মানবিক সম্পর্কের গল্প ‘অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগ’

উম্মে ফারহানা

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৯

মেহেদী উল্লাহর চতুর্থ গল্প সংকলন ‘অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগ’ প্রকাশিত হয়েছে ২০১৯ অমর একুশে গ্রন্থমেলায়, ঐতিহ্য থেকে। প্রচ্ছদ করেছেন ধ্রুব এষ। মোট নয়টি গল্প নিয়ে সাজানো এই সংকলনের গল্পগুলোকে বলা হচ্ছে প্রেমের গল্প। তবে আমার মতে, এগুলো মানবিক সম্পর্কের গল্প। কিংবা বিশেষায়িত করতে চাইলে বিচ্ছেদের গল্প। সেই বিচ্ছেদ হতে পারে প্রেমিক প্রেমিকার, হতে পারে স্বামী স্ত্রীর, আবার সন্তানের সঙ্গে পিতামাতার বিচ্ছেদও পাওয়া যায়।

বাবা মারা যাবার পর সন্তানদের স্মৃতিচারণের মতন প্রচণ্ড তীব্র অনুভূতির রকমফেরগুলিকে লেখক লিখেছেন অসাধারণ নির্লিপ্ততায়। কিছু গল্পের শিরোনাম ইংরেজিতে, যেমন `কালার হাউজ, সেনসেশন আউট, গ্রিন লাভ ইন, দ্য সানি এক্সপেরিমেন্ট। খুবই লক্ষ্য করার মতন ব্যাপার হলো, গল্পগুলো পড়লে মনে হবে না যে, এই গল্পের কোনো বাংলা নাম কেন হলো না, শিরোনাম চয়নে দক্ষতার ছাপ পাওয়া গেল।

মেহেদী উল্লাহর এই গ্রন্থের গল্পগুলোতে যেমন আছে এই সময়ের মানুষের যাপনের বিভিন্ন মাত্রা, তেমন আছে তাদের মনস্তত্বকে ধরার এবং কিছুটা ব্যাখ্যা করার প্রয়াস। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, `বর্ষার স্মার্টফোন জলে ডুবে গেল` গল্পের বর্ষা কেন স্মৃতি জমিয়ে রাখতে ভালোবাসে এই লাইনে তার একটা উত্তর দিয়েছেন লেখক, কিংবা উত্তরের ছলে প্রশ্ন তুলেছেন পাঠকের সামনে।

চরিত্রগুলোও বিভিন্ন ধরণের। যেমন `কাননে কালা কুত্তা` গল্পের মেয়েটি (ন্যরেটর) যেমন শরতচন্দ্রের নায়িকাদের মতন অপরাধী স্বামীর প্রতি ভালোবাসাকে ভক্তির পর্যায়ে নিয়ে গেছে, `অনুমেয় উষ্ণ অনুরাগ` গল্পের ন্যরেটর আবার ছয় প্রেমিকের সঙ্গে চালিয়ে যাচ্ছে খোলামেলা প্রেম, তার কোনো লুকোছাপা নেই তার বহুগামিতার ব্যপারে।

যে গল্পটির কথা না বললেই নয়, `অবশিষ্ট জীবনাংশে মৃত্যু ব্যথিত প্রাণ`। পিতার মৃতদেহের পাশে বসা কন্যার স্মৃতিচারণের নির্মোহ বর্ণনা যতটা অসাধারণ , আয়রনিক্যালি, ততটা আবেগী আর কিছুই নেই এই গ্রন্থে। আবার `কালার হাউজে`র ন্যারেটরকে এত চমৎকারভাবে বুঝেছেন লেখক, যেভাবে তারই জবানিতে বলেছেন তার গল্পটা, তা অত্যন্ত চমকপ্রদ।

পেশায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মেহেদী উল্লাহ প্রাপ্তবয়স্কদের ছবির অভিনেত্রী থেকে হিন্দি ছবির নায়িকা হওয়া সানি লিওনিকে নিয়ে এই প্রজন্মের উচ্ছ্বাস নিয়ে লিখেছেন আত্মবিশ্বাস নিয়ে, এই আত্মবিশ্বাস তার স্বভাবজাত । `জায়া-পতির তালা-চাবি`তে এসেছে নাগরিক দম্পতিদের পরকীয়ার বিনিময়ে হলেও সংসার টিকিয়ে রাখার ভয়ানক প্রচেষ্টার করুণ চিত্র। সুধাকে যখন সুনীতি জিজ্ঞেস করেন `তোমার স্বামী তোমাকে মারে কেন?`, সুধা নির্বিকারে উত্তর দেন, `আমি মারি না বলে`। আবার `দুর্দান্ত নীল মত্ততা`য় নারীর প্রেম, বিবাহের আকাঙ্ক্ষা আর সমর্পণকেও সন্দেহ করা হয় প্রচণ্ড পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিতে দেখে।

`সেনসেশন আউট, গ্রিন লাভ ইন` গল্পে অজাচারে জড়ানো ছেলেটি নিজেকেই বোঝায় সমাজে আর সকল অনাচার কত স্বাভাবিক, কেন শুধু অজাচারকেই পাপ হিসেবে ধরতে হবে?

`দুর্দান্ত নীল মত্ততা`য় নায়িকা দিলরুবার নাম রেললাইনের আশপাশে বলাতে আমার মনে পড়েছে `দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা` গানটি, সবার মনে পড়বে কিনা জানি না,তবে এটা ছাড়াও আরো বহু চমক রয়েছে মেহেদী উল্লাহর এই গল্পগুলোতে। মেহেদী উল্লাহর জন্য সর্বাঙ্গীন শুভকামনা।

একুশে বইমেলা ২০১৮