
ভূত বিলাসের ঘর
আত্মজীবনী ১৬
শ্রেয়া চক্রবর্তীপ্রকাশিত : জুলাই ২০, ২০১৮
তখন বারো ক্লাস। ক্লাসরুম সংলগ্ন বারান্দায় এসে মাঝে মাঝে দাঁড়াতাম একা একা। চোখের ওপর রোদ এসে পড়তো। খেয়ালি পাখির মতো আপন মনে হয়তো গাইতাম টিফিনবেলার নিজস্ব স্বরলিপি। হঠাৎ একদিন খেয়াল করলাম, ঠিক উল্টোদিকের বারান্দায় আমার সোজাসুজি দাঁড়িয়ে আছে ভীষণ সুন্দরী একটি মেয়ে। রোদ তার গালে লেগে ছায়া হয়ে নেমে গেছে ঘাড়ের উল্টো পিঠে, আর সে কেবল আমার দিকে চেয়ে আছে। চোখে চোখ পড়ামাত্র সে পাখির মতো ঝুপ করে উড়ে গেল দৃষ্টিসীমার বাইরে। যেন বাতাসের কম্পন তাকে জানান দিয়েছে আমি তাকে দেখে ফেলেছি।
সপ্তাহখানেক বাদে প্র্যাক্টিকাল ক্লাস সেরে ফিরছি, ফর্মালিনির গন্ধে মাথা তখনো ঝিমঝিম করছে। দেখি ক্লাসরুমের দরজার কাছে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটি। আমাকে দেখেই মাথা নিচু করে ফেলে। আমি কি বলবো ভেবে ওঠার আগে সে-ই আমার নাম ধরে ডাকে, শ্রেয়াদি...
হ্যাঁ, বল না। কিছু বলবি?
আমার নাম মোহর। ক্লাস ইলেভেন, আর্টস।
আচ্ছা।
আমি না ভীষণ বিপদের মধ্যে পড়ে গেছি। কী যে হচ্ছে আমার সাথে!
কি হয়েছে? কি বিপদ?
মানে তোমাকে কিছুতেই ভুলতে পারছি না! বাড়িতে গিয়ে পড়ার বই খুললেও দেখছি তোমার মুখ। এটা কি হচ্ছে?
আমি অপরাধীর মতো মাথা চুলকে বলি, তাহলে ভোলার দরকার নেই।
তাহলে?
তোর কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই? তোকে তো খুব সুন্দর দেখতে।
হ্যাঁ আছে তো। কিন্তু এবার ব্রেক আপ হয়ে যাবে মনে হচ্ছে।
কেন? আমি উৎকণ্ঠিত।
কেন আবার! তোমার জন্য।
এ কথা বলেই সে এক ছুটে হাওয়া, যেন কোনো অনুভব অতিক্রান্ত প্রৌঢ়া প্রেয়সীর হাতে চিঠিটি গুঁজে দিয়েই ধা করে পালিয়ে যাওয়া এক বালক। শুধু সরে যাওয়ার আগে আমি দেখি তার সাদা টকটকে কানের লতিগুলো কেমন রক্তজবার মতো ফুটে আছে। মোহরের এই অদ্ভুত ভালোলাগার রসায়নের মধ্যে না ঢুকে আমি তাকে একটি সরল বন্ধুত্বের সমীকরণে গ্রহণ করি। ফাঁক-ফোকর পেলেই সে আমার গাল টিপে বিনুনি টেনে হি হি করে হেসে দিয়ে চলে যেত। হয়তো অঙ্কের ক্লাস চলছে, ক্যালকুলাসের থিওরি নিয়ে রীতিমতো ব্যস্ত, হঠাৎ কিসের শব্দে জানলার দিকে তাকিয়ে দেখি, মোহর! স্কুল ছুটির পর ফিরছি সরল রাস্তা বরাবর, হঠাৎ সাইকেল থেকে কে যেন আঁচলটা টেনে দিয়ে হুশ করে বেরিয়ে গেল। সে মোহর। কি করে সে আমার বাড়ি অবধি খুঁজে বের করে ফেরেছিলো। উড়ো হাওয়ার মতো এসে কলিংবেল বাজাতো, আবার ফসকে যাওয়া ওড়নার মতো উড়ে নাগালের বাইরে চলে যেত।
মোহর যখনই আমাকে শ্রেয়াদি বলে ডাকতো, আমার মাথার ভেতর একসাথে বেজে উঠতো অনেকগুলো কণ্ঠ। যেন ফেলে আসা কোনো জীবনের ডাক। যে জীবন ছিল নদীর ওপারে। যে ডাক ক্রমশ অশ্রুত হতে হতে মিলিয়ে যায় জলে দাঁড় ফেলার শব্দে। প্রতিটি ডাকের একটি নিজস্ব সুগন্ধ থাকে। কেউ যেন কোনো না ফোটা জন্মের পাপড়ির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে ভোরের প্রথম কলিংবেল বাজিয়ে ডেকে ওঠে, শ্রেয়াদি...। বিছানা থেকে নেমে পড়ি সেই আহ্বানে। দরজা খুলে দেখি, কেউ কোত্থাও নেই!
সেইসব আধফোটা কণ্ঠস্বর, না ডেকে ওঠা নাম, গ্রিটিংস কার্ড, ডেয়ারিমিল্কের সিল্কি ভালোবাসা— সবই সময়ের ছাকনির মধ্যে দিয়ে টুপটাপ গলে বেরিয়ে যায়। এটাই নিয়ম। ভালোবাসা, ভোরে ফোটা ফুলের মতো, যার সুগন্ধ বিকেল অবধি ম্লান হয়ে যায়। কিন্তু সে যে ব্যথা দিয়ে যায় তা চিরকাল থাকে। আমার কবিতার ওপ্রান্ত থেকে যে আমার হাত ধরে থাকে খড়কুটো ধরে থাকার মতো করে, আমিও রয়ে যাই তার তর্জনি ছুঁয়ে।
একদিন সকালবেলা হঠাৎ দরজা খুলে দেখি, মোহর! কিরে কি হলো? এত সকালে? সে জবাব দিল, শ্রেয়াদি, আমার বাড়ির লোক আমাকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে। কাল ছেলের বাড়ি থেকে এসে আমাকে দেখে গেছে। মা সব ফাইনাল করে ফেলেছে।
আমি চুপ করে শুনি। তোর লেখাপড়া?
সে নাকি ওরা করতে দেবে বলেছে। কিন্তু আমি বিয়ে করতে চাই না। শ্রেয়াদি, তুমি কি কিছুই করতে পারো না? আমার বিয়েটা আটকে দিতে পারো না?
আমি বুঝতে পারি, আমি কতখানি অক্ষম। আমি এক অনিচ্ছুক অষ্টাদশীর বিয়ে বানচাল করে দিতে পারি না, আমি সেইসব বাবা মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে চোখ চোখ রেখে বলতে পারি না, এ কি করছেন! আমি এমন পারি না। রিনি আরো কতকিছুই। কারোর মৃত্যু অসময়ে চলে যাওয়া, কারোর হারিয়ে যাওয়া, ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া কতজনের কতরকমের অসহায়তার সামনে দাঁড়িয়ে আমি নির্বাক রয়ে গেছি। কিছুই পারিনি, নাঃ কিচ্ছু না। এমনকি নিজেকে যেদিন দেখেছি নিজের সামনে দিয়েই দরজা খুলে বেরিয়ে যেতে, সেদিন? সেদিনই বা কি করতে পেরেছি নিজের মাথার ভেতর সেই আলো অন্ধকারময় দেয়ালে নখ দিয়ে খুঁড়ে খুঁড়ে কিছু শব্দ লিখে রাখা ছাড়া?
মোহরের বিয়ে হয়ে যায়। মোহরের বিয়েতে আমি যাইনি। তার শেষ অনুরোধ ছিল, তাহলে তুমি আমার দেওরকে বিয়ে করো। তবে তোমাকে রোজ দেখতে পাবো। আমি এ কথা শুনে খুব হেসেছিলাম, তুই কি পাগল?
মোহর রেগেমেগে চলে গেছিলো শেষবারের মতো। মোহরকে তার বিয়ের বছর কয়েক পর একবার দেখেছিলাম রাস্তায়, মাথায় তার সিঁদুর জ্বলজ্বল করছিল। সে আমায় চিনেও না চেনার ভান করেছিল। তার সেই ভান দেখেই বুঝেছিলাম, সে আমায় মোটেও ভোলেনি।
আমার উচ্চ মাধ্যমিকের পরীক্ষার পর আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এলো মেহফুজ। মেহফুজের বাবা সাহিল রহমান আমাদের পারিবারিক বন্ধু ছিলেন। কোনোরকম ধর্মীয় সংস্কারের ঊর্ধ্বে থাকা আমার দিদিমা সাহিল রহমানকে নিজের ছেলের মতোই ভালোবাসতেন। সেই সূত্রে আমি তাকে মামা বলে ডাকতাম। সাহিল মামার বড় ছেলে মেহফুজ কলকাতার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর পড়ছিল। মেহফুজ বলে, মানি তোমার কবিতা শোনাও। আমি ডায়েরি থেকে বেছে বেছে মেহফুজকে বেশ কয়েকটি কবিতা পড়ে শোনাই। মেহফুজ যাওয়ার সময় বলে, মানি, যোগাযোগ রেখো।
টেলিফোনে তার সাথে কথা হয়। মেহফুজদা আমার ভালো বন্ধু হয়ে ওঠে। সেবার ঈদে সপরিবার আমরা সাহিল মামার বাড়ি বেড়াতে যাই। তারা খাতিরদারির কোনো অভাব রাখে না। মেহফুজ আমাকে তাদের শহরটা ঘুরিয়ে দেখায়। তারপর ভাগীরথীর ধারে বসে আমরা অনেকক্ষণ গল্প করি। হাসিখুশি মেহফুজ তার শৈশব কৈশোর বিশ্ববিদ্যালয়ের গল্প বলে, তার নস্টালজিয়ার কথা বলে, তার পড়া সেরা বাঙলা সাহিত্যের কথা বলে। আমিও বলি আমার জীবনের কথা, অনেক না বলা কথারা নদীর হাওয়া লেগে অবিন্যস্ত হয়ে যায়, তবু মেহফুজ শোনে সব। কথায় কথায় সন্ধ্যা নামে। সেদিনের নদীর স্থির হয়ে থাকা জলের থেকেও বেশি স্থির আমি মেহফুজকে মনে মনে বলি, তোমার মতো যারা প্রাণ খুলে হাসতে পারে তাদের আমার খুব ভালো লাগে। আমি অমন পারি না তো, তাই।
সন্ধ্যার অন্ধকার তার অনাবশ্যক অধিকারে সে কথা মেহফুজের কানে কানে বলে দেয়। সে কেন জানি না হঠাৎ বলে ওঠে, তুমি মনে করো আমি খুব ভালো আছি? কিন্তু যারা নিজের কথা প্রকাশ করতে পারে না ঠিকঠাক, জেনো তারা মুখে এঁটে থাকে বর্ণময় মুখোশ। আমি ভালোবাসি মাঝরাতের দুঃখবিলাস। আমি এই নারকীয় বিলাস থেকে মুক্তি চাই। তুমি সাহায্য করবে আমাকে?
আমি তাকে কিভাবে সাহায্য করবো ভেবে পাই না। এমন কত বিলাস ঘর বেঁধে থাকে সন্তর্পণে কারো কারো অন্তরে, তাকে দিয়ে প্রিয়তম কবিতাটি লিখিয়ে নেবে বলে। সেই কবিতার বন্দিনী আমি, যে আমাকে নিয়ে দরজায় শিকল তুলেছে, তার থেকে মুক্তি খুঁজে ফেরা আমি নিজে আরেকজনকে মুক্তির পথ কিভাবে দেখাই?
মেহফুজের ভাই রিজওয়ান খুব ভালো ছবি আঁকতো। তাকে বলেছিলাম আমার একখানা পোট্রেইট এঁকে দিতে। তার বদলে রিজওয়ান বলে একটি কবিতা লিখে দিতে। ফিরে আসার দিন রিজওয়ানকে একটি কবিতা লিখে দিয়ে আসি, কিন্তু পোট্রইট আঁকার সময় হয় না। মেহফুজ পরে একটি ছবি এঁকে দেয় জলরঙে। একটি ঘরে ঝাপসা হয়ে মিশে থাকা নর-নারী, আর তাদের মাথার ওপর একটি ঘড়ি, যাতে কোনো কাঁটা নেই। যে ঘড়ি আসলে অনন্ত সময়ের সূচক।
অনন্ত? অন্তহীন বলে কিছু আছে? যা আছে তার অন্ত আছে। আর যা নেই যার কোনো পরিমাপ নেই, যার কোন শুরু নেই, কেবল সে-ই অন্তহীন। আমাদের তো ছোট ছোট এক একটা শুরু আছে, আর তার শেষও আছে। শুধু মন পড়ে থাকে অনন্তে। শুধু দৃষ্টি গিয়ে ঠেকে অসীমে। তারপর আবার আমরা সীমায় ফিরে আসি, ঘর আর ঘরের বাইরে যে সীমাহীন ঘর এই দুইয়ের মাঝখানে যাতায়াত লেগে থাকে।
কলেজে ভর্তি হওয়ার আগে আমি আর স্নেহ পাহাড়ে বেড়াতে যাই। আমরা ঢাল বরাবর হাঁটি একসাথে, বরফের ওপর উঠে নাচি, পাথর ভেঙেচুড়ে বেরিয়ে আসে যে জল, তা স্পর্শ করে আনন্দে কেঁপে উঠি। ওই শিহরণটুকুই ঈশ্বর, তাকে ধরে থাকার চেষ্টা করি। এর আগে সমুদ্রে বেড়াতে গেছি। কিন্তু পাহাড় আমাকে ভীষণ টানে। তবে যতনা সমুদ্রে নেমেছি যতনা পাহাড়ে বেড়াতে গেছি তার থেকে গভীরতর সমুদ্র আরো অনেক দুর্গম পাহাড় আমি মনে মনে ধারণ করেছি, করতে থেকেছি। এসব নিসর্গ পৃথিবীর কোথায়, তা আমার জানা নেই। জানার প্রয়োজনও মনে করিনি। শুধু মনে মনে হেঁটে গেছি কতনা সমুদ্রের উপকূল বরাবর, তারপর জলে নেমেছি, ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভিজে গেছি কত, ভেজা পোশাক চুলের ভেতর নুন নিয়ে ফিরে এসেছি অনন্ত বালিয়াড়িতে। সমুদ্রের লবণ আমার জিভে গেঁথে গেছে। তারপর কখন আবার মনে মনে হেঁটে গেছি পাহাড়ি রাস্তা ধরে। সঘন অরণ্যের মধ্যে ফুটে থাকতে দেখেছি রডোডেনড্রন ফুল। তারপর কোনো ঝর্ণার ধারে বসে দূর থেকে দেখেছি কুয়াশার ভেতর থেকে পকেট ভর্তি নুড়ি পাথর নিয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে অবিকল আরেক আমি। দেখতে দেখতে আমি উঠে দাঁড়িয়েছি। হাত বাড়িয়েছি নিজেকে আলিঙ্গন করবো বলে, তারপর আর মনে নেই কিছু...
চলবে