মাহবুব লীলেন

মাহবুব লীলেন

‘মহাভারত’-এর কথা, অভাজনের ভাষায়

মুয়িন পারভেজ

প্রকাশিত : মার্চ ০৬, ২০১৯

‘মহাভারত’ লইয়া যত বইপত্তর লেখা আছে, সেগুলার তালিকা করতে গেলে আরেকখান মহাকাইব্যের পয়দা হইতে পারে। মাহবুব লীলেনের ‘অভাজনের মহাভারত’ সেই তালিকায় নবতর সংযোজন হইলেও অন্তত দুইটা কারণে স্বতন্তর: প্রথমত, লেখক বিখ্যাত পুরাণকাহিনির বিচার করতেছেন সংস্কারমুক্ত মনে বা সংশয়ীর তীক্ষ্ণ নজরে; দ্বিতীয়ত, তার বর্ণনার ভাষা আমাদের মৌখিক ভাষাই, যে-ভাষায় নিত্যদিনের কথা কই ঘরে বা অড্ডাখানায়। সবাই তো প্রমিত বাংলায় লেইখা গেছেন ইতিপূর্বে, কিন্তু মাহবুব লেখতে চান প্রাকৃত বাংলায় বা ‘অভাজনের’ ভাষায়।

প্রাকৃত বাংলা বা ‘মুখের বুলি’র প্রতি দরদ দেখাইছিলেন ঐতিহ্যানুরাগী রবীন্দ্রনাথ। ‘বাংলা শব্দতত্ত্ব’ বইয়ের শুরুতেই তিনি সংস্কৃত-ঘেঁষা সাধু বাংলা বনাম প্রাকৃত বাংলা-বিষয়ক মূল্যবান তর্ক উসকাইয়া দিছেন। রবীন্দ্রপরবর্তী পাশ্চাত্যমুখী কবিগণ যখন ‘আধুনিকতা’র আফিমে প্রবলভাবে আসক্ত, তারও প্রায় একযুগ আগে মনীষী দীনেশচন্দ্র সেন রায় বাহাদুর খণ্ডে-খণ্ডে ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’ ও ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’ প্রকাশ করতেছিলেন। মজার বিষয়, দীনেশচন্দ্রের নাতি হইলেও সমর সেনের কবিতায় পাওয়া যায় না সেই শিকড়ের গন্ধরস। বোদল্যের-এলিয়টের বাথটাবে ডুব মারতে গিয়া আমরা ভুইলা গেছিলাম নদের চাঁদের আকুতিভরা কথা—

কোথায় পাব কলসী কইন্যা কোথায় পাব দড়ী।
তুমি হও গহীন গাঙ্গ আমি ডুব্যা মরি॥

‘আমারে নিবা মাঝি লগে?’ ‘পদ্মানদীর মাঝি’তে কপিলা কইছিল না এমন কথা? ‘প্রমিত’ তথা ‘শুদ্ধ’ বাংলায় কি ধরা যাইবে কপিলার বা মহুয়ার আবেগের লোকায়ত কম্পনরেখা? প্রমিত বাংলায় প্রচুর ধ্রুপদি সাহিত্য রচিত হইছে, সেগুলা মাথার মণি, কিন্তু মুখের ভাষায়ও যে অসামান্য গল্পকবিতা লেখা যাইতে পারে, এমনকী জসীম উদ্‌দীনের কবিতাভূমিও যে ভাবীকালের সম্ভাবনার বীজতলা হইতে পারত, আধুনিকতার দোহাই দিয়া আমরা মুখ ফিরাইয়া রাখছিলাম সেখান থেইকা। আল মাহমুদ একবার আক্ষেপ কইরা লেখছিলেন, ‘তিরিশের কবিদের দেশ নাই’! এ-কথা অবশ্য কইতে চাই না যে রবীন্দ্রনাথের প্রাকৃত বাংলা ও মাহবুবের লোকভাষার রূপ অভিন্ন। এই ভাষার রূপতত্ত্ব ও শব্দতত্ত্ব লইয়া বিস্তর কথাবাত্রা হইতে পারে আসলে।

‘অভাজনের মহাভারত’-এর ভাষা অত্যন্ত সুখপাইঠ্য, য্যান মড়াইকল থেইকা নিংড়াইয়া পড়তেছে আখের রস। মূল কাহিনিতে ঢোকার আগে ‘ভণিতা’ ও ‘ভণিতা বিস্তার’ নামে যে-দীর্ঘ সারগর্ভ ভূমিকা আছে (৯-৮৯ পৃষ্ঠা পর্যন্ত), শুধু এইটার জইন্যও বইখান অমরত্ব দাবি করতে পারে। ‘মহাভারত’-সংক্রান্ত পূর্বসূরিদের উল্লেখযোগ্য সব বইয়েরই চুলচেরা বিশ্লেষণ আছে; লেখকের বিশেষ সমীহ পাইছেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, রাজশেখর বসু, বুদ্ধদেব বসু, সুকুমারী ভট্টাচার্য, নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী প্রমুখ পণ্ডিতগণ। প্রতিভা বসুর ‘মহাভারতের মহারণ্যে’ বইখান মাহবুবের মনে হইছে ‘বর্ণবাদী’ বা ‘কুৎসিত পুস্তক’। শুনতে খারাপ লাগলেও কথাখান যুক্তিশানিত।

‘আইচ্ছা কর্ণ কি আদৌ কুন্তীর পোলা?’ এমন বহু জিজ্ঞাসা পদে-পদে, আছে জিজ্ঞাসার যৌক্তিক ও মনোরম নিরসনও—

‘শিখণ্ডীরে অনেকেই হিজড়া কন; কিন্তু এই বিবাহিত ব্যাডার রীতিমতো পোলাপান আছে। মনে লয় ভীষ্মের মরণরে মহান বানাইতে গিয়া অম্বার পুনর্জন্ম-টুনর্জন্ম জুইড়া দিয়া শিখণ্ডীরে ছাইয়া বানাইয়া থুইছে কবিরা।’

বইখান শেষও হয় অসাধারণ এক অনুচ্ছেদে, য্যান কবিতা পড়তেছি—

‘বনের পথে সবার আগে আগে হাঁটে যুধিষ্ঠির। তার পিছনে হাঁটে পাঁচটা মানুষ আর একটা কুকুর। হাঁটতে হাঁটতে পড়ে যায় দ্রৌপদী; যুধিষ্ঠিরের পিছনে পা মিলায় চাইরটা মানুষ আর একটা কুকুর। পড়ে যায় সহদেব; যুধিষ্ঠিরের পিছনে চলে তিনটা মানুষ আর একটা কুকুর। পড়ে যায় নকুল; যুধিষ্ঠিরের পিছনে থাকে দুইটা মানুষ আর একটা কুকুর। পড়ে যায় অর্জুন; যুধিষ্ঠিরের পিছনে দৌড়ায় একটা মানুষ আর একটা কুকুর। পড়ে যায় ভীম; আর পিছনে একটা কুকুর নিয়া আগাইতে থাকে কুন্তীপুত্র যুধিষ্ঠির; যারে সর্ব অবস্থায় স্থির থাইকা সামনে আগানোর লাইগাই জন্ম দিছে কুন্তী; হোক তা ক্ষমতার দিকে আর হোক নিরুদ্দেশ যাত্রায়...’

প্রাকৃত বাংলার একখান বড়ো সীমাবদ্ধতার কথা স্মরণ করাইয়া দিছিলেন রবীন্দ্রনাথ, তা হইল প্রত্যয়যোগে শব্দগঠনের সীমাবদ্ধতা, সংস্কৃত যেখানে তুলনাহীন। তবু, নানা সংকট মাইনা লইয়াও, মুখের ভাষায় যে চিন্তাশ্রয়ী অথচ প্রাণবন্ত গইদ্যের বইও লেখা যায় মাহবুব তা দেখাইছেন আমাদের। পড়তে গিয়া শুধু ভাবতেছিলাম, আইচ্ছা, নারীকবিরা কি কখনও অনুবাদ করেন নাই ‘মহাভারত’? কিশোরগঞ্জের মাইয়া চন্দ্রাবতী লেখছিলেন ‘রামায়ণ’; নবনীতা দেবসেনের আলোচনা পইড়া মনে হইছে সেই পুথি একটু অন্যরকমের। কোথাও রামবিদ্বেষ নাই, ভক্তির খামতি নাই, তবে সীতার মনস্তত্ত্বে য্যান ছড়াইয়া আছে নারীর চিরন্তন হাহাকারের বালি। তেমন কোনও ‘মহাভারত’ কি লেখা হয় নাই ভারতবর্ষে?

ঘাপলার শেষ নাই ‘মহাভারত’-এ—জন্ম আর বয়স লইয়া, ঘটনা আর ভূগোল লইয়া, এমনকী অস্তরশস্তর লইয়াও। ‘দুনিয়ার সব থাইকা বড়ো ভজঘট; মহাভারত’, ‘ভণিতা’র শুরুতে বলতেছেন মাহবুব, ক্রমশ ‘ভজঘট’-এর জটও খুলতে নামেন তিনি। এজইন্যই কি প্রতি অনুচ্ছেদের শেষে ত্রিবিন্দু বসাইয়া দিতে চান? মানে, যা বলা হইছে তা-ই চূড়ান্ত ধরনের কিছু না, আছে আরও অনুক্ত কথার ঢেউ? বিনয়ের স্বরেই তিনি লেখেন: ‘পয়লা চেষ্টা। গোঁজামিল আছে বহুত জায়গায়। মাঝে মাঝে ইসকুলি বাংলা বাগড়াও দিছে। ধরাই দিয়েন...’

কিছু-কিছু বানানবিপর্যয় বা মুদ্রণপ্রমাদ চোখে পড়ে অবশ্য। একই পৃষ্ঠায় (৮১) আছে ‘ব্যকরণ’ ও ‘ব্যাকারণ’, চন্দ্রবিন্দুহীন ‘খুইড়া’ বা ‘খুজলেও’, ‘ঋকবেদ’ ও ‘ঋগবেদ’, ‘পরবর্তীতে’ ও ‘পরবর্তীকালে’, ‘বেদ বিরোধীতা’ ও ‘বৌদ্ধ বিরোধিতা’, ‘বাল্মিকী’, ‘শতাব্দি’, ‘কাব্যিক’ অর্থে ‘কাবিক্য’ ইত্যাদি। যিনি লেখেন ‘তিরাইতেছে’র মতন চমৎকার লাগসই শব্দ, তাঁর কলমে কি মানায় ‘পুস্তকাবলী’? ‘হাঁটতে হাঁটতে পড়ে যায়’ কথাখান মৌখিক ভাষায় একটু কি বেখাপ্পা লাগে না?

‘অভাজনের মহাভারত’ প্রথম বাইর করছিল শুদ্ধস্বর, ২০১৫ শালে। বাতিঘর থেইকা প্রকাশিত নতুন সংস্করণ এবারের বইমেলার একখান দারুণ সন্দেশ, বলা যায়। শুদ্ধস্বরের বইতে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ও মজাদার আলাপশালাপ আছিল বোধহয়, বিশেষত ভাষা লইয়া, বাতিঘরের বইতে বাদ গেছে ওসব। ক্যান বাদ গেছে তার ব্যাখ্যা নাই, তবু যা আছে তা মহার্ঘ—ভাবনার জলে ফেইলা দেয়, তুইলা নেয় আনন্দের ডাঙায়।

লেখক: কবি

একুশে বইমেলা ২০১৮