে আসীন ছিলেন, ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ ও লিটরেচারে তার পাণ্ডিত্য ছিল। তাই আমার ইংলিশের মাস্টার হয়ে এসেছিলেন তিনি। নাম অনন্য চ্যাটার্জি।

আমি তখন ষোলো। বয়সটা ছিল ভীষণ রকম প্রভাবিত হওয়ার। শরীর মনের প্রতিটা কোষ শিরশির করতো হাওয়া দিলে। সেই শিরশিরে বাতাসের বিকেলে যে অনন্তের ট্রেন জার্নি, সেখানে আমার পাশের কিংবা উল্টোদিকের সিটখানা কোন অপরিচিতের জন্য নির্দিষ্ট হয়েছিল আমার তা জানা ছিল না। ডেসটিনি লিখছিল তার নিজস্ব জীবন সমগ্র আর আমি ট্রেনের হুইসেলে কান পেতে জানলা দিয়ে আকাশ আর সবুজ গাছগাছালি দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছিলাম নেক্সট স্টেশনের দিকে।

শুনেছি কোথাও কোনো বিপর্যয়ের আভাস থাকলে, প্রকৃতি সে সম্পর্কে সম্যক উপলব্ধ হয়। হাওয়া থেমে যায়। মাটি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। পাতারাও স্থির হয়ে থাকে। খাদ্যাণ্বেষণে বেরনো পিঁপড়ের দল পাখির ঝাঁক দ্রুত গৃহমুখী হয়। মাছেরাও সচেতন হয়ে পড়ে তাদের জলসাম্রাজ্যে। প্লাবন আসার আগে এমন হয়।

তেমনই কোনো আভাসে আমিও অস্থির ছিলাম সেদিন। আমার সামনাসামনি কোনো মানুষকে এত প্রগাঢ় মনে হয়নি কোনোদিন, মনে হয়েছিল, এ রঙ এমন যা আমার একক অন্তর্দর্শনের সাদা কালো ক্যানভাসে একটু একটু করে অনেক যত্নে আঁকা ছবিটাকে নিমেষে নস্যাৎ করে দিতে পারে। কেমন এক অতি সুগন্ধে ঝিম ধরছিল। অনাগত কোনো এক ব্যাধের পূর্বাভাসে শিকারসম্ভবা ভীত হরিণীর মতো চেয়েছিলাম তার দিকে।

‘কী হলো? বই খোলো! লেটস্ স্টার্ট উইথ `মাই উইক উইথ গান্ধী`... তার ঠোঁটের কোণায় ঝুলেছিল গভীর এক অর্থবহ হাসি। বইটা টেনে নিয়ে নিজেই পড়তে শুরু করলেন। বইয়ে যা লেখা আছে তাই তো পড়ছেন। অথচ প্রতিটা শব্দই যেন বদলে যাচ্ছে বারুদ হয়ে উঠছে তার উচ্চারণে। সাথে সাথে খাতায় লিখে দিচ্ছেন শব্দার্থ দারুণ শৈল্পিক হস্তাক্ষরে, উঠে আসছে এক একটি প্যারাগ্রাফের অভূতপূর্ব ব্যাখ্যা।
‘আরে এদিকে তাকাও না! মুখ নিচু করে থাকলে পড়ানো যায়?’ তারপর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে একটু থেমে বললেন, ‘মুখের মধ্যে সবচেয়ে আগে চোখে পড়ে চোখ দুটো।’

ষোলো বছরের আমি এমন প্রশংসায় কিভাবে সাড়া দিতে হয় না বুঝে আবার মুখ নিচু করে ফেলেছিলাম। বাবার বয়সী একজন মানুষ, অসামান্য তার মেধা, অসাধারণ প্রজ্ঞা, যেমন উচ্চারণের স্বকীয়তা তেমনই বক্তব্যের অনন্যতা। কিন্তু এই মানুষটি যেভাবে আমার দিকে তাকাচ্ছিলেন, যে গভীরতা নিয়ে কথা বলছিলেন, তার দৃষ্টিতে শব্দে অরণ্যময় বৃষ্টি পতনের যে অনুরণন ছিল তার পরিভাষা ছিল আমার অজানা। ভয় মেশানো ভালো লাগায় আমার প্রতিটা রোম সতর্ক হয়ে উঠছিল। লুব্ধ প্রজাপতির মতো স্থির হয়েছিলাম বৃক্ষশাখায়, আর উল্টোদিকের মানুষটা মন্ত্রোচ্চারণের মতো কী যেন বলে চলেছিল। যেন কোনো মহাযজ্ঞের প্রস্তুতি চলছে, আর আগুনের সামনে বসে আছেন অনন্য আহুতি দানের ভঙ্গিমায়।

একজন মেধাবী পুরুষ যেমন প্রজ্ঞা তেমনি অসাধারণ লেখনি সর্বোপরি তার পিতৃতুল্য বয়স যা ছিল আমার অনিবার্য দুর্বলতা, মেড মি হিজ এটারনাল সাবজেক্ট। আমি ইমপ্রেসড ছিলাম, শ্রদ্ধায় বন্ধুত্বে থাকতে চেয়েছিলাম, কিন্তু অনন্য আমাকে সম্মোহিত করছিলেন। অ্যান্ড হি ওয়াজ সিকিং মি ট্যু ফল ফর হিম অ্যাজ আ ওম্যান ডাজ ফর আ ম্যান!

‘তোমাকে খুব ছুঁতে ইচ্ছে করে। প্লিজ পারডন মি, আই নো ইটজ আনএথিক্যাল। আসলে আমার পুরনো একজনের সাথে তোমার খুব মিল!’ আমি কিভাবে এর রিয়্যাকশন দেব ভেবে না পেয়ে পাতা উল্টাতে থাকি। সিলেবাসের দ্বিতীয় পাঠও প্রায় সম্পূর্ণ হওয়ার মুখে, অনন্য আমার খাতায় লিখলেন,
টোয়াইজ অর থ্রাইজ হ্যাড আই লাভড দি
বিফোর আই নিউ দাই ফেস অর নেম
সো ইন আ ভয়েস সো ইন আ সেপলেস ফ্লেইম
অ্যানজেলস অ্যাফেক্ট আস অফ্ট অ্যান্ড ওয়ারসিপড বি

লিখে মুখের দিকে চেয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, ‘তোমার সিলেবাস আমি খুব তাড়াতাড়ি শেষ করে দেব। তারপর আমার ছুটি। ভুলে যেও।’

তখনও অবধি কোনো প্রতিক্রিয়া জানাইনি আমি। আমার জীবনের অসমাপ্ত পাঠ নিয়ে ভীত মুগ্ধ এবং বিস্মিত হয়ে চেয়েছিলাম আমার সামনে চলমান সেই অদ্ভুত ইন্দ্রজালের দিকে। আলো আর ছায়া নিয়ে যেন খেলা দেখাচ্ছে এক ম্যাজিশিয়ন। চোখ ধাঁধানো আলোর সামনে পাঁচখানা আঙুল কখনো হয়ে উঠছে ব্যাধ কখনো বা দলছুট হরিণ। ডুবে যাচ্ছিলাম অবসন্ন হয়ে পড়ছিলাম যেন এক অদ্ভুত ঘোরলাগা ইথারাইজড টেবিলে। আমি যেন কোন সে যুগের এক নামহীন যাত্রিকের সঙ্গিনী, কোনো এক অনন্য স্বেচ্ছামৃত্যুর অঙ্গীকারে যেন আমাকে ধীরে ধীরে অবশ করছিলো, ইউথ্যানাশিয়ার টেবিলে শুয়ে আমি ঘুমের ভেতর হারিয়ে যাচ্ছিলাম এক সন্ধ্যার অরণ্যে—
আই ক্যান নট সি হোয়াট ফ্লাওয়ারস আর অ্যাট মাই ফিট
নর হোয়াট সফট ইনসেন্স হ্যাংস আপঅন দ্য বাওস
বাট ইন এমবামড ডার্কনেস গেস ইচ সুইট
হোয়্যারউইথ দ্য সিসনেবল মান্থ এনডাওস

নিজেকে দূরে সরানোর চেষ্টায় মাকে বললাম, আমি ওনার কাছে পড়বো না।
কেন? উনি তো দারুণ পড়ান শুনেছি। পড়ো। ভালো হবে।

বাধ্য হয়ে অনন্যকে দূরে সরানোর চেষ্টা করলাম। ইনডিফারেন্ট থাকতাম। শুধু পড়াটুকু, শুধু লেখাটুকু, অন্য কথার কোনো উত্তর নেই। ইচ্ছে হলেও তাকাতাম না অনন্যর চোখের দিকে। উনি সেটা বুঝতে পেরেছিলেন। সেদিন যাওয়ার আগে আমার খাতায় লিখলেন কয়েকটা অসামান্য লাইন—
শোক আসে মাঝে মাঝে
ধুয়ে দিতে মোহ।
পৃথিবী ভাগের নেশা পাঁচ পুরুষের সঞ্চয় বাসনা
বৃদ্ধ পিতার ভার, আশ্লিষ্ট প্রেমের লাঞ্ছনা
শোক আসে মাঝে মাঝে।

বন্যা আসে মাঝে মাঝে
ভেঙে দিতে গৃহ।
সচকিতে বলে দিতে, অনিত্য সংসার
নতুন গাছের চারা নবকিশলয়
দেবতার ধন সব মানুষের নয়।
বলে দিতে আকাঙ্ক্ষার পরিণতি এই
সব বিত্ত বলি দিয়ে এখানেই বসে থাকা
তাও বুঝি নয়
শোক আসে বন্যা আসে আপদ প্রলয়

ভেঙে দিতে গৃহ
ধুয়ে দিতে মোহ।

তারপর আমার নুয়ে পড়া চোখের ওপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে, হাতটা ধরে বললেন, আসি। আমি বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করবী গাছের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম আকণ্ঠ বিষাদের জলে।

চলবে