Little Girl In The Rain Painting by Mocanu Marius

Little Girl In The Rain Painting by Mocanu Marius

ভূত বিলাসের ঘর

আত্মজীবনী পর্ব ১৪

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : জুলাই ১৪, ২০১৮

মাই হার্ট এইকস অ্যান্ড আ ড্রাওসি নাম্বনেস পেইনস
মাই সেন্স, অ্যাস দো অফ হেমলক আই হ্যাড ড্রাঙ্ক

সপ্তাহ খানেক খুব বৃষ্টি হলো। অনন্য এলেন না। তবু কেমন এক ঘোর লেগে থাকে। দূরে কোথাও কোনো পর্বতের গুহায় হোমাগ্নির শিখা কুণ্ডলি পাকিয়ে ওঠে। মন্ত্রোচ্চারণের ফাঁকে ফাঁকে রক্তবর্ণ কোনো নেত্র যেন স্থির হয়ে থাকে অদূরে বসে থাকা সরল প্রজাপতির ডানায়। সেই অভিসম্পাতে কেঁপে ওঠে সরোবরের জল, আর দুঃস্বপ্নের রাতে আমি জেগে থাকি বিছানায় বিলম্বিত ঘুমে।

স্কুলে যাই। স্কুল থেকে ফিরি। আমার যাতায়াতের পথ বৃষ্টি বাদল মানে না কিছুই। আমার ছাতা উড়িয়ে নিয়ে যায় এলোমেলো বাতাস। বাড়িতে ফিরে জলের রসায়ন আত্মস্থ করি, উপপাদ্যে ভুল হয় যথারীতি, আর মনে মনে গিয়ে বসি জলাশয়ের ধারে। কিন্তু অনন্য আসেন না। চন্দ্রাহত রাতে স্বপ্নের করিডোর পার করে একা একা গিয়ে বসি কোনো শীতলতম অরণ্যের অতিকায় ওক গাছের নিচে। মনে মনে নিজেকে ধারণ করি কোনো গভীরতম প্রার্থনায়। কোনো অনাগত দিনের আশঙ্কায় হৃদস্পন্দন বেঁধে রাখি ভবিতব্যের ওমে। তবু অনন্য আসেন না কেন? সেই না আসা যে আসলে আশীর্বাদ, তাও না বুঝে ডুবে থাকি নেশাতুর অপেক্ষায়।

ফোনটা আমিই করি।
হ্যালো, অনন্য স্পিকিং।
আপনি এলেন না... তাই...
স্তব্ধতা
কবে আসবেন?
যাব। বৃষ্টি থামলেই যাব।

অনন্য আসেন তারপর। আমার চার দেয়ালে বইপত্র ঠাসা চেয়ার-টেবিলওলা ঘর বদলে যেতে থাকে আকাশ, গাছ, পাহাড়, নদী ও নক্ষত্রযাপনে। অনন্য আমাকে পড়ান, আমাকেও পড়েন, আমিও পড়ি তাকে। তিনি প্রতিদিন ফিরে যান আমার লেখা এক একটি গোটা কবিতা নিয়ে।
জীবনের আগে মৃত্যুময় সাগর বিশাল
তার নিচে ডুব দিয়ে
তুলে আনি গভীর বিষাদ,
মৌনতা—
আরও একবার তলপেটে দাও ডুব
তুলে আনো পরগাছা
মৃত্যুর মুখে,
বুকের ভেতর ও`মুখ
মুখের ভেতর
লাভা।

মুগ্ধ বিস্মিত অনন্য লেখেন,
হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজও চমৎকার?
আমিও তোমার মতো বুড়ো হবো
বুড়ি চাঁদটারে আমি করে দেব কালীদহে বেনোজলে পার
আমরা দুজন মিলে শূন্য করে চলে যাব
জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার।

কী করে লেখ এত ভালো? কি করে উৎসারিত হয়, বাহিত হয় এত মসৃণ উচ্ছ্বাস? এই অচেতন প্রবাহ? এতটান শব্দের ওপর? এই ত্রিকালদর্শী প্রতিভা কী করে পেলে? আমি অভিভূত সত্যিই। ভাগ্যবান কবিতা পড়ানোর জন্য। তোমার কবিতা হোক অমোঘ, আলোকদর্শী, দুর্বার, মর্মস্পর্শী, উত্তাল, কালজয়ী, সব কবিতাই হোক শাশ্বত।

অনন্যর আসা-যাওয়ার ভেতর এক আলো-ছায়ার খেলা ছিল, যা অসম্ভব রকম জটিল। আমি আমার মোহের সাথে সম্মত ছিলাম না। বুঝতে পারতাম না আমার মুগ্ধতার সঠিক কারণ কি। উনি আমার পিতৃতুল্য বলেই কি? নাকি আরো গভীর কোনো অন্তর্দর্শন? নরমতম কোনো স্পৃহা? আমার মনের ভেতর পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে থাকা শূন্য কোনো ঘর তার দেয়ালে পুরু হয়ে জমে থাকা ধূলার আস্তরণে তার পাঁচ আঙুলের স্পর্শ রেখেছিলেন অনন্য। লিখে দিয়েছিলেন কিছু শব্দ তার নিজস্ব অক্ষর বিন্যাসে। সে লেখা মুছে যাবে জেনেও আমি তা ফুটিয়ে তুলেছিলাম আমার কবিতার হরফে। তার চেয়ে বেশি কিছু আমি তখন জানতাম না। মে বি হি ওয়াজ অ্যান এনচ্যান্টার ড্রিভেন বাই সাম পাওয়ারফুল স্পিরিট অর আই ওয়াজ ইন বিটুইন দ্য প্রসেস অফ হিপনোসিস!

ও ফর আ বিকার ফুল অফ দ্য ওয়ার্ম সাউথ,
ফুল অফ দ্য ট্রু ব্লাসফুল হিপোক্রিন
উইথ বিডেড বাবলস উইনকিং অ্যট দ্য ব্রিম
অ্যান্ড পার্পল স্টেইনড মাউথ
দ্যট আই মাইট ড্রিঙ্ক অ্যান্ড লিভ দ্য ওয়ার্ল্ড আনসিন
অ্যান্ড উইথ দি ফেড অ্যাওয়ে ইনট্যু দ্য ফরেস্ট ডিম

ফেড ফার অ্যাওয়ে ডিসলভ অ্যান্ড কোয়াইট ফরগেট
হোয়াট দাউ অ্যামং দ্য লিভস হ্যাস্ট নেভার নোন
দ্য ওয়ারিনেস দ্য ফিভার অ্যান্ড দ্য ফ্রেট।

দ্য জার্নি অফ লাভ ইজ অলওয়েস সুররিয়্যাল। যদি সে তোমাকে তোমার রিয়ালিটি থেকে খড়কুটোর মতো করে উড়িয়ে না নিয়ে যায়, তবে সে অন্য যা কিছু হতে পারে, তবে প্রেম নয়। স্রোতের সাথে আমারও লড়াই চলছিল তেমন করে। স্রোত যেমন আমাকে টেনে নিচ্ছিলো কূল-কিনারাহীন জলরাশির অন্তঃপুরে জানি না কী শোভা দেখাবে বলে, আমিও তেমনি খড়কুটো ধরে লগ্ন হতে চাইছিলাম কোনো ভাসমান বন্দরে। আর অনন্য? তিনি কি চেয়েছিলেন? আর কেনই বা? তার ষোড়শী পিতামহীকে অঙ্গুলিনির্দেশ করে নয় রীতিমতো প্রলোভিত করে যে পথে তিনি টেনে আনতে চাইছিলেন গোলাপফুলে মোড়া আপাত সুন্দর রোমাঞ্চকর সেই পথ যে অনন্ত আগুনের বন্য উদযাপনে শেষ অবধি সব মোহ তছনছ করে দিতে পারে, তা কি জানা ছিল না সেই পঁয়তাল্লিশোর্ধ্ব বালকের?

মাঝে মাঝে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে আমাকে অবলোকন করতেন। সেই দৃষ্টিতে হাসি ছিল বরফের ছুরির মতো ধারালো। ‘তুমি কি নিজেকে কখনো দেখেছো? আমি মাঝে মাঝে ভাবি কি আছে তোমার মধ্যে!’ সেইসব আবিষ্কার আর অনুমানের যাবতীয় উত্তেজনার আড়ালে আমি আসলে ছিলাম ডেসটিনির হাতের এক ছিন্নমূল পাশা, যে আমাকেই চাল দিয়ে আমারই সাজানো বোর্ড নস্যাৎ করবে বলে বসেছিল। সময় ছিল ওৎ পেতে বসে থাকা ধূর্ত শিকারির মতো, আর জীবন এক ভয়ানক জুয়া যে আমার কানে কানে মন্ত্রের মতো আওড়াচ্ছিলো কিছু লাইন—

বাট অ্যাট মাই ব্যাক আই অলওয়েজ হিয়ার
টাইমস উইঙ্গড্ চ্যারিয়ট হারিং নিয়ার
অ্যান্ড ইয়নডার অল বিফোর আস লাই
ডেসার্টস অফ ভাস্ট এটারনিটি।

কী যেন প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেরাতাম সারাক্ষণ। আসলে খুঁজে বেরানোটাই ছিলো উদ্দেশ্যে।
কি চান আপনি?
তোমাকেই।
কেন? কেন? কেন?
নো ওয়ান হ্যাজ এভার উইল স্যাল মে মাইট ক্যান অর কুড লাভ ইউ অ্যাজ আই ডু। আমার দায়িত্ব হলো আমার ভালোবাসা আমার ডিসায়ার আমার অনুভূতিকে সাপ্রেস করা। সোশ্যাল মরালিটি, এথিকস, ওশান অফ ডিফারেন্স, সেন্স অফ রেসপন্সিবিলিটি ভ্যালুজ অল টেল মি... তোমার জীবন থেকে এক্ষুনি সরে যেতে... এই মুহূর্তে... বাট আই কান্ট... আই জাস্ট... ক্যান নট... এই কন্ট্রাডিকশন আমাকে রোজ রোজ মেরে ফেলছে...আই ফিল লাইক এন্ডিং মাই লাইফ... দেয়ার ইজ নো লাইট অ্যাট দ্য এন্ড অফ দ্য টানেল ...

লাইট! আলো! যা শেষ অবধি আমরা সবাই চাই। কিন্তু যা পাওয়া সহজ নয় আদৌ। কারণ সে আলো কোন পথের শেষেই নেই আদপে, আছে হয়তো কোনো এক অন্তরঙ্গ সুরঙ্গের শেষতম ঢালে যেখান থেকে জলরাশি নেমে গেছে সমুদ্রের কোলে, সেই দুর্গমতম জার্নির এন্ডে কখনো সে আলোর দেখা মেলে বৈকি যে পথ তুমি নিজের ভেতর ধারণ করো আর একা একা পার করো আজীবন....

তেমনই কোনো অপার্থিব আলোর অপেক্ষায় ছিলেন অনন্য? নাকি তিনি কোনো অন্ধকারে দ্রব হয়ে থাকা অদৃশ্য মানুষ যে আমাকেও টেনে নিতে চাইছিল তার নিজস্ব কামনার ব্রহ্মাণ্ডে, আলোর মতো কোনো কিছুর মোহে, যা আসলে আলো নয়...
‘এন্ডিং ইওর লাইফ!’
‘ইয়েস। বাট ইন সাম আদার প্লানেট... অন্য কোনো ব্রহ্মাণ্ডে, কোনো এক সময়, কোনো এক দিন, যখন কেউ অভিযোগের আঙুল তুলবে না, কোনো ভ্রূ অযথা কুঞ্চিত হবে না, ইউ উইল বি মাইন... ফরএভার অ্যান্ড এভার!’

চলবে