
ভূত বিলাসের ঘর
আত্মজীবনী ৩
শ্রেয়া চক্রবর্তীপ্রকাশিত : মে ১৩, ২০১৮
বাবুইয়ের সাথে মায়ের পরিচয় আঁকার ক্লাসে। একই স্কুলে আঁকা শিখতো দুজন। ষাটের দশক। বাবুই তখন দামাল কিশোর। মাঠে-ঘাটে বেপরোয়া ঘুরে বেড়ায়। চোখে-মুখে এক অদ্ভুত আগুন। ভয়-ডর কিছুই নেই। দিনেরবেলা পুকুরে তুমুল সাঁতার কাটে। একা একা মাছ ধরে, পুকুরপাড়ে বসেই সেই মাছ কাঠকুটোয় আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে খেয়ে নেয়। কখনো জলে ডুব দিয়ে ধরে আনে গেরি গুগলি। রাতের অন্ধকারে বল্লম নিয়ে বেরোয় সাপ ধরবে বলে।
বাবুইয়ের বাবা ঢাকার ধনী ব্যবসায়ী ছিলেন। দেশভাগের সময় পরিবার নিয়ে এপার বাংলায় চলে আসেন। উদার ও বেখেয়ালি স্বভাবের মানুষটি বিশ্বাস করে যার ওপর ব্যবসার দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন, সে সবকিছু নয়-ছয় করে দেয়। অর্থের অভাবে বাবুইয়ের লেখাপড়ায় ছেদ পড়ে।
সেই সময় শহরজুড়ে তৈরি হয় এক তুমুল রাজনৈতিক আন্দোলনের আবহ। অনেক ছাত্র, কিশোর, যুবক সেই আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে। সেই আন্দোলনে উদ্দীপিত হয়ে ওঠে বাবুইও। রক্ত ফুটছে দাউদাউ করে, চোখে নতুন সমাজ গঠনের স্বপ্ন, বাবুই তখন অপ্রতিরোধ্য। তারপর একদিন গোটা তল্লাটজুড়ে ধরপাকড় শুরু হয়। বাবুই নিজেও ওয়ান্টেড, পালিয়ে বেরাচ্ছে এদিক ওদিক। আন্দামানে বাবুইয়ের এক দাদা থাকতো। তার কাছে আশ্রয়ের আশায় একদিন জাহাজে উঠে বসে বাবুই, শুরু হয় সমুদ্রযাত্রা।
পকেটে কানাকড়ি নেই তেমন। কিশোর ছেলেটি একা একা শুয়ে থাকে জাহাজের ডেকে। এমন সমুদ্র এত তার রূপ ছেলেটি আগে কখনো দেখেনি। সুবিপুল তরঙ্গ একবার জাহাজটিকে মাথায় করে শীর্ষে তুলছে, আবার ঝুপ করে নামিয়ে দিচ্ছে অতলে। চারদিকে আসমুদ্র নীল শূন্যের ভেতর বড় একা ছিল বাবুই সেদিন। জাহাজের দুলুনিতে বারবার বমি হচ্ছিল। সি সিকনেস। পেটে খিদে গায়ে জ্বর নিয়ে আকাশের দিকে চেয়ে ছিলো সে, তারপর কখন যেন ঘুমে দুচোখ জুড়ে এসেছিল!
আন্দামান পৌঁছলো বাবুই। কিন্তু দাদার বাড়িতে তার জায়গা হলো না। সুতরাং আবার শুরু হলো অস্তিত্ব রক্ষার অন্বেষণ। কখনো খেয়ে কখনো না খেয়ে একটা কাজের আশায় বিপদসঙ্কুল দ্বীপপুঞ্জের অপরিচিত পথে অজানা অরণ্যে ঘুরে বেড়াতো ছেলেটি একা একা। দেখতো চারদিকে কত নাম না জানা গাছ, কত পাখি, বুনো ফুলের অবাক ফুটে থাকা আর শুনতে পেতো রহস্যময় সমুদ্রের গর্জন। ওই সমুদ্রের জঠরে কী অপার বিস্ময় আছে, কত প্রাণের আশ্রয় সেখানে, বাবুই চোখ বন্ধ করে ভাবতো। অথচ এই গোটা পৃথিবীতে তার কোনও আশ্রয় নেই কেন? এমন কোনও হাত নেই কেন যে তার কপাল স্পর্শ করা মাত্রই তার ভেতরের দলা পাকানো আগুন গলে জল হয়ে যাবে এক নিমেষে? এমন কোনও ছায়া নেই কেন যে তাকে ঘুম পাড়িয়ে দেবে, আর পালিয়ে বেড়াতে হবে না কোথাও? স্বপ্ন দেখা কি অপরাধ? এই পৃথিবীর বুকে একটা নতুন সমাজ গড়ে তোলার যে আদর্শ, প্রতিটা মানুষের মুখে অন্ন তুলে দেয়ার যে শপথ তা কি মিথ্যে? সাম্যবাদ... সে কী কেবল এক ধোঁয়াশা?
খুব তেষ্টা পেয়েছিল সেদিন। জল খাবে বলে নদীতে নেমেছিল বাবুই। হঠাৎ আসা জলের তোড়ে হুড়মুড় করে ভেসে যেতে যেতে সে ভেবেছিল, সেদিনই বোধহয় জীবনের শেষ দিন। কিন্তু না। কোনোভাবে একটা গাছের গুড়ি আঁকড়ে ধরে সে চড়ে বসে স্রোতের ওপর। তারপর ডাঙায় ওঠে। তারপর হঠাৎ একদিন সে সিদ্ধান্ত নেয়, কলকাতায় ফিরবে। সেই সুদূর আন্দামানে পালিয়ে বেড়ানো দুর্ধর্ষ যুবক বাবুইকে তার থেকে অনেক দূরে জন্ম নেয়া একটি অবলা শিশুর সাথে, যে শিশুর কাছে এই পৃথিবী তার বিপুল আলো অন্ধকারের উত্তরাধিকার নিয়ে প্রকাশিত হচ্ছিলো, ঈশ্বর যে অদৃশ্য বন্ধনে বেঁধে দিয়েছিলেন তার কোনও নাম ছিল না, কিন্তু সেই নামহীন অলৌকিক টানাপোড়েনের দাবিতেই তার ফেরাটা অনিবার্য ছিল।
দাদার থেকে কিছু টাকা ধার নিয়ে বাবুই জাহাজে চেপে বসে। কলকাতার পরিবেশ তখনও অগ্নিগর্ভ। কলকাতায় ফিরে বাবুই আসে আমার দাদুর সাথে দেখা করতে। মায়ের সাথে আঁকা শেখার সুবাদে সে আগেও এসেছে কয়েকবার। দাদু জনদরদি মানুষ ছিলেন। বাবুইয়ের জীবনের সংশয় আছে বুঝতে পেরে দাদু বাবুইকে আশ্রয় দেয় তার বাড়িতে, বাবুইয়ের নতুন হাইড আউট। দাদু দিদিমা তাকে সন্তানের মতোই স্নেহ করতেন। সারাদিন সে দরজা জানলা বন্ধ করে একা একা বসে থাকতো একটা ঘরে, যেন পুনর্জন্মের নিরবিচ্ছিন্ন প্রস্তুতি চলছে। দাদুর সহযোগিতায় ও উৎসাহে প্রাইভেটে মাধ্যমিক পাশ করলো বাবুই। ততদিনে পরিস্থিতি অনেকটা শান্ত, বাবুই ঝাঁপ দিলো নতুন জীবনযুদ্ধে।
সেই বাবুই আবার ফিরে এসেছিল ফিনিক্স পাখির মতো। একা একা খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে পড়েছি যখন, সে আমাকে কোলে তুলে নিয়েছিলো কোনও আওয়াজ না করে। বাবুইয়ের সাথে আমার প্রিয় খেলা ছিল, জাহাজ জাহাজ। আমি কল্পনার জাহাজ থেকে কাল্পনিক সমুদ্রে নামতাম, যেই না হাঙর আমাকে গিলতে আসছে, বাবুই বাঁচিয়ে নিয়ে আসতো। একহাতে আমাকে আর আরেক হাতে সাইকেল চালিয়ে সে আমাকে নিয়ে যেত তার বাড়িতে। সারাদিন বাবুইয়ের কোলে, কোল থেকে নামতামই না। কেউ কোলে নিতে চাইলে যেতাম না, অন্য কাউকে কাছে ঘেঁষতে দিতাম না।
কোনও কাল্পনিক বৃক্ষ শাখায় তার যে নিপুণ বাসা, সেখানে আমাকে অনেক যত্নে রেখেছিল বাবুই। সেই মায়া অরণ্যে নিশ্চিন্তে চোখ মেলছিল আমার শৈশব। সেই স্নেহে মা-বাবার ভেদাভেদ মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছিল। অনেকখানি অন্ধকার তরঙ্গে ভেসে এসে এই অদ্ভুত সুন্দর পৃথিবীতে সেই প্রথম কোনও কিছু আলোর মতো বোধ হয়েছিল, আর সেই আলোর প্রতি অধিকারবোধও ছিল তীব্র। সেদিন সেই স্নেহ অরণ্যের ঝরাপাতায় মর্মর রবে বাজতো একটা গান, আমি শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়তাম বাবুইয়ের কোলে:
তেরা মুঝসে হ্যায় পেহেলেকা নাতা কোই,
ইউহি নেহি দিল লুভাতা কোই,
জানে তু ইয়া জানে না
মানে তু ইয়া মানে না...
চলবে
লেখক: কবি ও গদ্যশিল্পী