মাঠ পেরোলে ছিপছিপে এক নদী

আবু তাহের সরফরাজ

প্রকাশিত : এপ্রিল ১৫, ২০১৯

দাঁড়িয়ে রয়েছি আমি।
কুয়াশা চারদিকে। আর কনকনে হাওয়া। নদীর ওপর দিয়ে ছুটে এসে ঢুকে যাচ্ছে শরীরের ভেতর। একেবারে মজ্জায়। তারপর ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে, ছিপছিপে অন্ধকারে।
কুয়াশার চুড়োয় চাঁদ। ঘোলাটে। আর এই যে নদী আমার সামনে, কুয়াশার তল ছুঁয়ে হিম ছড়িয়ে দিচ্ছে। শিরশিরে হাওয়া ছুটে যাচ্ছে কুয়াশার ভেতর দিয়ে। কেঁপে ওঠে কুয়াশা। কাঁপতে থাকি আমি। অথচ চাঁদ স্থির। নদী স্থির। শব্দের স্থিরতা নেই। কুয়াশার শব্দ। হাওয়ার শব্দ। রাতপোকাদের শব্দ। একটু দূরে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে থাকা গাছপালার পাতা থেকে শিশির ঝরে পড়ার শব্দ। এ রকমের নানা শব্দ মিলে আরেক রকম একক শব্দ, যা কেবল এই মুহূর্তেই শুনতে পাচ্ছি আমি।

এই এক ভাষা। শব্দের ভাষা, এবং সৌন্দর্যেরও।
আমার আঙুল কাঁপে। ঠোঁট কাঁপে। রক্তের ভেতর টের পাই আদিম শীতলতা। আর শুনতে পাই কোনও প্রাচীন গহ্বর থেকে উঠে আসা অস্পষ্ট ভাষা। যে ভাষা কেবলই হারিয়ে ফেলে মানুষ। যে ভাষা হারিয়ে যেতে যেতে লুকিয়ে থাকে ইথারে, হারায় না কখনও।

পৃথিবীর কোনও শব্দই আসলে হারিয়ে যায় না। মানুষের কোনও ভাষাই আসলে হারিয়ে যায় না। আর বলতে কী, মানুষও হারায় না। মানুষ মানেই তো এক একটা গল্প। এক গল্প থেকে আরেক গল্পে ঢুকে যাওয়া। এক একটা জীবনচক্র। একটা গল্প আরেক গল্পে যে রকম ঢুকে যায়, জীবনচক্রও এ রকম। এক জীবন থেকে আরেক জীবনে ঢুকে যাওয়া। আমি কান পেতে শুনতে থাকি অনেক অনেক কাল আগে মানুষের হারিয়ে ফেলা চাঁদের ভাষা। কুয়াশার ভেতর শিরশিরে হাওয়াদের ভাষা। যেন আলো। ভাষার আলো। এই ভাষা গোপন কোনও শিলালিপিতে কেউ লিখে রেখে গেছে কোথাও। মানুষ তার হদিশ জানে না। কেবল কেউ কেউ টের পায় লুপ্ত হয়ে যাওয়া সেই শিলালিপি থেকে ছড়িয়ে পড়ছে আলো, যা এক সময় মানুষেরই ছিল, ভাষা হয়ে তার সঙ্গে সঙ্গে।

আমি শুনতে পাই নীরবতার মতো সেই ভাষা। আমি দেখতে পাই কুয়াশা আর চাঁদের ভেতর থেকে ছড়িয়ে পড়ছে আলো, লুপ্ত হয়ে যাওয়া ভাষার আলো। কেঁপে ওঠে আমার চোখের পাতা। আমার মনে হয়, মৃত্যু কোনও আড়াল তৈরি করে না। যে রকম ভাষা। অনেক অনেক আগে, মানুষের জীবন-যাপনের শুরু থেকে কত শব্দ কত ভাষা কত কুয়াশা পৃথিবী ঘিরে রয়েছে; অথচ এই আমি কী এক নদীর তীরে দাঁড়িয়ে তাদের ফিরে পাচ্ছি। যেন আমি এই সব কিছুর সঙ্গে ছিলাম।

এ রকম এক কুয়াশার রাতে মারা গেছিলেন আম্মা। উঠোনে পেতে রাখা খাটিয়ায় ঘুমিয়ে ছিলেন তিনি। মধ্যরাত। খাটিয়া ধরে বসে আছি আমি। ঝিঁঝি ডেকে যাচ্ছে লিচুগাছ তলায়। ফোঁটা ফোঁটা শিশির গলে পড়ছে খাটিয়ার ওপর। চেয়ে আছি আমি আম্মার মুখের দিকে। কখনও কখনও কুয়াশা ঢেকে দিচ্ছে তার মুখের অবয়ব। আর তখন আমার ঘুম পেতে থাকে। গাঢ় ঘুম। কুয়াশার ভেতর তলিয়ে যেতে যেতে ফের জেগে ওঠে আমার চোখ। আমি দেখতে থাকি রাত্রি কী রকম রহস্য ছড়িয়ে দিতে পারে।
একটি শরীর আমার সামনে। এই শরীর আমার জননীর। এই শরীরের ভেতর থেকে আমার জন্ম। অথচ এই শরীর এখন আর মূল্যবান নয়। কিছু সময় পর মাটির ভেতর চলে যাবে। তারপর পচন ধরবে। উৎসব হবে মাংসখেকো পোকাদের। কী দাম তবে শরীরের!
আমি চোখ তুলে চেয়ে দেখি চারপাশ।

আমার গলার ভেতর বহু শতাব্দির কুয়াশা জমে গেছে যেন। কাঁদতেও পারছি না। কেবল খুঁজতে থাকি স্পন্দন। শরীরের স্পন্দন। জীবনের স্পন্দন। শরীর জেগে থাকে কী দিয়ে? আমি খুঁজতে থাকি এ রকম কিছু।
মরতে আমার খুব ভয়। দেখো কোনওভাবে আমাকে বাঁচানো যায় কীনা।

টলতে টলতে উঠে দাঁড়াই আমি। শরীর মরে গেলেও আমি তো জানি, ভাষারা মরে না কখনও। কুয়াশার ভেতর দিয়ে দূরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে, মরতে আমার খুব ভয়...। এই ভাষা মরেনি। এই ভাষা আম্মার। বলেছিলেন আব্বাকে। আব্বা তখন আম্মার একটা হাত ধরে বসেছিলেন। মৃত্যুর সপ্তাহ খানেক আগে। আমরা তো জানি, তিনি মরবেন। দুটো কিডনি যার অকেজো তিনি কোন শক্তি নিয়ে বেঁচে থাকবেন পৃথিবীতে?
স্পন্দন জেগে ওঠে আমার শরীরে। হাড়ের ভেতর ঢুকে গেছে শৈত্য। তবু আমি শুনতে পাই চেতনার ওপার থেকে আম্মার কণ্ঠস্বর, মরতে আমার খুব ভয়। দেখো কোনওভাবে আমাকে বাঁচানো যায় কীনা। আমার এখন, এই মুহূর্তে ঘুম ঘুম পেতে থাকে। ভাবতে থাকি, আমার জননী তবে কে? যে শরীর এক যুগ আগে কমরপুরের মাটির নিচে রেখে দেয়া হয়েছে সে শরীর, নাকি এই ভাষা, যে ভাষা কখনও মরে না।

আরও ঘোলাটে হয়ে গেছে চাঁদ।
অন্ধকার এখন ছাইরঙা।
পৃথিবীর গহ্বর থেকে যেন উঠে এসেছে এই দৃশ্য। যে দৃশ্যের মুখোমুখি এই মুহূর্তে আমি। আর নিজেকে একজন সাক্ষিগোপাল ভাবতে পারা ছাড়া আমার কোনও অবলম্বন নেই। আমি কেবল নীরবতার মধ্যে একমাত্র মানুষ, যে জেনে গেছে সময় বলে মানুষের যে ধারণা তা আসলে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য তৈরি করা হয়েছে। এক একটি কালখণ্ড চিহ্নিত করে সভ্যতার ইতিহাস রচনা করে মানুষ। তবে কোনও অর্থেই সেই ইতিহাস মানুষের নয়, একটি সময়ের। মানুষের ইতিহাস কোনও বিশেষ সময়ের নয়, মানুষের ইতিহাস অনন্ত। মানুষ সৃষ্টির আগের ইতিহাসও মানুষের। যখন আত্মা সৃষ্টি করা হয়। পৃথিবী থেকে যখন মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে তারপরও মানুষের ইতিহাস থেমে থাকবে না। সে ইতিহাস শরীরী মানুষের নয়, মানুষের আত্মার ইতিহাস। সে ইতিহাস মানুষ লিখতে পারবে না। সে ইতিহাস পড়ার পাঠকও থাকবে না। কিন্তু সৃষ্টি হতে থাকবে নতুন নতুন ইতিহাস।
ছায়া ছায়া অন্ধকার ফিকে হতে থাকে। কুয়াশার ভিজে ভিজে গন্ধ সেই অন্ধকারে মিলেমিশে ঘিরে ফেলে আমাকে। আমি এই মুহূর্তের ইতিহাস নির্মাতা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। কেননা আমি জানি, মানুষের ভবিতব্য বলে কিছু নেই। যা ঘটে তার সবই আগে থেকে ছক করে রাখা। কেবল মানুষ জানে না তা।
আমার শীত করতে থাকে। খুব বেশি শীত করতে থাকে। দাঁত কপাটি লেগে যেতে পারে, তারপরও দাঁড়িয়ে রয়েছি আমি। এই অন্ধকার এই কুয়াশা এই নদী আর ওই চাঁদ আমার অস্তিত্ব, অস্তিত্বের অনুভূতির সঙ্গে একাত্ম এই মুহূর্তে।

মনে হলো, দেখলাম যেন, একজন নদীর ভেতর কুয়াশার আয়না থেকে বেরিয়ে এলো। কী রকম আলো ছড়িয়ে পড়ল তার শরীর থেকে। আমি চেয়ে রইলাম। ঠিক বোঝা যাচ্ছে না তার অবয়ব। তবে সে আসছে, হেঁটে আসছে আমার দিকে। ভেজা ঘাসের ওপর দিয়ে পা ফেলে সে হেঁটে আসছে। দুলে ওঠে আমার শরীর। তার পায়ের শব্দ যেন সেতার। বেজে যাচ্ছে প্রতি পদক্ষেপে। এ রকম কেউ হেঁটে আসে না কারও দিকে। আমার দিকে আসছে। আমি শুনতে পাচ্ছি মূর্ছনা। আমার শরীরের ভেতর শিরশিরে হাওয়া ঢুকে যাচ্ছে। তারপর ঘুরছে তারা। এইবার সেতার নয়, বাঁশি। কোনও পাহাড় চূড়ো থেকে কুয়াশার ভেতর দিয়ে ঢেউ তুলতে তুলতে বেজে চলেছে আমার ভেতর। বুঝতে পারি, আমার ভেতর তবে আমি একা নই। আরও কেউ আছে। যে সেতার বাজায়। বাঁশি বাজায়। হাওয়া ঘুরতে ঘুরতে কেবল সম্মোহিত করে তাকে।

তার অবয়ব কিছু বোঝা যায় এবার। নারী শরীরের অবয়ব। আমি কাঁপতে থাকি শীতে। আর আমি কাঁপতে থাকি সুরের ঝিরিঝিরি সম্মোহনে। সে দাঁড়ায় এসে আমার সামনে। কথা বলে না। আমিও। চেয়ে থাকি আমরা পরস্পরের মুখের দিকে। গন্ধ পাই কী এক ফুলের। এই ফুল কোথায় ফুটে রয়েছে আমি জানি না। কুয়াশার ফুল হতে পারে। এই নারী, যে এইমাত্র কুয়াশার আয়না থেকে নেমে এসেছে আমার সামনে, বয়ে আনতে পারে সে গন্ধ। আমি জানি না। তবে শ্বাস নিই টেনে। বুকের খুব ভেতরে তুলে নিই গন্ধ। আর তখন সে বলে, কী, শীত করছে খুব? এই কথা, এই যে সে বলল, এটা কি কোনও ভাষা? ব্যাকরণ আছে এ ভাষার? মানুষের ভাষার তো ব্যাকরণ থাকে। তবে পাহাড় থেকে যে ঝরনা নেমে আসে, তার যে ভাষা সে ব্যাকরণ তো মানুষ তৈরি করতে পারেনি। তার কথা সে রকম কোনও সুর ছড়িয়ে দিল আমার ভেতর। আর আমি কাঁপতেই থাকি।

সে আরও এগিয়ে এলো। হাত ধরল আমার, তুমি তো কাঁপছ খুব। কী করছ এখানে, এই শীতে? আমি কথা খুঁজে পাই না। যে কথা মুখে বলা যায়। তবে কথা অনেক ভাবে আমার ভেতর তৈরি হচ্ছে, আমার অনুভূতির সঙ্গে সঙ্গে। তাকে বলতে পারি, তোমার জন্যে। অথবা বলতে পারি, আমি জানি না কেন দাঁড়িয়ে রয়েছি। তাকে বলা যেতে পারে, আমার তো এখানেই দাঁড়িয়ে থাকার কথা। এর কোনও একটি কথা তাকে বললে সে সেই কথার পর তার কথা বলবে অথবা আচরণ করবে। এই জায়গা থেকে আমার আর তার গল্প বদলে যেতে পারে। একটি কথার লেজ ধরে। আমি কথা না বলে চুপ করে চেয়ে রইলাম তার দিকে। চুপ থাকার অবস্থা থেকেও গল্প তৈরি হলো। সে আমার হাত ছেড়ে নির্নিমেশ চেয়ে রইল কুয়াশার চুড়োয়।

আমি ডাকলাম, মধুরিমা চ্যাটার্জি।
সে হেসে উঠল, কে মধুরিমা চ্যাটার্জি?
মধুরিমা চ্যাটার্জি তুমি।
সে আবার হেসে উঠল। খিলখিল হাসি। খিলখিল হাসি। আর আমি দেখতে পেলাম অন্ধকারের ভেতর ঝড় উঠল। শুনতে পেলাম ঝড়ের শব্দ শোঁ শোঁ নয়, খিলখিল খিলখিল। বয়ে যাচ্ছে ঝিরিঝিরি। সে বলল, আমি মধুরিমা চ্যাটার্জি নই।
আমি বললাম, তুমিই মধুরিমা চ্যাটার্জি।
কিন্তু আমার নাম তো...
যাই হোক, তুমিই মধুরিমা। তুমিই মধুরিমা চ্যাটার্জি।

তার চোখে বিস্ময়। তার চোখে প্রশ্ন। কুয়াশা আর অন্ধকারের ঘেরাটোপেও প্রশ্নচিহ্ন কেবল তার সৌন্দর্যের আলোতেই আমি দেখতে পেলাম।
সে জিগেশ করল, কে এই মধুরিমা?
আমি বললাম, কেউ না। তুমিই মধুরিমা চ্যাটার্জি।
পাগল! সে হেসে ওঠে না এবার। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরে। তার ঠোঁট রক্তাভ। এবার আমি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। সানাই বেজে চলেছে কোথাও। ফুলের গন্ধ কোত্থেকে যেন বয়ে নিয়ে এসেছে এই নারী। আমি ভোরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছি। রক্তের মতো আভা ছড়িয়ে দিয়ে সূর্য চলে আসছে পৃথিবীতে। তারপর আস্তে-ধীরে দৃশ্য বদলে গেল। তার ঠোঁট আমার চোখের সামনে। শিশিরে ভিজে পদ্ম-পাপড়ির রঙে আলো ছড়াচ্ছে। কেঁপে কেন ওঠে না ওই নদী। পদ্ম-পাপড়ির নদী। তবু আমি জানি, মাংসের এক টুকরো ওই আলো। আকৃতিতে যা ঠোঁট। ভেজা আর নরম।
আচ্ছা, মানুষ উপমা ব্যবহার কেন করে? আমি জানি না। তবে ভেবে বলে দিতে পারি, পৃথিবীর কোনও ধারণা মানুষ এককভাবে পেতে পারে না। অন্য কোনও কিছুর সঙ্গে তার ধারণা মিলিয়ে নিতে হয়। তবেই তার ধারণা কিংবা বস্তুর সৌন্দর্য বিশিষ্ট হয়ে ধরা দেয় তার কাছে। এককভাবে কোনও বস্তুই বিশিষ্ট হয়ে উঠতে পারেনি মানুষের পৃথিবীতে।    
কাঁপুনি কমেছে? ঠোঁট নড়ে ওঠে তার। প্রায় ফিসফিসিয়ে বলে সে। আমি কথা বলি না। এই ভাষায় যে কথা বলতে পারে সেই মধুরিমা চ্যাটার্জিকে আমার মনে পড়ে। সে নারী কে আমি যদিও জানি না, তবে আমার মনে হয় তাকে কখনও পেলে বলতে হবে মধুরিমা চ্যাটার্জির এই গল্প।

মধুরিমা চ্যাটার্জির নিবাস কোথায় আমি সে খবর রাখি না। কেবল এই নারীকে দেখেই আমার মনে পড়ল মধুরিমা চ্যাটার্জির কথা। মধুরিমা চ্যাটার্জি নামে এক নারীর অবয়ব আমার মনে এলো।
চাঁদের ঘোলাটে রঙ কেটে গেছে।
তাকে দেখা যাচ্ছে আরও পরিষ্কার। সে বলছে, তুমি তো কাঁপছে এখনও। এই ঠাণ্ডায় কেউ বের হয় এভাবে?
তুমি কেন বের হয়েছে?
বাহ রে, তুমিই তো ডাকলে।
মিথ্যে কথা। আমি তো তোমাকে ডাকিনি।
বলছি ডেকেছো। না ডাকলে আমি এলাম কেন বলো তো?
আশ্চর্য, আমি আবার কখন তোমাকে ডাকলাম?
কোনও না কোনওভাবে আমাকে ডেকেছো। না হলে এলাম কী করে?

মধুরিমা চ্যাটার্জি যা বলছে তা যদি সত্যি হয়, আমি তো তবে সত্যিই তাকে ডেকেছিলাম। না হলে হুদাহুদি সে কেনই বা আসবে। তারমানে আমি নই, অন্য কেউ আরও একজন এই দৃশ্য তৈরি করেছে। যে দৃশ্যের মুখোমুখি এসে আমি দাঁড়াবো, আর সে এসে দাঁড়াবে আমার মুখোমুখি।
তুমি কিন্তু ভীষণ কাঁপছো। তার গলায় আমার জন্যে সহানুভূতি। কে এই নারী, আমার জন্যে কিসের এত আকুলতা তার? আমি পাহাড়ের উঁচু থেকে যেন ডাক দিলাম, মধুরিমা...। সে তার শরীর থেকে চাদর খুলতে খুলতে বলল, বলেছি তো মধুরিমা নই।
তবে কে?
আমার নাম মোসাম্মত শারমিন আক্তার লাভলি। সে হেসে উঠল আবার। আর আমি দেখতে পেলাম আশ্চর্য এক ঝরনা। পৃথিবীর অনেক উঁচু থেকে যার প্রপাত হচ্ছে। আমার অনুভূতির বাইরে আশ্চর্য এক সুর ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। আমি বুঝতে পারলাম না এই সুর আশ্চর্য ঝরনার নাকি মোসাম্মত শারমিন আক্তার লাভলির অথবা মধুরিমা চ্যাটার্জির।
সে তার চাদর জড়িয়ে দিল আমার শরীরে। কুয়াশার মতো ভেজা ভেজা গন্ধ চাদরে। যেন ফুলের। কুয়াশার ফুল। এই নারী কুয়াশার ভেতর দিয়ে এসেছে। সে পরে আছে শাড়ি। যে রকম পরে থাকে গেরস্থ বাড়ির বউয়েরা। আলো তার শরীরে। এই আলো সৌন্দর্যের। চাঁদের ঘোলাটে আলোর ভেতরও আলাদা ভাবে চেনা যায়।
সে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, শীত করছে এখনও?
আমি বললাম, না। তবে কেবল জমে যাচ্ছি।
কেন?
তুমি কুয়াশার ভেতর দিয়ে এসেছো বলে।
আর তুমিও তো দাঁড়িয়ে ছিলে কুয়াশার ভেতর।
তুমি গন্ধ পাচ্ছ?
কিসের গন্ধ?
কুয়াশার ফুলের।
সে তো সব সময়ই পাই। তুমি এখন পাচ্ছ বুঝি?
হ্যাঁ, পাচ্ছি। তারপর আমি হঠাৎ করেই বললাম, আচ্ছা, এই নদীটার নাম কী?
লাভলি বলল, দরবেশ শাহি নদী।
মজার তো।
হ্যাঁ মজার। দরবেশ শাহি নদী নামটা মজার।
কে এই দরবেশ?
কেউ হবে একজন।  
ইয়ার্কি নয়, তুমি জানো এই নদীর গল্প? কীভাবে একটা নদীর নাম দরবেশ শাহি হয়ে যায় সেই গল্প আমি শুনতে চাই।
তোমার জীবনে গল্প আছে না?
আছে তো। অনেক অনেক গল্প আছে।
সে সব গল্প থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছো?

আমি ধন্দে পড়ে যাই। কেউ কী সত্যি সত্যি কোনও গল্প থেকে বেরিয়ে আসতে পারে? পারে না। না পেরেও ঢুকে যায় আরও আরও গল্পে। এ রকম এক একটি গল্পের ভেতর দিয়েই বুঝি মানুষের মিলে যাওয়া।
আমি বললাম, কেউ বেরিয়ে আসতে পারে না। কেননা তাকে আরও আরও গল্পের জন্য অপেক্ষা করতে হয়।
সে আবার আমার হাত ধরে, তুমি কোন গল্পের জন্যে অপেক্ষা করছ?
জানি না। তবে হয়তো তোমার গল্পের জন্যে দাঁড়িয়ে ছিলাম এখানে।

সে এবার একটু চাপ দেয় আমার হাতে। বলে, চলো তবে, তোমাকে দরবেশ শাহির কথা বলব। কীভাবে এই নদীর নাম দরবেশ শাহি নদী হয়ে গেল সেই গল্প বলব।  
আমার কনিষ্ঠা আঙুলে তার একটি আঙুল বেষ্টন করে আছে। আমি তার চোখের দিকে তাকাই। উচ্ছ্বলতা। উজ্জ্বলতার রঙ চাঁদের বিপরীতে। তার ঠোঁট আবারও কেঁপে ওঠে, চলো। তিরতির করে কাঁপতে থাকে আমার আঙুল। আমিও বেড় দিয়ে ধরি তার আঙুল।
আমরা ঢালু দিয়ে একটু এগিয়ে পানির কাছাকাছি গিয়ে বসলাম। কনকনে হাওয়া। নিথর হয়ে আছে নদী। গাঢ় কুয়াশার নিচে বরফের মতো ধোঁয়া ওঠা পানি। কুয়াশার ধোঁয়া।
 
শাড়ি দিয়ে শরীর ভালো মতো ঢেকে বসল মধুরিমা। আমি পা ছড়িয়ে তার পাশে। অদ্ভুত শীতলতা ছড়াচ্ছে সে। এই দরবেশ শাহি নদী আর তার তীরে এই যে কুয়াশা, সবই বুঝি তার শীতলতা থেকে তৈরি হচ্ছে। আমি হাত ধরলাম তার। সে চেয়ে রইল দূরে। কুয়াশার ভেতর কিছু কি খুঁজে পেয়েছে সে? যদিও সে, আমি জানি, কুয়াশার আয়নার ভেতর দিয়ে আমার কাছে এসেছে। আমার মনে হলো, আয়নার ভেতর আরও কারও কারও মুখ হয়তো সে হারিয়ে এসেছে। সে সব মুখ এখন পেতে চেষ্টা করছে।
কেবল আলতো করে ধরে রইলাম তার হাত। টের পেলাম আঙুল কাঁপছে তার। আর তারপর সে মুখ ফেরালো আমার দিকে। নিথর চোখের পাতা। চেয়েই রইল আমার মুখের দিকে। যেন অনেক দূরের পাহাড় থেকে সে ধ্যান করছে। আমি ডাকলাম, মধুরিমা।
খিলখিল হাসি। খিলখিল হাসি।
আমি একটু চাপ দেই তার হাতে, হাসছ কেন মধুরিমা?
আমি লাভলি। মোসাম্মত শারমিন আক্তার লাভলি।
দরবেশ শাহি নদীর গল্প বলো লাভলি।

হাসি থামে তার। আমার তালুর নিচ থেকে তার হাত তুলে রাখে আমার হাতের ওপর। বলে, সময় হচ্ছে দুশো হিজরি। বাগদাদ নগরী। তখনকার সম্ভ্রান্ত বাগদাদ। জ্ঞান আর বিজ্ঞানে সভ্যতা ছড়িয়ে দিচ্ছে পৃথিবী জুড়ে। এই নগরীর পশ্চিম কোণে থাকতেন এক বুজুর্গ। খোদাবন্দ এক দরবেশ। নাম আব্দুল¬াহ আবু ইন্দোলুস। বারো হাজার তার মুরিদান। খানকাহ শরিফ ভক্ত আশেকানে মুখরিত। এই আব্দুল¬াহ আবু ইন্দোলুস একদিন সফরে বের হলেন কিছু মুরিদান সঙ্গে নিয়ে। হাঁটতে হাঁটতে একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে চলে এলেন। আসর নামাজের সময় হয়ে এলো। চারদিকে মাঠ আর মাঠ। ওজুর পানির অভাব দেখা দিল তাদের মধ্যে। খুঁজতে খুঁজতে তারা একটি বস্তি আবিস্কার করল, যেখানে একটি ইঁদারাও রয়েছে। ইঁদারা থেকে কয়েকজন রমণী পানি তুলছে। ইন্দোলুস দেখলেন, এদের মধ্যে এক কিশোরী রয়েছে। কিশোরীর মুখের দিকে তাকাতেই ঘোর লেগে গেল তার। কাঁপুনি ধরে গেল বুকের ভেতর। চোখ নামিয়ে নিলেন তিনি। ওই জ্যোতি তার চোখ সহ্য করতে পারছে না। রমণীদের তিনি বললেন, আমরা মুসলমান। ওজু করার জন্য আপনাদের কাছ থেকে পানি চাই। এক রমণী বলল, নিন না। দুজন মুরিদান এগিয়ে গেল। তিনি এবার বললেন, আপনাদের সঙ্গে এই কিশোরীর পরিচয় কী? জবাব পাওয়া গেল, আমাদের কবিলার সরদারের মেয়ে।
ইন্দোলুস বললেন, সরদারের মেয়ে বাদির মতো ইঁদারা থেকে পানি তুলে নিয়ে যাচ্ছে। এ রকম হয় কখনও?
সেই রমণী বলল, জ্বি হয়। আমাদের সরদার খুব নীতিবান। তিনি চান তার কন্যাও সংসারের সব কাজ করবে। আর সবাই যে রকম করে।
আমি দেখতে থাকি মধুরিমা চ্যাটার্জিকে। সে বলে যাচ্ছে গল্প। কথার সঙ্গে তার ঠোঁট ওঠানামা করছে। হাতও কখনও কখনও তুলছে। চওড়া কপালের একদিকে চাঁদের ফিকে আলো, আর দিকে ছায়া ছায়া। সে কথা বলছে আর তার অজান্তেই ছড়িয়ে পড়ছে তার সৌন্দর্য। সে বলে যাচ্ছে, নামাজ শেষ হলে ইন্দোলুস মুরিদানদের বললেন, বাবারা, তোমরা যাও। আমি এখানেই থেকে যাব।
মুরিদানরা তো চমকে উঠল। প্রশ্ন করল, কেন?

ইন্দোলুস জবাব দিলেন, কেন তার জবাব আমার জানা নেই। তবে মনে হচ্ছে এখানেই থেকে যেতে হবে আমাকে। আহত হলো মুরিদান সকলে। খোঁজ নিয়ে তারা জানল, বস্তির মানুষগুলো ইহুদি। শুকর পালন করাই তাদের জীবিকা। মুরিদানদের মধ্যে ছিলেন হযরত শিবলী নোমানী। আরেক বুজুর্গ। তিনি ধন্দে পড়ে গেলেন হুজুরের এই আচরণে। কিন্তু বেশি আগ্রহ দেখালেন না বেয়াদবি হবে মনে করে। ফিরে এলেন তারা। থেকে গেলেন ইন্দোলুস। এ পর্যন্ত বলেই থামল মধুরিমা। একটু পর বলল, শীত কমেছে একটু?
আমি তার হাতের ওপর আঙুল বোলাতে বোলাতে বললাম, ইন্দোলুস কি করলেন এরপর?
এক বছর পর শিবলী নোমানী ও কয়েকজন মুরিদান এলেন সেই বস্তিতে। বস্তির রমণীদের কাছে জানতে চাইলেন হুজুরের কথা। তারা জানালো, পুবদিকের মাঠে কিছু দূর গেলে তারা তাদের হুজুরের সাক্ষাৎ পাবে। মাঠে গিয়ে তারা দেখল, যে লাঠির ওপর ভর দিয়ে হুজুর জুম্মার খুতবা দিতেন সেই লাঠিতে থুতনি রেখে তিনি বিষণœ মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। আর তার চারদিকে শুকরের দল চড়ে বেড়াচ্ছে। কেঁদে উঠল ভক্ত আশেকান। হুজুর বললেন, কেঁদো না। মনে রেখো, মানুষ জন্ম নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটি অদৃশ্য বই ধরিয়ে দেয়া হয় তার হাতে। মানুষ নিজের মুখ আয়না ছাড়া যে রকম দেখতে পারে না, তেমনই সে কখনও জানতেও পারে না কী লেখা আছে সেই বইতে। সে বেড়ে ওঠে নিজের নিয়তি সঙ্গে নিয়েই। মরেও যায়। আমিও জানি না আমার জীবনে এরপর আর কী কী ঘটতে পারে। তোমরা যাও। আর এসো না।
ফিরে চলল তারা। হাঁটতে হাঁটতে এসে পৌঁছোলো এক নদীর তীরে। জোহর নামাজের সময় তখন। আশ্চর্য হয়ে তারা দেখল, নদীর ভেতর থেকে গোসল দিয়ে উঠে আসছেন আব্দুল¬াহ আবু ইন্দোলুস। বিস্ময়ের ঘোর কাটতে না কাটতেই ইন্দোলুস তাদের বললেন, সবাই ওজু করে নাও। জামাতে নামাজটা আদায় করে নিই। সকলে ওজু করে এলো। দীর্ঘদিন পর নামাজ আদায় করল তারা হুজুরের পেছনে। সকলের ভেতর ফিরে এসেছে উৎসব উৎসব প্রাণ। হুজুরকে সঙ্গে নিয়ে তারা ফিরে এলো খানকায়।  
থামল মধুরিমা। চেয়ে রইল আমার মুখের দিকে। চোখের পাতা কাঁপছে তার। ঠোঁট কাঁপছে তার। কাঁপছে আমাদেরর ঘিরে থাকা কুয়াশা আর চাঁদের নরম আলো। কাঁপতে কাঁপতে আমি জিগেশ করলাম, তারপর বলো কী হলো, বলো।

মধুরিমা বলল, ঠিক তিনদিন পর ফজরের নামাজ শেষ করে ইন্দোলুস বসেছেন মুরিদানদের নিয়ে। একজন এসে খবল দিল, বোরখায় ঢাকা এক রমণী এসেছে তার সঙ্গে দেখা করতে। তিনি নিয়ে আসতে নির্দেশ দিলেন। রমণী এলো। সালাম জানিয়ে মুখের পরদা তুলে দাঁড়ালো দরবারের এক পাশে। চমকে উঠলেন ইন্দোলুস। চমকে উঠে মুুরিদানরা দেখল, সরদারের মেয়ে। ইন্দোলুস উঠে দাঁড়ালেন। তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো বিস্ময়ের স্বর, তুমি!
কিশোরী বলল, আপনি চলে আসার পর থেকে দারুণ পেরেশানিতে ছিলাম। কিচ্ছু করতে পারতাম না। ঘুমোতেও পারতাম না। গতরাতে একটু তন্দ্রার মতো এসেছিল। স্বপ্নে দেখলাম, একজন এসে আমাকে বললেন, তুমি হুজুরের কাছে যেতে চাও?

আমি বললাম, আপনি যাবেন আমাকে নিয়ে? তিনি বললেন, চোখ বন্ধ করে আমার হাত ধরো। আমি তার হাত ধরতেই তিনি হাঁটতে আরম্ভ করলেন। কিছু সময় পর বললেন, চোখ খোলো। আমি চোখ খুললাম। তিনি আঙুল তুলে বললেন, ওই যে দেখছ খানকাহ, ওখানে যাও, তোমার হুজুরকে পাবে। তাকে গিয়ে বলো, খিজির তোমাকে পৌঁছে দিয়ে গেছে। তাকে আমার সালাম জানিও।
কিশোরীর কথা শেষ হতেই নৈঃশব্দ্যের ভেতর ডুবে গেল চারদিক। ইন্দোলুস নেমে এলেন দরবার থেকে। কিশোরীকে নিয়ে একটি বাড়িতে রাখলেন। এবং বললেন, আট বছর আমাদের দেখা হবে না। তুমি যদি সত্যিই আমাকে মোহাব্বত করে থাকো তবে এ শর্ত তোমাকে মানতে হবে।
শর্ত মেনেছিল ইহুদি কিশোরী?

ঘাড় নেড়ে লাভলি বলল, হ্যাঁ মেনেছিল। আট বছর পর ইন্দোলুস গেলেন তার কাছে। দীর্ঘ সময়। কত কিছু বদলে গেছে বাগদাদে তখন। কত কিছু ঘটে যেতে পারে এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে। খোদার ইশকে দেওয়ানা ইন্দোলুস এই সত্যি টের পেলেন তখন যখন তিনি এসে দাঁড়ালেন কিশোরীর সামনে। না, ভুল বললাম। কিশোরী তখন সে আর নেই। বরং বুড়ি বলা যায়। কোথায় সেই সৌন্দর্য। কোথায় সেই চোখ। আর কোথায় বা সেই সময়। পেরিয়ে গেছে যে আট আটটি বছর। তার চোখ দিয়ে রক্তের মতো ধারা গাল বেয়ে নামছে। পরকাল থেকে যেন কথা বলে উঠল রমণী, কাঁদতে কাঁদতে আমার চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। আমার তো এখন কিছুই নেই। সৌন্দর্য নেই। আলো নেই। যে কোনও সময় আমার এন্তেকাল হতে পারে। তবে কি মিলন আর হবে না...
ইন্দোলুস তখন কাঁদছেন। রমণীর হাত ধরে কাঁদছেন। বললেন, হবে। খুব শিগগিরই আমাদের মিলন হবে। তিনি ফিরে এলেন খানকায়। ভোররাতে খবর পেলেন অভাগীর ইন্তেকাল হয়েছে। সেদিন ছিল জুম্মাবার। খুতবা দিতে দিতেই ইন্তেকাল করলেন ইন্দোলুস।
আমি দেখতে পেলাম একজন ব্যর্থ মানুষের মৃত মুখ। আমি দেখতে পেলাম একজন পবিত্র মানুষের মৃত মুখ। শাদা পোশাকে তার শরীর ঢেকে মুরিদানরা ঘিরে রয়েছে। মধুরিমা ফিসফিসিয়ে বলল, কিছুদিন পর শিবলী নোমানী স্বপ্নে দেখলেন, হুজুর আর সেই রমণী জান্নাতের বাগিচায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। খুব হাসিখুশি দেখাচ্ছে তাদের। নোমানী জিগেশ করলেন, হুজুর আপনি পার্থিব জগতে যাকে গ্রহণ করেননি, তাকে নিয়ে এই জগতে বেশ আনন্দে আছেন, এর রহস্য কি?

ইন্দোলুস তাকে জানালেন, ইঁদারা থেকে ওজুর পানি নেয়ার সময় আমি প্রথম এই রমণীকে দেখি। আর দেখার সঙ্গে সঙ্গে আমার ভেতর কী যেন হলো। আমি ঝলসে গেলাম তার সৌন্দর্যে। প্রকাশ্য সৌন্দর্যের এত উদ্ভাস আমি তো আর দেখিনি। তাই আমি ওই বস্তিতে শুকর পালনের কাজ নিই। কিন্তু তোমরা যখন আবার এলে, আমার মনে হলো, যে সৌন্দর্য দেখা যায় তার আলো যদি এ রকম হয় তাহলে যে সৌন্দর্য দেখা যায় না তা কেমন? আমি সারা জীবন যে সৌন্দর্যের ধ্যান করে এসেছি তা তো আরও মহৎ। তাই ফিরে এলাম তোমাদের কাছে। যখন আবার মেয়েটি আমার খানকায় এলো তাকে প্রত্যাখান করতে পারলাম না। কিন্তু তার সৌন্দর্য আড়াল দিয়ে রাখলাম আমার ভেতর। আমি মশগুল আরেক সৌন্দর্যে।
এইখানে আমি মধুরিমাকে বললাম, পার্থিব জগতের বাইরে কোনও অপ্রকাশ্য সৌন্দর্য নেই। সবই দেখা যায়। অনুভব করা যায়। সৌন্দর্যে চোখ ধাঁধিয়ে গেলেও কেউ বলে না, এতে বাধা-নিষেধ আছে।
হ্যাঁ, পার্থিব জগতের মানুষেরা এই কারণে ইন্দোলুস আর ইহুদি কিশোরীর গল্পের ভেতর ঢুকে গেল। এই যেমন তুমি ঢুকে গেলে এইমাত্র। আর তাই এই কাহিনি ছড়িয়ে পড়ল বাগদাদে। যে নদী থেকে গোসল দিয়ে খোদার ইশকে ফিরে এসেছিলেন ইন্দোলুস এই সেই নদী। মানুষেরা ভালোবেসে নাম দিয়েছে দরবেশ শাহি নদী।
আর আগের নাম? আমি প্রশ্ন করে বসি।
সে তো আরেক নদীর গল্প। গল্পেরা তো এভাবেই বেঁচে থাকে। একটার ভেতর আরেকটা। আরেকটার ভেতর আরও একটা।
তোমার কী মনে হয়?
কী?
ইন্দোলুস আর ইহুদি কিশোরীর ব্যাপারটা।

ইন্দোলুস খোদার ইশকে ঢেকে ছিলেন পা থেকে মাথা তক। এই ইশক কিন্তু চর্চার ফলে মানুষের ভেতর তৈরি হয়। পৌত্তলিক কিশোরীর সৌন্দর্য দেখে যে ইশকে তিনি বিভোর হয়েছিলেন তার জন্যে কোনও রকম চর্চার দরকার হয় না। এই ইশকই মানুষের প্রবৃত্তি।
তবে তো এই গল্পের ট্রাজেডি মানুষের প্রবৃত্তি আর ধর্মের দ্বন্দ্ব।
আসলে কোনও গল্পেরই ট্রাজেডি বলে কিছু নেই। মানুষের জীবনেও নেই। যা মানুষের জীবনে থাকে না তা মানুষের গল্পে কী কারণে থাকবে?
তারমানে আমার তোমার কোনও ট্রাজেডি নেই?
না, নেই। আমাদের যা গল্প সব আগে থেকেই লেখা। আমরা গল্পের চরিত্র হয়ে এক একজন অভিনয় করছি, মানুষ যাকে বলে জীবন।
আমি বিড়বিড় করি, এই নদী তো আমি চিনি। আগেও এসেছি আমরা।
আমরা? ঠোঁট বেঁকিয়ে মধুরিমা তাকালো আমার দিকে।
হ্যাঁ, আমি আর তুমি। আগেও এসেছি এই নদীর তীরে। কত বার। তুমিই তো ছিলে আমার সঙ্গে।
মধুরিমা এবার ঘোলাটে চোখে তাকায় আমার দিকে। ফাজলামি হচ্ছে? কবে আবার আমরা এলাম এখানে...
এসেছি। তার প্রমাণ আছে আমার কাছে।
কি প্রমাণ?

আমি পকেট থেকে বের করলাম একটা কাগজ। আমার লেখা কবিতা। কবে যে লিখেছিলাম মনে নেই। তবে এই আমিই লিখেছিলাম। এখন মনে পড়ছে, এই নদীর তীরেই আমি আর মধুরিমা কোনও এক জীবনে এসে বসতাম। সেই কথা আমি লিখেছি আমার কবিতায়।
কি কাগজ এটা?
কবিতা।
তুমি লিখেছ?
হ্যাঁ। পড়ে দেখো, এই নদীর কথা লেখা আছে কবিতায়। লেখা আছে তোমার আর আমার কথা।
খিলখিল হাসি। খিলখিল হাসি।
কী, বিশ্বাস হচ্ছে না?
তুমি চেনো আমাকে?
কী এক ঘোরের ভেতর থেকে আমি বলে উঠি, তুমি মধুরিমা চ্যাটার্জি। আমি তোমাকে চিনি।
কিন্তু আমি তো কুয়াশার ভেতর দিয়ে এসেছি তোমার কাছে।
মানুষের জীবনে সব সম্পর্কই কুয়াশার ভেতর দিয়ে আসে। সব সম্পর্কই অস্পষ্ট। ধোঁয়া ধোঁয়া। বোঝা যায় না কোনও সম্পর্কই। অথচ মানুষ ভাবে, কত সহজ তার সঙ্গে আরেকজনের সম্পর্ক।
এ রকম ভাবলেই তো বেঁচে থাকা সহজ হয়ে যায়।

তাই তো বেঁচে থাকে মানুষ। কিন্তু যখন সে বুঝতে পারে, যখন সে টের পায়, এক মানুষ থেকে আরেক মানুষ কী আশ্চর্য রকমের আলাদা; তখন কি আর বেঁচে থাকা সহজ থাকে?
তারপরও তো মানুষ বেঁচে আছে।
হ্যাঁ, বেঁচে আছে বলেই মানুষ সৌন্দর্য খোঁজে। শরীরের সৌন্দর্য। সম্পর্কের সৌন্দর্য। এ জন্যেই আমি কবিতা লিখেছি।
আশ্চর্য চোখে সে তাকায় আমার মুখের দিকে।
আমি বলি, হ্যাঁ, দরবেশ শাহি নদী আর তোমার আমার কবিতা। তোমার আমার সম্পর্কের কবিতা।
মধুরিমা আমার হাত থেকে কবিতা নিয়ে পড়তে থাকে :

মাঠ পেরোলে ছিপছিপে এক নদী

বেদে নাই যার রূপ লেখা
পাবে সামান্যে কী তার দেখা...
                   মহাত্মা লালন

মাঠ পেরোলে ছিপছিপে এক নদী
আমরা শুধু সন্ধেবেলা এসে
বসেই থাকি, মধ্যরাত অবধি।

নিশ্বাসে কি ভাষা থাকে              দীর্ঘশ্বাসে বর্ণ
মুখ ফোটেনি গোপন কথায়         মন তবু উৎকর্ণ।

আমরা শুধু মাঠ পেরিয়ে            এই নদীটার তীরে
বসতে পারি, বসেই থাকি            নির্জনতা ঘিরে।

মাঠ পেরিয়ে নদীর কাছাকাছি        শরীর নিয়ে আমরা বসে আছি
শরীর খুবই ছেলেমানুষ, তাই         দুই হৃদয়ই একটা হয়ে যায়।

একটা হলেও হৃদয় দুটো             মানুষ যে আলাদা
দুই হৃদয়েই কাটাকুটি                 আমরা দেখি শাদা।

এই নদীটা আড়াল খুবই              এই নদীতে ভোর
হলেই আড়াল ভেঙে যাবে           তাই কাটে না ঘোর।

মাঠ পেরিয়ে সন্ধেবেলা এসে
                           আড়াল হয়ে যাই দুজনে ভেসে

মাঠ পেরোতে হঠাৎ যদি               কেউ তোমাকে ডাকে
চলেই যাবে, আড়াল ভেঙে            আরেক নদীর বাঁকে?