ভূত বিলাসের ঘর

অন্তিম পর্ব

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২২, ২০১৮

আবেগের তীব্রতায় টানটান করে বেঁধে রাখা মনের তার তখন রাগ মালকোষে মগ্ন, মিলনোন্মুখ বন্দিশের সুরে:
কোয়েলিয়া বোলে অম্বুবা ডাল পর
রুত বসন্ত কো দেত সন্দেশা
নব কলিয়া মে গুঞ্জত ভবরা
উনকে সঙ্গ করত রঙ্গ রলিয়া
রুত বসন্ত কো দেত সন্দেশা।

অনাহূত সেই বসন্তকালের প্রত্যাশায় যখন রচিত হচ্ছে বিরহবিধুর প্রেমের তর্জমা, সেদিন ছিল সেপ্টেম্বর মাসের পঁচিশ তারিখ, সন্ধ্যাবেলা নিজের ঘরে বসে কিছু কাজ করছি, পাশে রাখা এফ.এম রেডিওতে বাজছে জগজিৎ সিং:
চিঠ্ঠি না কোই সন্দেশ
জানে ও কৌনসা দেশ
যাহা তুম চালে গ্যায়ে...
ইস দিলপে লাগাকে ঠেস
জানে ও কৌনসা দেশ
যাহা তুম চালে গ্যায়ে...

বাবুই হঠাৎ এসে বললো, চল এক্ষুনি জামশেদপুর যেতে হবে। বিস্ময়ের রেশ কাটতে না কাটতেই শুনি মায়ের কান্নার আওয়াজ। কাকতালীয় ভাবে হলেও মনে হয় জগজিতের সেই গজল সেদিন সন্ধ্যায় আমার কথা মনে করেই ইথারে ভাসিয়েছে কেউ!

বাবুই বলে, ‘বাবা আর নেই। সাডেন হার্ট অ্যাটাক, জামশেদপুর থেকে খবর এসেছে।’ মাঝের দীর্ঘ অনেক বছর উনি আর আমাদের সাথে ছিলেন না। থাকতেন ওনার ওয়ার্কপ্লেসে। এই সময়ের মাঝে, যে ক’বার মাত্র উনি এসেছেন, আমার সাথে কোনো কথা বলেননি, আমিও না। উনি আসবেন জানলে আমি বরং ভীত থাকতাম। এই বোধহয় বাড়িতে অশান্তি হবে, দোতলার ঘর থেকে ভেসে আসা কথা কাটাকাটির অসহ্য শব্দ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করতে হয়তো আমাকে ঘরের জানলা দরজা দিতে হবে, তারপর তিনি গটগট করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেট খুলে আধো অন্ধকারে বিলীন হয়ে যাবেন। তার চেয়ে বরং না আসাই ভালো, তার চেয়ে বরং ওনার সাথে এ জীবনে আর দেখা না হওয়াই ভালো এমনও ভেবেছি কতবার।

কিন্তু যখন ওনার সত্যিকারের চলে যাওয়ার খবর শুনি, যখন পাশের ঘর থেকে মায়ের ফোঁপানো কান্নার শব্দ কানে আসে, নিজের চোখের কোণায় স্পর্শ করে দেখি আঠার মতো সেখানেও লেগে আছে জল, গাল বেয়ে হুড়মুড় করে নেমে আসতে চাইছে, কিছুতেই বাগে আনতে পারি না কণ্ঠনালী বেয়ে ওঠা ফোঁপানিটা। সেকি পিতৃবিয়োগের বেদনা? সেকি এমন একটি সম্পর্ক যা আসলে পুরোটাই শূন্যতায় ভরা ছিল তা চিরতরে শূন্য করে চলে যাওয়ার আগে হৃদয় ভেঙে ওঠা ঢেউ? নাকি এই অশ্রু আসলে মুক্তির? যে সম্পর্ক কেবল বেদনা দেয়, অর্থহীন জেনেও সামাজিক বোধে মানুষ যাকে আজীবন বহন করে চলে, এই অশ্রু কি আসলে সেই দহনশেষেরই ইঙ্গিত ?

সে রাতেই একটি গাড়ি ভাড়া করে রওনা হই জামশেদপুরের দিকে। সাথে মা, মাসি আর বাবুই। সে পথ যেন জীবনের সবচেয়ে কঠিন পথ বলে মনে হয়। রাতের অন্ধকার ভেদ করে এগিয়ে চলে গাড়ির হেডলাইট। সে আলোর রেশ যেন মনের ভেতরেও এসে পড়ে। এতদিন অন্ধকারে মাথা নিচু করে বসেছিল যে মেয়েটা, সেই আলো লেগে তার চোখ ঝলসে যায়। কোন সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করাতে চায় আজ ঈশ্বর তাকে? এই পথ কি কোনো বেদনার শেষ অবধি যায় যেখান থেকে নতুন কোনো উপলব্ধির শুরু? কখনো সমতল কখনো এবড়ো খেবড়ো পথের দু`পাশে জবুথবু দাঁড়িয়ে থাকা গাছেরাও যেন মেয়েটির সাথে ইশারায় কত কথা বলতে চায়, হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে পিতার মুখে আগুন দিতে যাচ্ছে যে মেয়েটি!

ভোরের আলো গাঢ় হতে হতে শহরে পৌঁছাই। কলকাতা থেকেও আসে আমার পিতৃকুলের কিছু লোকজন এই সদ্য পিতৃহারা তরুণীর জীবনের ভাবাবেগের কোনো হদিশ ছিল না যাদের কাছে। মর্গ থেকে দেহ যখন বাইরে আসে, দেহটির দিকে চেয়ে মায়া হয়। কেমন অসহায়ের মতো শুয়ে আছে লোকটা। এই সেই মানুষ যিনি তার বুট জুতোর খটখট শব্দ তুলে আমার নরম বুকের ওপর দিয়ে কতই না হেঁটে গেছেন, একবার ফিরেও না তাকিয়ে। ইচ্ছে হয় তাকে খুব বকি। সেদিন বিকেলে বুকে ব্যথাটা যখন ওঠে, হয়তো ফোনের রিসিভারের দিকে হাতখানা এগিয়েও ফিরে গেছে বারবার—
এক আহ ভরি হোগি
হামনে না শুনি হোগি
যাতে যাতে তুম
আওয়াজ তো দি হোগি....

এই অভিমান তবে কার প্রতি ছিল? আমার প্রতি অভিমানী হওয়ার কোন সঙ্গত কারণ খুঁজে পাই না, কারণ তার জন্য একটা সম্পর্ক লাগে। তবে এই অভিমান হয়তো তার নিজের প্রতিই ছিল, নিজের অপারগতার প্রতি। চুপচাপ কাউকে না জানিয়ে তাই তার এই চলে যাওয়া।

সুবর্ণরেখা নদীর ধারে শ্মশান। ইলেকট্রিক চুল্লী যখন ধীরে ধীরে গ্রাস করছে নিস্তরঙ্গ একটি অস্তিত্বকে, মন কেমন ভারী হয়ে এলো। এই সেই মহামান্য মৃত্যু, যেখানে এসে সব শেষ হয়, সকল আনন্দ বেদনা প্রাপ্তির অহং হারানোর শোক নিরেট মৃত্যুর কোলে এসে মিশে যায়। দুটো মানুষের মাঝখানে অনতিক্রম্য পাঁচিল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে যে উদ্ধত জীবন, মৃত্যু এসে তা চূর্ণ করে শেষকৃত্যের অধিকারে। তবু মৃত্যুকে চাই না আমি, তার মুখোমুখি দাঁড়াতে ভয় হয়, কত রাত দুঃস্বপ্নে জেগে উঠি মৃত্যুসম বোধে। সেই শরীরের পুড়ে যাওয়া দেখে নিজেকে অসহায় মনে হতে থাকে। ইচ্ছে করে তার ঘুম ভাঙিয়ে জিজ্ঞেস করি, ‘বলো, কি দিয়ে গেলে আমায়? একদিন মরতে হবে আমাকেও। এই চুল্লীতেই ছাই হবো আমি। সেতো কেবল তুমি একদিন আমার জন্মের কারণ হয়েছিলে বলেই! তোমার থেকে পেলাম যা আমি তা কেবল এই মহামৃত্যুর অধিকার।’

সুবর্ণরেখার জলে ছাইভস্মের ঘট ডুবিয়ে দিয়ে ঘাটে কিছুক্ষণ বসে থাকি একা। মাথার ভেতর তখন জন্ম নিচ্ছে গোটা একখানা কবিতা—
সুবর্ণরেখার জলে রেখে এলাম
বাবাকে।
বাবা এখন ঘুমাবে আর
বাবার ওপর ঘুমাবে জল।
ঘুম ভাঙলে—
বাবা আমায় ডাকবে।
জলের ভেতর সিঁড়ি বেয়ে
বাবাকে দু-হাত ধরে তুলে নেব
কোলে।
ঘাটের ধারে বসে
জলে পা ডুবিয়ে
বাবা আমায় লিখে দেবে
মৃত্যুর উত্তরাধিকার।

এবার জলে নেমে আমি
বাবার পাশে শোবো চুপচাপ
কোনো আওয়াজ না করে।

শুনেছি যখন আমার মাথার ভেতর জন্ম নিচ্ছে গোটা এই কবিতাখানা, তখন নাকি কেউ কেউ এমন প্রশ্নে দ্বিধান্বিত ছিল যে, কেন আমার মা ঘটা করে সিঁদুর মোছেননি বা শাখা ভাঙেননি। আমি তো ভাবতাম কেন উনি এতদিন ওগুলো পড়েছিলেন? প্রতিদিন স্নান করে সিঁদুর পরতেন যখন, নিজের বিবাহিত জীবনের দীর্ঘায়ু কামনা করতেন কি তিনি? তাও কি সম্ভব! এ জগতের কাছে সমাজের কাছে নিজের প্রমাণ রাখাটা বাহানামাত্র। আসল পরীক্ষা তো মানুষ নিজের কাছে দেয়। নিজের মনের কষ্টিপাথরে নিজেকে যাচাই করে নিজের শুদ্ধতার প্রমাণটুকু নিজের কাছে রাখলেই যথেষ্ট। একদিন তা আলোর মতো উদ্ভাসিত হয়। এই পৃথিবীতে আর কারো কাছে কিইবা প্রমাণ দেয়ার আছে!

ফিরে আসি এক ক্লান্ত মানুষের মতো, যে মানুষের জীবন জুড়ে অজস্র দ্যোতনাহীন অনুভূতি শব্দের তীব্রতায় আক্রান্ত হয়। ফিরে আসি এক ভারাক্রান্ত শ্রমিকের মতো, যার কাজ মৃতপ্রায় জীবনের মুখে জল ঢেলে বারবার তাকে চাঙা করে তোলা। ফিরে আসি এক অস্থির জানোয়ারের মতো, যে বারবার নিজের গলার বকলশটি ছিঁড়ে বেরিয়ে যেতে চায়, কিন্তু পারে না। সেই সে মানুষ নিপাট আসন পেতে বসে পিতার শ্রাদ্ধে। ঘি মাখা চালের এক একটি দলা তুলে দেয় কল্পিত আত্মার উদ্দেশে।

জামশেদপুরের মর্গে এসেছিলেন বাবার এক কলিগ। মর্গ থেকে শ্মশান অবধি আমি তার গাড়িতে যাই। পথে উনি বললেন, ‘বাসুবাবু সবাইকে গর্ব করে বলতেন আমার মেয়ে ইঞ্জিনিয়ার।’ ঘি মাখা চালের দলা কল্পিত আত্মাকে উৎসর্গ করতে করতে বলি, ‘বাবা তুমি যেমনই হওনা কেন, মেয়েকে নিয়ে গর্ব করার অধিকার ছিল বৈকি তোমার! তাবলে মিথ্যা অহংকার? তার চেয়ে বরং তুমি আমাকে আশীর্বাদ কোরো বাবা, অনেক স্তুতি আঘাত আনন্দ বেদনার উত্তরাধিকারে আমি যেন একজন আলোকিত মানুষ হতে পারি, যে আলোর পৃথিবীর বড় দরকার!

এমনসব প্রার্থনা শেষ হলে আইনের বই বুকে নিয়ে ল কলেজে যাই। ওখানে দুজন আমার ভালো বন্ধু হয়, ঋষি আর অম্লান, দুটিই আমার অনুজ। গোটা ক্লাসে কেবল এই দুজনই আমাকে `শ্রেয়া` বলে ডাকতো ভাগ্যিস, বাকিরা এমনকি আমার সিনিয়র সহপাঠীরাও আমার নামের পাশে ছোট্ট করে একখানা `দি` জুড়ে দিতো। মহসীনের ডিপার্টমেন্ট হেড ভীষণ প্রতিভাবান প্রাণখোলা মানুষ, স্নেহ করতেন আমাকে। একদিন তার কাছে অনুযোগের সুরে এই দুঃখের কথা জানাতে তিনি বললেন, ওই দিদি ডাকার ব্যাপারটা তোমার পার্সোনালিটির জন্য।’ তারপর হা হা করে অনেকক্ষণ হাসলেন। সেই পার্সোনালিটি কিরকম, বেশ একটু নীরব গভীর প্রকৃতির তো বটেই, অনেকক্ষণ নিজেকে আয়নায় দেখে মনে মনে ঋষি আর অম্লানকে কৃতজ্ঞতা না জানিয়ে পারিনি যে, ঐ থমথমে বৃষ্টির দিনেও তারা আমাকে নাম ধরে ডেকে ছাতাটি এগিয়ে দিতে কখনো দ্বিধা বোধ করেনি। ঋষির বন্ধুত্ব স্থির নীরব প্রকৃতির। অম্লান প্রচুর কথা বলতো, কিন্তু আমার বিয়ের ইনভিটেশন দিলাম তাকে যেদিন, সেদিন সে ফোনে পাঁচ মিনিট নীরবতা পালন করেছিল!

ল এর তিনটে সেমিস্টার কমপ্লিট করার পর আমার বিয়ে হয় সুদীপ্তর সাথে। তখন শ্রাবণ মাস। সুদীপ্ত লেখে,
অকারণ গুল্ম জন্ম ছিঁড়ে খুঁড়ে
হুল্লোড় করে বলে দিতে ইচ্ছে হয়
শিকড়ে ছড়িয়ে গেছে বৃক্ষ ভাবনা
শিকড়ে ছড়িয়ে গেছে মহান্ত প্রেম!

গুল্মের মতো এ জীবন, কেবল প্রেমই তাকে মহীরূহ করে। মুহূর্তের জন্য হলেও ভুলিয়ে দেয় যাবতীয় নশ্বরতা, নিজেকে তখন অনন্তসোহাগী বলে মনে হয়। বন্যার যেদিন জন্ম হয়েছিল সেদিন শহর ভেসেছিলো বৃষ্টিতে। যেদিন তার বিয়ে হয় সেদিনও তুমুল বৃষ্টি। সেদিনটিতেই তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ পায় প্রতিভাস থেকে, বইটির নাম `প্লাবন খেলার আগে`, যার মোড়ক উন্মোচিত হয় কবি জয় গোস্বামীর হাতে। অনেক নতুন স্বপ্ন বুকে নিয়ে বন্যা পা রাখে অজানা এক গৃহের চৌকাঠে।

শুনেছি বিয়ের পর মেয়েদের নবজন্ম হয়। বন্যার সে নবজন্ম কেমন ছিল? বলবো আবার কখনো যদি ইচ্ছা হয়। এবারের মতো থেমে যাব এইখানে। যে কথা আমি বলেছি একান্ত নিজের হয়ে তা বহু হৃদয়ের কথা হয়ে বহু মনের আশ্রয় হবে একদিন এই আশা রাখবো। `ভূত বিলাসের ঘর` উৎসর্গ করবো সেতুকে (আমার একমাত্র মেয়ে)। আমার সমগ্র চেতনার উত্তরাধিকার তার। এই পৃথিবীতে আমার সামান্য জীবনটুকুকে জানার প্রয়োজন হয়তো তারই সবচেয়ে বেশি।