‘এ সুইটেবল বয়’র একটি দৃশ্য

‘এ সুইটেবল বয়’র একটি দৃশ্য

মাহবুব মোর্শেদের গদ্য ‘এ সুইটেবল বয়’

প্রকাশিত : ডিসেম্বর ৩১, ২০২০

নব্বই দশকজুড়ে ইংরেজি ভাষায় লেখালেখি করা ভারতীয় লেখকদের নিয়ে বিস্তর আলোচনা শুনতাম। আলোচনার শীর্ষে ছিলেন সালমান রুশদী ও অরুন্ধতী রায়। তাদের সঙ্গে একঝাঁক লেখকের নাম শোনা যেত। অমিত চৌধুরী, অমিতাভ ঘোষ, বিক্রম শেঠ, অনিতা দেশাই, ঝুম্পা লাহিড়ী, উপমন্যু চ্যাটার্জি, জিৎ থাইল, অরবিন্দ আদিগা, শশী থারুর, কিরণ দেশাই, পঙ্কজ মিশ্রসহ অনেক নাম অহরহ আসতো।

এদের সূত্র ধরে আর.কে নারায়ণের মতো লেখকরা ফিরে আসতেন। ভারতীয় ইংরেজি সাহিত্য যে ভিএস নাইপল পর্যন্ত বিস্তৃত, সে কথাও আমরা বলতাম। কেউ কেউ বলতেন, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার পর একটা ইন্ডিয়ান লিটারারি বুমের মুখোমুখি হতে চলেছি আমরা। ইউরোপ আমেরিকা হয়ে যেভাবে আফ্রিকান ও লাতিন আমেরিকান সাহিত্যের সেরা লেখকরা সারাবিশ্বের নানা ভাষায় পঠিত ও সমাদৃত হয়েছেন, সেভাবে ভারতীয় সাহিত্যও পঠিত হবে। সিনেমার ক্ষেত্রে যেভাবে ইরানি ও কোরিয়ান চলচ্চিত্র বিশেষ অভিজ্ঞতা হয়ে আছে, সেভাবে ভারতীয় সাহিত্যেরও কদর তৈরি হবে।

একটা কন্টিনেন্টাল শিফটের অপেক্ষায় ছিলাম আমরা। কেননা এই শিফটটা ঘটলে শুধু ভারতীয় সাহিত্য নয়, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের ইংরেজি ভাষার সাহিত্যের বাজার তৈরি হতো। আমাদের দেশের ইংরেজি ভাষার লেখকদের মধ্যে এক ধরনের নতুন চর্চা শুরু হয়েছিল। মনিকা আলী বেশ আলোড়ন তুলেছিলেন। কে আনিস আহমেদ ও তাহমিমা আনামসহ নানা লেখকদের আমরা পেতে শুরু করেছিলাম। কিন্তু পুরো প্রক্রিয়াটা কোথায় যেন থমকে গেল।

আমার মনে হয়, ইউরোপীয়-আমেরিকান পাঠকদের মনোযোগ যখন পড়তে শুরু করেছিল তখন ভারতীয় সাহিত্য নিজেকে পুরোটা তুলে ধরতে পারেনি। এর প্রাচুর্যটা পুরোপুরি উপস্থাপিত হয়নি। ভারতীয় ভাষাগুলোর সেরা লেখাগুলো অনুবাদ করে প্রকাশ করা জরুরি ছিল। বইয়ের বাজারে যোগানও পর্যাপ্ত ছিল না। যাই হোক, এখন ফোকাসটা সেভাবে আর ভারতীয় সাহিত্যের ওপর নেই। ভারত-কেন্দ্রিক এক ধরনের ইংরেজি সাহিত্যচর্চা চলছে বটে, কিন্তু এর বৈশ্বিক গুরুত্ব আর তেমন নেই।

কিন্তু বেশ কিছু লেখককে সে সময়ের আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে আমরা চিনতে পেরেছিলাম। স্টোরিটেলার হিসেবে সালমান রুশদী একটা নতুন অভিজ্ঞতা হিসেবে হাজির হয়েছিলেন। অরুন্ধতীয় রায়ও চমকে দিয়েছিলেন। এদের পাশাপাশি অমিতাভ ঘোষ ও ঝুম্পা লাহিড়ী বেশ খানিকটা পঠিত হয়েছেন। কিন্তু বাকি লেখকরা সেভাবে ততটা সমাদর আমাদের দেশে পাননি বলেই মনে হয়।

যেমন বিক্রম শেঠ। বিক্রম শেঠের নাম তখন বেশ আলোচিত হতো। তার এ সুইেটবল বয়কে কোথাও একবার তলস্তয়ের ওয়ার অ্যান্ড পিসের সঙ্গে তুলনীয় হতে দেখেছিলাম। সত্যি কথা বলতে, উপন্যাসে রুশ লেখকদের দমের সঙ্গে অন্য কোনো ভাষার কোনো লেখকেরই তুলনা চলে না। উপন্যাসে রুশ লেখক আলাদা একটা জাত। ফলে, তুলনাটা তখন ভালো লাগেনি।

তবে বিক্রম শেঠের দম যে অনেক, সেটা বোঝা গিয়েছিল। ১৩-১৪ শ পৃষ্ঠার উপন্যাস লিখে প্রশংসিত হওয়া কম কথা নয়। কিন্তু সে সময় উপন্যাসটা অন্য অনেক উপন্যাসের মতো পড়তে পারিনি। এখন মিরা নায়ারের কল্যাণে উপন্যাসের চিত্ররূপ দেখলাম। সিনেমা নয়, ওয়েব সিরিজ হিসেবে। মিরা নায়ার আমার প্রিয় নির্মাতা। সালাম বোম্বে, মিসিসিপি মাসালা ও কামসূত্র দিয়ে তিনি অনেক আগেই আমাদের মন জয় করেছেন। নেমসেক ও মুনসুন ওয়েডিংয়ের কথাও বিশেষভাবে মনে পড়ে। এবার যখন শুনছিলাম মিরা সুইটেবল বয় বাানাচ্ছেন, তখন থেকে বেশ অধীর অপেক্ষাতেই ছিলাম। নেটফ্লিক্সে আসায় বেশ সুবিধাই হলো।

অ্যাডাপটেশন উপন্যাস নয়। আবার চলচ্চিত্রও নয়। আমি বলি, এটা হলো এনাদার ফর্ম অফ রিডিং। আমরা পাঠকরা পড়ি এবং মনে মনে দৃশ্যগুলো রিক্রিয়েট করতে থাকি। তেমনি একজন চলচ্চিত্রকার ক্যামেরা নিয়ে পড়তে থাকেন এবং দৃশ্যগুলো রিক্রিয়েট করতে থাকেন। সাহিত্যের পাঠকের কথাও তার মাথায় থাকে। কাহিনিচিত্র সবই। কিন্তু বিখ্যাত উপন্যাসের চলচ্চিত্রের খুব বেশি চলচ্চিত্র হওয়ার দরকার পড়ে না। এটাকে হতে হয় উপন্যাসচিত্র। মিরার চোখে বিক্রমের উপন্যাসের একটা আভাস পেলাম।

বিক্রম শেঠ খুব কৌশলী লেখক। সদ্য স্বাধীন ভারতের একটি কাল্পনিক শহরের কয়েকটি পরিবার এবং বাস্তবের কয়েকটি শহরের আরও কয়েকটি পরিবারের গল্প বলেছেন। গল্পের মূলসূত্র খুবই সরল। পিতৃহীন তরুণী লতার বিয়ে দিতে হবে। তার মা পাত্র খুঁজছেন। মোটামুটি তিনটি পাত্রের মধ্যে তীব্র লড়াই চলছে। কে লতাকে বিয়ে করবে? এই সামান্য কাাহিনির মধ্যে তিনি স্বাধীন ভারতের প্রথম কয়েক বছরের রাজনীতি, সমাজের রূপান্তর, ব্রিটিশ প্রভাব, জমিদারি ও নবাবির বিলোপ থেকে শুরু করে বহু বিষয়কে অ্যাড্রেস করেছেন। হিন্দু-মুসলিম সংকট যে কী, তা মোটামুটি পরিষ্কার করে দিয়েছেন। এ বস্তু ভারতকে কীভাবে, কেন ভোগাবে, সেটাও স্পষ্ট করেছেন।

মিরা নায়ার দেখার পর বিক্রম শেঠের এ সুইটেবল বয় পড়ার আগ্রহ হচ্ছে। এটা তলস্তয়ের সঙ্গে তুলনীয় হয়তো নয়, কিন্তু নিঃসন্দেহে ক্ল্যাসিক হবে বলেই আমার ধারণা। বাঙালি বাবু ও কলকাতার প্রতি দারুণ সব পরিহাস, কটাক্ষ আর বাণ মেরেছেন বিক্রম শেঠ। আর এসব বিষয় মিরা বেশ রসিয়ে রসিয়ে চিত্রায়ণ করেছেন। এটা বাঙালি দর্শক উপভোগ করবে বলে মনে হয়। উপন্যাসের স্বাদ ওয়েব সিরিজে মেটাতে নেটফ্লিক্সের এ সুইটেবল বয় সাহিত্যিক দর্শকরা দেখতে পারেন।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও গণমাধ্যমকর্মী