মাসুদ পথিকের কবিতাগুচ্ছ

প্রকাশিত : নভেম্বর ২০, ২০১৯

নব্বই দশকের মেধাবী কবি মাসুদ পথিকের আজ জন্মদিন। নরসিংদী জেলার রায়পুরায় ২০ নভেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রকাশিত বইগুলো হচ্ছে, কৃষকফুল, বাতাসের বাজার, ধানের গ্রীবার নিচে কিছু অভিমান, ধানচোর, চাষার পুত, চাষার বচন, দাদার খড়ম, লাঙলের ভূবন, একাকী জমিন, চাষার কাম, ক্লাসের বাইরে থেকে জেনেছি এই কৃষকজন্মের কারিকুলাম, ধানবাজারে এইসব নন্দনবেপারি অ্যান্ড নিউ কলোনিয়াল কোলাহলসহ মোট একুশটি বই।

মাসুদ পথিক পরিচালিত চলচ্চিত্র গুলো হচ্ছে, নেকাব্বরের মহাপ্রয়াণ ২০১৪, আলোর পথের সারথি ২০১৬ এবং মায়া-দ্য লস্ট মাদার ২০১৯। চলচ্চিত্রে ছয়টি জাতীয় পুরস্কারসহ মোট ১২টি পুরস্কার পেয়েছেন। কবিতায় পেয়েছেন কালি ও কলমসহ সাতটি। মাসুদ পথিকের জন্মদিনে ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছাস্বরূপ তার একগুচ্ছ কবিতা:


ধান ও রূপকথা

না, কখনো যাইনি ফেলে, তোকে
উবু হয়ে আছিস বুকের গহীনে, আর সুগভীরে
বিলের তলার শেষ কাদা যেমন থাকে গুতুম মাছ বুকে

অথবা, বসতঘরের পিছদড়ায় বুড়ো মটকির ভেতর
খই রাখার পূর্বে মা, গায়ে ঘি মেখে শুকিয়ে নেয়, রোদে

নে, শুঁকে দেখ পলি পীড়িত এই দেহ, তোরই গন্ধমাখা
আর কাদার সুবাস করে উতলা
এইভাবে নবান্নের শব্দ হয়, ভাতের ঘ্রাণমাখা!

কখনো মধ্যরাতে সম্পর্কের বাতি নিভে এলে
তোর কোমল দেহ খুলে করি পাঠ, আর
সুবর্ণ অতীতে সমকালীন বর্ণের বীজ বুনি
যদি প্রচল বাক্যের ফলন হয় খুব করে
যদি মাঠের ধারণার ‘পর ফলে সমূহ ফল
সুকল্পিত নক্ষত্রলোকের ওই সুদর্শন কোনো!

ধীরে অথবা ধীরে, ভোরের আলোক রশ্মির পাড়ে
রূপশালি ধানক্ষেত, আহা দোলে!
ফলে, যাইনি ফেলে, নিজেকে।
তথাপি দোলে মায়ের কুলোর ‘পর নেচে ওঠে প্রিয় ধান
আউশ আমন জমজ বোন, কিংবা
রূপশালি নামে, গায়ের চঞ্চল মেয়েটি

যাইনি যে ছেড়ে বঙ্গ, সমতট
আজও উবু হয়ে বোরোক্ষেতে কাঁদাখোঁদা যেন
চোখ মুঝে খুঁটে খাই মননের আহার
হেঁটে না-হেঁটে ব্যথিত সময়ের দু`পাড়

দূর, তারকা খচিত উপায়ে উপায়ে পোয়াতি রাত
আলোচিত সন্তান কার? রূপকথায় যাপিত মেটাফর!

অথবা অথবা আজ, এই নিহিত সিনট্যাক্সের ঘরে
যৌথসংসারে
আমিও জন্মাই প্রতিবার হারানো ধানের স্বরূপে সরূপে

যাইনি ফেলে মিথের মধুমাস, চুষে খাই সব সুধা
খুলে জীবনের সমূহ লোনসাম
চাষার এই ধরাধাম, আহা!

সাইলপরাঙ্গী

অথবা, অথবা ইনিয়ে বিনিয়ে নিজেকেই খুঁজতে হয়,
আজও, বাড়ি ফিরে আসেনি আমি`টা
আমার কূল-গোত্র অজানা, যদিও

কেবল ধান-চালের মর্মার্থ ভেদ করে আমার সময়
ছুটে গেছে ক্ষীণ হয়ে আসা মাঠের পানে

গভীর রাত, অন্ধকারে যায় না দেখা
আপন পদচিহ্ন, প্রতিচ্ছবি
তবুও, তবুও কৃষিজীবির সংসারে ভাতের অভাব হলে,
হা-ভাতে কিংবা আকালে
খুব তীব্র হয়ে ওঠে সুদূর অতীত

অতীত! খুঁজতে বের হই আমরা
মৃত দাদা, বাবা এবং আমি অন্ধকারের এই আলধরে
উঁচুনিচু গল্পগুলো কুয়াশায় ম্লান হয়ে আসে খুব

কুয়াশার নিদ্রা ভেঙে ভেঙে আমরা, খুঁজি নিজেকে
কঙ্কাবতী ও ডালিমকুমার পালিয়ে গেছে যে হাওয়ায়
উঁচুনিচু গল্পের পাড়ায়, সারারাত

শব্দ যেমন খুঁজে ফেরে ধ্বনি, আর দিকহারা বাক্যকে
আনন্দ ও বেদনায় মাখা বর্ণমালা
ক্ষুধার্তের আত্মপরিচয়ের ভেতর এই কাঁদাকাদা, থরথর

আটকে যায় পা, আটকে গেছে, তাজ্জব অনুসন্ধান
এমন যাত্রাপথ সমূহ রহস্য নিয়ে
নিজের দিকেই বাঁক, আর থমথমে ধানের গ্রীবার নিচে
আছে আমার সমূহ কূল-গোত্র লুকিয়ে...

স্মরণ করো

 

স্মরণ করো, আমি সেই ভূ-পতিত আম, কি নই?
যে গড়িয়ে, আর না-গড়িয়ে চলে গেছে নিচু ডোবার ভেতর

তোমরা সকলেই শৈশবে বিভোর করো লড়াই
তাকে পাবার জন্য প্রাণপণ

সকলই দৃশ্যমান হয় আজ ডোবার চারধারে
কিছু তিলঘুঘুর গান, এবং রাতকানা বকের পায়চারি

স্মরণ করো, এই রোগমুমূর্ষু দেহ পড়ে আছে
অদৃশ্য হাসপাতালের বারান্দায়, হেঁটে যায় রমণীয় নার্স

আর ডাক্তার, দৃশ্যমান আমের ঝুড়ি হাতে আসে সজন
অনেকের, আমি ব্যথায় গড়িয়ে গড়িয়ে নেমে যাই ডোবায়

কেউ নেই হাত ধরে টেনে তোলবার
তবুও আমার স্বপ্নগুলো বুকে করে রেখে আসি হাসপাতালের শয্যায়

যদি কেউ, যদি কোনও মা স্বর্বস্ব হারানো
দুপুর হারানো শালিকের মতো ঠোঁটে নেয় কুড়িয়ে

কিংবা কোন নিঃসঙ্গ প্রেমিকার ভাঙা মনে হয় দয়া
আমার হাতের তালুতে পেয়ে যাই রোগীর জন্য আনা ফল,
বেদনায় গোল হয়ে ওঠা আপক্ব আম, স্মরণ করো ইতিহাস!

বিরহ নির্মাণ

তো, বিরহ নির্মাণ শিখে গেছি আমি
আমার ব্যথারা যখন ভালোবাসাগামী

বকের ঠোঁট থেকে ঝরে ব্যথিত জলাশয়
বিরহ গহীনে বিদ্ধ মাছ— কেবলি তড়পায়

বক

বৃষ্টি ভেজা ভোরে
ভেজা পালক
ভাতশালিকের সুরে
করলি মৃদু নক
আমায় একটা প্রেমের গান ছুঁড়ে
তলিয়ে নিলি তোর জৈব-অন্তপুরে

তবে, আমায় দে-না ওই কদমচূড় ধান
আমায় দে একটা দোয়েল পাখির গান

ভিজে ভোরে আমার দোয়েল হবার শখ
নয়তো তোর বুকের ভেতর শাদা কোনো বক

থরে বিথরে

তোর স্পর্শের ঘরে
আহা থরে বিথরে
জমা হলো অনুভব
মনো-দৈহিক কলরব

তোর ভেতর মুখরিত শালিকের গান
ঝরা পালকে উড়ে যায় সব পিছুটান

কাঁদায় লেপেছো ঘরের দেয়াল
কাদায় মেখেছে স্মৃতির খেয়াল