ভূত বিলাসের ঘর

আত্মজীবনী ২৩

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০২, ২০১৮

প্রতিটি দিন প্রতিটি যাপন তখন অলৌকিক মনে হতে থাকে। যেন এক জৈবনিক অভ্যেসে ভেসে চলা এ জীবন। ডিঙাটি পলকা, আকাশ মেঘময়, নদীটি স্মৃতিমেদুর। তবু ইথারে প্রতিটি যাত্রাপথের দিকচিহ্ন নির্দিষ্ট থাকে। তাকে ডেসটিনি বলতে পারো অথবা কোহেরেন্স অফ ইনসিডেন্স যা একটি অনিয়ন্ত্রিত অথচ সুসমঞ্জস্য, আনপ্রেডিকটেবল, কিন্তু অনিবার্য কার্যকারণের সম্পূর্ণ মানচিত্র, একটি জীবনের দাঁড় টানা যার অদৃশ্য হাতের নিয়ন্ত্রণে সম্পাদিত হয়। এ জগতের প্রতি স্কোয়্যার ফুট শূন্যতা অনেক সম্ভাবনার ধারক। এক একটি কল্পনার ইমেজারি অমোঘ শূন্যতায় স্থির, বিদ্যুৎ পরিবৃত হয়ে থাকে। সেই বিদ্যুৎকে নিজ অধীনতায় নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে ব্ল্যাকহোল সব গিলে নেয়। সবটাই আসলে শক্তির খেলা। প্রতিটি শব্দ, এক একটি পঙ্‌ক্তি, গোটা একটি কবিতা হয়ে ওঠা, সেও এক পাওয়ার প্লে। প্রতিটি মানুষের ভেতরে যে ব্ল্যাকহোল আছে, যা তাকে ক্রমাগত ভেতরের দিকে টানে, কবিতার উৎসমুখ সেখানেই।

প্রতিভাস আয়োজিত তিন দিনব্যাপী কর্মশালা স্বপ্নের মতো কাটে। অনেক তরুণ কবির সাথে আলাপ হয়। এক কবিকে ডেকে বলি, ‘তোমার কবিতা খুব ভালো লাগলো।’ `তুমি` বলার কারণ কবিকে দেখে বয়সের আঁচ পাই না, এমনই সারল্য সেই কবির চোখে মুখে। ফেরার সময় সে আমাকে লিফ্ট দেবে বলে। প্রসঙ্গান্তরে সেদিন এড়িয়ে যাই যাকে, তারপর জীবন যাকে অপ্রতিরোধ্য তরঙ্গের মতো আছড়ে ফেলে নিরন্তর সামুদ্রিক যাপনের এলোমেলো জাহাজিয়া ডেকে, যে কবির নাম একটি মাইল স্টোনের মতো জুড়ে যায় বানভাসি জীবনের অপ্রস্তুত উড়ালপুলে, নাম তার সুদীপ্ত সাধুখাঁ।

কর্মশালার শেষদিন আলাপ হয় কবি জয় গোস্বামীর সাথে। যাঁর অক্ষরমালাকে চিনেছি এতদিন এবার তাঁর সাথে মুখোমুখি কথা হয়। পরে সে আলাপ আরো দীর্ঘায়িত হয়। কর্মশালা শেষ হয়। কিন্তু বহু কবির ফোন আসে সন্ধ্যা রাতে। ব্যাক গ্রাউন্ডে ঝিঁঝি পোকার গান শুনি। ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস করতে করতেও আননোন নম্বর থেকে ফোন আসে ক্রমাগত। ফোন ধরলে অচেনা কণ্ঠ বলেন, আমি কবি। আপনার জন্য কলেজ স্ট্রিট মোড়ে অপেক্ষা করছি। একবার আসবেন প্লিজ?
ইয়ার্কি পেয়েছেন? উষ্মা ও বিরক্তি প্রকাশ করতেই অপরিচিত কণ্ঠ কুকড়ে যায়, না-না। আমি আসলে জন্মরোম্যান্টিক। ক্ষমা করে দেবেন প্লিজ।

এমন সব জন্মরোম্যান্টিকদের ফোন আর সাথে ঝিঁঝি পোকাদের কনসার্ট ভালোই চলতে থাকে। সুদীপ্ত সাধুখাঁর সাথে দ্বিতীয় বার দেখা হয় গোর্কি সদনে এক কবিতা পাঠের অনুষ্ঠানে। সেদিন তাকে আরেকটু বেশি করে জানা হয়। কবিতার অনুষঙ্গে সেদিন আর একসাথে ফেরার অনুরোধ ফিরিয়ে দিতে পারি না। সারা রাস্তা কবিতা নিয়ে কথা হয়, গান নিয়ে। সুদীপ্তদা, প্রথম এমন সম্বোধনেই ডাকি, তার লেখা একটি বই আমাকে উপহার দেয়। ভেতরে লেখা থাকে তার ফোন নম্বর। একদিন সে ফোন করে একটি কবিতার অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করে। কিন্তু প্রবল বৃষ্টিপাতের দরুণ সে অনুষ্ঠানে যাওয়া হয়না। অপারগতা জানাবো বলে তার নম্বর ডায়াল করে শুনি রবীন্দ্রনাথের গান,
ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো তোমার মনের মন্দিরে,
আমার পরানে যে গান বাজিছে তাহার তালটি শিখো তোমার চরণ মঞ্জিরে।

কবি জয় গোস্বামীর সাথে নিয়মিত কথোপকথন হয়। তিনি তাঁর কবিতা যাপনের কথা বলেন, কিভাবে এক একটি কবিতার জন্ম হয় সেকথা বলেন, তাঁর অদ্ভুত মানসভ্রমণের কথা বলেন। অন্ধকারে একা একা মনের সরণী বেয়ে বেয়ে তিনি কত পথ পার করেন, সে পথে কত অপরূপ ফুল ফুটে থাকে, কবি একটি একটি ফুল তাঁর মানসে ধারণ করেন, তা থেকে এক একটি কবিতার জন্ম হয়, শুনে রোমাঞ্চিত হই। জয়দা জানান, তিনি রিষড়ায় একটি কবিতার অনুষ্ঠানে আসছেন, তাঁর একক কবিতা পাঠের আসর। সুদীপ্ত দাও ফোন করে আমাকে আসার অনুরোধ করে, কারণ অনুষ্ঠানটি হওয়ার কথা তার বাড়িতেই।

নির্দিষ্ট দিনে রিষড়া গঙ্গাপাড়ে কবি সুদীপ্ত সাধুখাঁর বাগানওলা বাড়িতে উপস্থিত হই। দীর্ঘ দালানওলা বাড়িটি ঝাড়বাতির আলোয় মোহময় লাগে। ওই লম্বা দালানেই জয়দার একক কবিতা পাঠের ব্যবস্থা আর শ্রোতাদের বসার ব্যবস্থা। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় যেতেই দেখি জয়দা বসে আছেন। সুদীপ্ত দা অন্যান্যদের সাথে আলাপ করিয়ে দেয়। জয়দার কবিতা পাঠ শুনি, ঘোর লেগে থাকে। অনুষ্ঠান শেষ হলে ঝাড়ের আলোয় দাঁড়িয়ে থাকি অনেকক্ষণ। একজন বয়স্ক মহিলা হঠাৎ পিছন থেকে আমার বিনুনি নাড়িয়ে দিয়ে বলেন,"এটা আসল?" তারপর হাহা করে হেসে উঠে বলেন, "আমি সুদীপ্তর মা" বলেই কপালে একটা চুমু। আমিও সেই চুমুর ঝটকায় এবং কৃতজ্ঞতায় সটান তাঁকে একটা পেন্নাম ঠুকি!

সুদীপ্ত দা সেদিন রাতে ফোন করে। সে যে নেহাত বাচ্চা ছেলে নয়, আমার চেয়ে বেশ অনেকটা বড়, শুধু বয়সে নয়, কবিতায় কর্মে অভিজ্ঞতায় সবেতেই তা ততদিনে জেনেছি। কাজেই তাকে `তুমি` বলতে বেশ অস্বস্তি হতে থাকে, ‘হ্যাঁ বলুন সুদীপ্ত দা, আজকের অনুষ্ঠান...’ হঠাৎ তুমি থেকে আপনিতে উন্নীত হয়ে উনি মোটেও স্বচ্ছন্দ বোধ করেন না, ‘সেকি! আরে না না। আমাকে তুমি করেই বলো।’ ‘হ্যাঁ, মানে সুদীপ্তদা, তুমি মানে আপনি সরি তুমি বলছিলাম যে অনুষ্ঠান খুব ভালো হয়েছে। তুমি মানে আপনি মানে তুমিও খুব ভালো লেখেন সরি লেখো।’ আমার এই আপনি তুমির সংঘাত চিরকালের। ফোনের ওপারে সুদীপ্ত দার হাসির আওয়াজ শুনতে পাই। সে বলে, ‘তোমার মধ্যে অদ্ভুত এক সারল্য আছে। হরিণের মতো।’ তারপর মেসেজে সে লেখে কিছু লাইন,
খাটের বাঁ পাশ ঘেঁষে চলে গ্যাছে
রাতের দ্রাঘিমা তবু
আমি অশুভ সময়ের কাছে
প্রেম ভিক্ষা করি
যদি স্খলিত অসাবধানে ছিঁড়ে যায় তার
যদি পরিচিত দরজায় কড়া নেড়ে
ফিরে যায় কোন বিলুপ্ত হরিণ
আমি জেগে থাকি
অনন্ত জানালার পাশে
মেঘের শরীর থেকে নেমে
কখন হেঁটে যাবে তুমি বৃক্ষ বৃক্ষ পথ।

কবিতাটির অনুরণণে আসক্ত হই। নিজেকে সেই বিলুপ্ত হরিণের মতো মনে হয়, যে ফিরে যায় কোন নাম না জানা বৃক্ষশোভিত পথে। তার শরীরে মেঘ জমে জমে মৃঘনাভি তৈরি হয়। সেই সৌরভের প্রত্যাশায় বসে থাকে কোন নিদ্রাহীন কবি অনন্ত জানালার পাশে। অশুভ সময়ের কাছে তিনি প্রেম ভিক্ষা করেন। তবু হরিণীর নাগাল পাননা তিনি। কেনই বা পাবেন? নাগাল পেলেই মেঘ সরে যায়। বৃক্ষ বৃক্ষ পথ কাঁটাময় হয়ে ওঠে অযাচিত ঝোপ ঝাড়ে। নাগাল না পাওয়া অবধিই প্রেম। নাগাল পাওয়া যায়না যার সেই তো হরিণ!

নিজেকে তবু ফিরে যেতে দেখি ঘুমের ভেতর। কেউ কি আমার অপেক্ষা করছে? তবে ধরা না দেয়াই শ্রেয়। কেউ কি আড়াল থেকে আমাকে লক্ষ্য করছে? তবে লুকিয়ে পড়াই উচিত। কেউ কি আমাকে ভালোবাসতে চায়? তবে কঠোরতাই বাঞ্ছনীয়। কেউ কি আমাকে আঘাত দিতে চায়? তবে এক্ষুনি পালানো দরকার। কেউ কি হরণ করবে বলে প্রস্তুত? তবে শেষ করে দেই নিজেকে এই এখানেই। স্বপ্নবৎ গলিতে পাখির পালক উড়তে দেখি। অদ্ভুত এক ভয় হয়। এই যাবতীয় আশঙ্কা তথা অশুভ সম্ভাবনার জন্য কবিতাই দায়ী। ঘুমের ভেতর কবিকে অভিসম্পাত দেই।

‘ফিরে যাও কবি। তোমার আমাকে কিছুই দেয়ার নেই। কবিতার জন্য আমি দিয়েছি সবই। কিন্তু কবিতা? সে আমাকে কি দিলো? কেবল ক্ষতচিহ্ন। তুমি ফিরে যাও নির্জনে।’ স্বপ্নের মধ্যে শুনি কবিকণ্ঠ বেজে ওঠে মেঘমল্লারের মতো, আমি তোমাকে কিছু দিতে আসিনি। তবে সাথে করে নিয়ে যাব। গণ্ডুষ ভরে পান করবো। তুমি সেই বিষ, যা পান করা মাত্রই অমৃত হয়ে যায়। আমি যদি কবি হই তবে তুমি তার কবিতা। সেই মহেন্দ্রক্ষণে ঘুমের ভেতর আসমুদ্র চরাচর কেঁপে ওঠে সুতীব্র হ্রেষাধ্বনিতে। বৃক্ষ বৃক্ষ পথ ঝেঁপে বৃষ্টি আসে। প্রহরশেষের আলোয় রাঙা সেই অচৈতন্য রাতে বন্যা তার সর্বনাশ দেখে হরিণীর জন্য নিদ্রাহীন অরণ্য তছনছকারী এক যুযুধান কবির চোখে।

চলবে