মাতৃভূমির মুক্তির লড়াইয়ের বিরত্বগাথা ‘পিতৃগণ’

কৃষ্ণ তিলক

প্রকাশিত : জুলাই ২৫, ২০১৯

স্বজাতি স্বদেশভূমির মুক্তি ফিরিয়ে আনার জন্য যুদ্ধে যাবার আগে বরেন্দ্রির ভূমিপুত্র নেতা কৈবর্ত রাজা ভীমের প্রার্থনা—

‘পিতৃগণ, আমরা আজ তোমাদের সেই হাতের স্পর্শ কামনা করি। যে হাত মাটির বুক খুঁড়ে সবুজ শস্যশিশুদের পৃথিবীতে এনেছে, আবার জোড়করে স্তব করেছে মৃত্তিকার; যে হাত বনের বুক থেকে ছিনিয়ে এনেছে বাসের বসত আর চাষের মাটি; যে হাত বনের শিকার এনে তুলে দিয়েছে শিশুদের মুখের গ্রাস; যে হাত প্রাচীর তুলে ঘরের নিরাপত্তা দিয়েছে উত্তরপুরুষকে আবার তার জন্য অবারিত করে দিয়েছে দিগন্তের অধিকার; যে হাত রক্তাক্ত হয়েছে হলকর্ষণে; যে হাত রুধিরাক্ত হয়েছে মাটির অন্ধকার রহস্য উন্মোচন করে লোহার আকরিক নিষ্কাশনে; যে হাত হাতুরির ঘাত প্রতিঘাতে কাঁচা লোহাকে দিয়েছে কাস্তের স্বরূপ; যে হাত সুরক্ষা দিয়েছে কৌমের নারী শিশু বৃদ্ধদের; যে হাত শিশুদের মাথার চুলে আর কৃষ্ণকালো পৃষ্ঠত্বককে অশেষ স্নেহ বিলিয়েছে স্পর্শের জাদু দিয়ে; যে হাত শৃঙ্খলিত হয়েছে কিন্তু শৃঙ্খল ভাঙার প্রতিজ্ঞা থেকে বিচ্যুত হয়নি কোনোদিন; যে হাত অতীতের দিকে আঙুল তুলে মনে করিয়ে দিয়েছে সাম্যের কথা; যে হাত ভবিষ্যতের দিকে আঙুল তুলে বলেছে মুক্তির কথা!

মাতৃগণ, আমরা আজ তোমাদের সেই হাতের স্পর্শ কামনা করি যে হাত আমাদের শৈশবকে রক্ষা করেছে আর কৈশরকে দিয়েছে সুরক্ষা; যে হাত ঝিনুকে ঝিনুকে আমাদের মুখে তুলে দিয়েছে প্রাণের স্পন্দন; যে হাত আমাদের হাসি দেখে টেনে নিয়েছে বুকে; যে হাত চিরকাল নিভিয়ে এসেছে কৌম পুরুষদের পেটের আগুন; যে হাত তিথি ও পরবে আল্পনা এঁকে স্বাগত জানিয়েছিলো ওলান ঠাকুরকে; যে হাত সন্তান ও কৌমের মঙ্গলকামনায় বারবার জোড়কর হয়েছে মাতৃদেবীর উদ্দেশ্যে; যে হাত শুশ্রুষা হয়েছে, হয়েছে আশ্রয় আর অনন্ত ক্লান্তিহরণী; যে হাত অনন্তকালব্যাপী অন্নযোগানি; যে হাত শত্রুহস্তে নিহত পুত্রের শব বুকে নিতে নিতেও আরেক পুত্রকে পাঠিয়েছে যুদ্ধক্ষেত্রে; যে হাত কৌমের জীবনকে শ্রীময়ী করেছে চিরকাল; যে হাত ঝড়ের মুখে কৌমের করঞ্জদীপকে ঘিরে রেখে দূর করেছে অন্ধকার ভীতি, যে হাত বুক ফেঁড়ে নিজের হৃৎপিণ্ড তুলে দিয়েছে সন্তানদের মুক্তি কামনায়; যে হাত অগ্নিশয্যাকে বারবার পরিণত করেছে পুষ্পসয্যায়!

হে আমার বরেন্দির মাটি ছুঁয়ে বয়ে যাওয়া রাতের বাতাস! আমাদের পিতৃ-মাতৃগণের শেষ নিশ্বাস মিশে আছে তোমার শরীরে। তুমিই তো সেই নিশ্বাসগুলি আবার বহন করে আনো আমাদের বুকের ভিতরে, দিয়ে যাও বরাভয় আশীর্বাদ! হে বায়ুদেবতা তুমি আমাদের বুকের মধ্যে পিতৃগণের সাহসের বরাভয় সঞ্চারিত করো অবিরাম। আমার সাথীদের জানাও তাদের পিতৃপুরুষ কোনো কাপুরুষ ছিলো না! আমার সাথীরা জানুক তাদের পিতৃপুরুষ কোনোদিন ন্যায়যুদ্ধে পরাজিত হয়নি। আমাদের মাতৃগণের সকল নীরব প্রার্থনা তুমিই ধারন করেছো হে বায়ুদেব! তুমি তো জানো, গর্ভকালে তারা কী প্রার্থনা জানাতেন দেবতার কাছে। তুমি তো জানোই হে বায়ুদেব আমাদের মাতৃগণ কখনো চাইতেন না কোনো দাসের গর্ভধারিণী হতে! তুমি আমাদের সাথীদের বলো তাদের পিতৃ-মাতৃগণের প্রতিজ্ঞা প্রার্থনার কথা।

তোমাকে শৃঙ্খলামুক্ত রাখার জন্য যে সন্তানরা একত্রিত হয়েছে, মাতা তুমি তাদের পায়ে দাও লৌহস্তম্ভের দৃঢ়তা, শত্রুর সহস্র আঘাতও যেন তাদের টলাতে পারে না একচুলও। তোমার সন্তানের জয় মাগো তোমারই জয়, তোমার সন্তানের অপমান তোমার অপমান। সেই অপমান নিয়ে তাদের যেন তোমার বুকে বিচরন করতে না হয়...’

না, এ কোনো রাজাধিরাজ এর বাগড়ম্বর উচ্চবাক্য নয়, এ কোনো নষ্ট ক্ষমতালিপ্সু রাজনীতিকের চাটুবাক্য নয়। নিজের প্রতিশ্রুতি রাখতে আজীবনের জন্য ভূমিদাস হিসেবে আত্মবিক্রয় করে ঋন শোধ করে তবু অন্যের কাছে করুণা দাবি করে না যারা, প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করা, মিথ্যে বলা আর অন্যজাতির কাছে নিজের দুর্বলতার কথা বলার চেয়ে জীবন দেয়া শ্রেষ্ঠ মনে করে যারা, সবকিছু আমার নয় আমাদের মনে করে যারা প্রয়োজনের বেশি চাহিদার কথা ভাবতে শেখেনি যারা সেই কৈবর্ত জাতির শ্রেষ্ঠসন্তান ভীমের একান্ত প্রণতি। যে কৈবর্তরা জানে না কেমন করে অপরকে ঠকাতে হয়, প্রতারণা করতে হয় লাঞ্ছনা করতে হয়, কেমন করে অপরের কাছে ছোট হতে হয়। কিন্তু আর্য বহিরাগত সামন্ত মহাসামন্তরা তাদেরই মাটিতে অমানুষের মতোন তাদের নিগ্রহ করছে যা ন্যায় নয়, এটি তারা ঠিক বুঝতে পারে। তাই তো তারা সেই ন্যয়যুদ্ধে নিজেদের স্বাধীনতার যুদ্ধে দিব্যোকের সাথে একাত্ম হয়। দিব্যোক, একটা ছোট প্রদেশের অমাত্য। কিন্তু যার দৃঢ়তা ব্যক্তিত্ব আর আর মাতৃভূমির প্রতি নিষ্ঠার কাছে নত হয়ে আসে পাল সাম্রাজ্য। অভিভূত হয়ে যায় প্রতিপক্ষও। তাইতো ভয়ে কাপুরুষতায় কূটচাল চেলে পেছন থেকে অতর্কিতে আক্রমণ করে কিন্তু তাতে কি ভূমিপুত্রদের হারানো যায়! তারা যে ন্যায়ের লড়াইয়ে মাতৃভূমির মুক্তির লড়াইয়ে নেমেছে। জয় তাদেরই হয়।

আর তারই উত্তরপুরুষ ভীম। যার যোগ্যতা দক্ষতা বুদ্ধিমত্তা ভালোবাসায় হাসতে হাসতে জীবন দিতে পারে ভূমিপুত্ররা। এমন একজন নেতার সঙ্গে স্বাধীনতার লড়াইয়ে গর্বে আকাশছোঁয় চিরশোষিত কৈবর্তসন্তানদের বুক। বীরদর্পে এগিয়ে যায় শক্তিশালী কূটকৌশলী রামপালের সসস্ত্র সৈন্যের দিকে। সমরাস্ত্র তাদের যতই কম থাকুক ফিরেও আসে বিজয়ী হয়ে কারণ তারা ন্যায়ের যুদ্ধে নেমেছে নিজেদের মাতৃভূমি আর স্বজাতিকে মুক্ত করার জন্য। নেমেছে যারা তাদের থেকেই তাদের অধিকার কেড়ে নিয়ে শোষন আর অন্যায়ের রাজ করতে চায় তাদেরই বিরুদ্ধে!

এ কাহিনি বলার মতো কোনো অলংকার নেই। কবি পপীপের মতোই লেখনি ফেলে শুধু অবাক মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে হয় যে যুদ্ধের দিকে, যে যুদ্ধের নেতা ভীমের দিকে যে যুদ্ধের বীরসেনানী সেনাধ্যক্ষ মল্লর দিকে। যে যুদ্ধে পপীপের মনে পরে যায় প্রেয়সী কুরমির কথা কিন্তু তার আগে এরকম একটি যুদ্ধে সর্বাত্মক অংশগ্রহণ করে মাতৃভূমিকে মুক্ত করে তবেই বিজয়ীবেশে তার কাছে ফিরতে হবে। অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করে কবি পপীপ। আবার তাঁবুতে ফিরে সেই কাহিনির বীরগাথা লিখে চলে রাত জেগে জ্ঞানসাধক মূর্খ জাতির আলোকবর্তিকা পপীপ। এ যুদ্ধ ন্যায়ের নিষ্ঠার, এর বিজয় নিশ্চিত তা যেমন কবি পপীপ জেনে গেছে তেমনি শত্রুপক্ষও জেনে গেছে। তাইতো চিরাচরিত অন্যায় কাপুরুষতা আর প্রতারণার মধ্য দিয়ে নিজেদের দেয়া শর্ত নিজেরাই ভেঙে অতর্কিতে হামলা চালায় রাতে ঘুমন্ত সৈন্যদের ওপর। ভীম ও তার সৈন্যদের মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েও যারা বুঝতে পারে তারা আসলে জেতেনি। সমগ্র রাজ্যের মানুষের সামনে মৃত্যুঞ্জয়ী বীর ভীমের ধিক্কার বিদ্রুপ ঘৃণার কাছে হেরে যায় ঘৃণ্য প্রতারক রামপাল, ধরাশায়ী ভীমই যেন জিতে গেছে এ যুদ্ধে। শুধু বরেন্দ্রি নয় গোটা সাম্রাজ্য যেন রামপালের প্রতারণায় নিচুতায় মাথা হেট করে রাখে। বাতাস তার কানে ধিক্কার দিয়ে যায়, তাকে রাজা বলে অস্বীকার করে।

একুশে বইমেলা ২০১৮