মাহবুব মোর্শেদ

মাহবুব মোর্শেদ

মাহবুব মোর্শেদের গদ্য ‘বুদ্ধিজীবিতার নতুন বিন্যাস’

প্রকাশিত : জুলাই ০৭, ২০২১

বুদ্ধিজীবিতা সম্পর্কে আন্তনিও গ্রামশি, মিশেল ফুকো, এডওয়ার্ড সাঈদ বা অন্য যে কোনো তাত্ত্বিক কী বলেছেন তার ভিত্তিতে সমাজে বুদ্ধিজীবীরা চিহ্নিত হন না। বুদ্ধিজীবী বা বুদ্ধিজীবী-স্থানীয় ব্যক্তিরা জানেন বুদ্ধিজীবিতা সম্পর্কে কার কী তত্ত্ব, সমাজে কে বুদ্ধিজীবী, বুদ্ধিজীবী হতে কী ভূমিকা থাকতে হয়। কিন্তু জনগণের যে অংশগুলো বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধিজীবী হিসেবে চিনতে পারে তাদের সবার সংজ্ঞা, প্রকারভেদ ইত্যাদি নিয়ে বিশেষ মাথাব্যথা নেই। সাধারণ মানুষ বুদ্ধিজীবীদের চিনে নেয় কাজ, কথা, লেখা, বক্তব্য, অবস্থান থেকে। এই প্রক্রিয়া অবশ্যই জটিল।

শাসকগোষ্ঠীগুলো আমাদের মতোই জানে, আধুনিক বুর্জোয়া রাষ্ট্রব্যবস্থায় বুদ্ধিজীবিতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। রাষ্ট্র চলে খুব জটিল প্রক্রিয়ায়। শাসকরা বিষয়গুলোকে আরও জটিল করে তোলেন। রাষ্ট্রের নিজস্ব মেশিনারিজ জনগণের কাছে প্রতিমূহূর্তে ব্যাখ্যা করতে থাকে যা হচ্ছে তা বৃহত্তর কল্যাণের জন্যই হচ্ছে। এর অন্যথা হলে সর্বনাশ হয়ে যেত। এই কাজে রাষ্ট্র তাদের পক্ষের বুদ্ধিবৃত্তিক মেশিনারিজ ব্যবহার করে। কিন্তু জনগণও বোকা নয়। তারা মনে করে, রাষ্ট্র যা বলছে তা সবসময় ঠিক নয়। ফলে, বিষয়গুলোর যথাযথ ব্যাখ্যা পাওয়ার জন্য তারা বুদ্ধিজীবী, বিশ্লেষক ও ভাষ্যকারদের ওপর নির্ভর করে।

এই চাহিদাই মিডিয়ার বিকাশ ঘটিয়েছে। মিডিয়ার কাজ মিডিয়েটরের। তারা সংবাদ, বিশ্লেষণ ইত্যাদি প্রকাশ করার মাধ্যমে জনগণের মধ্যে এই বিশ্বাস জন্মায় যে, তারা রাষ্ট্র বা সরকারের পক্ষ থেকে কথা না বলে জনগণের পক্ষ থেকে কথা বলছে। কিন্তু আদতে তারা কখনো সরকারের পক্ষে, কখনো কর্পোরেট স্বার্থের পক্ষে, কখনো কখনো জনগণের পক্ষেও কথা বলে। নিজেদের দরকারে মিডিয়াই বুদ্ধিজীবী তৈরি করে। বুদ্ধিজীবীও মিডিয়ার প্রয়োজনে নিজেকে নির্মাণ করতে থাকেন। কিন্তু একজন যত বড় বুদ্ধিজীবী হন না কেন, তার কথা প্রচারিত হওয়ার উপায় না থাকলে তিনি বুুদ্ধিজীবী হতে পারবেন না। ফলে, এতকাল ট্র্যাডিশনাল মিডিয়াই বুদ্ধিজীবী তৈরি করে এসেছে।

বুদ্ধিজীবী বলতে আমাদের সামনে যে চেহারা ভাসে তা মিডিয়ার তৈরি করে দেওয়া চেহারা। মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার বুদ্ধিজীবী উৎপাদন প্রক্রিয়ার বাইরেও পুরনো যুগে বুদ্ধিজীবী হওয়ার উপায় ছিল। যেমন, প্রত্যক্ষ সামাজিক যোগাযোগ, সভা-সেমিনার, বিকল্প প্রকাশনা এবং অবশ্যই নানা গণ-আন্দোলনে অংশ নিয়ে পরিচিতি ও যোগাযোগ বাড়ানো। এ প্রক্রিয়ায় বুদ্ধিজীবী হওয়া কঠিন। আর বামপন্থী রাজনৈতিক দল বা অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলে এ প্রক্রিয়াটা কাজও করে না। ফলে, ভিন্নমতাবলম্বী বুদ্ধিজীবীদের নির্ভর করতে হতো মিডিয়ার ওপরই। মিডিয়া ভিন্নমতকে যতটা জায়গা দেয় ততটা কাজে লাগিয়ে তৎপরতা চালাতে হতো।

মূল ভূমিকাটা ট্র্যাডিশনাল মিডিয়ারই। ট্র্যাডিশনাল মিডিয়া বুদ্ধিজীবীর কোন চেহারাটা আমাদের মাথায় বুনে দিয়েছে? বুদ্ধিজীবীকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে হবে। বয়সে পাকা হতে হবে। ভারী ফ্রেমের চশমা, শাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরতে হবে। বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি থাকতে হবে। ইউওরোপীয় বিদ্যা ও জ্ঞান কাঠামো সম্পর্কে বুলি আওড়াতে হবে। ক্ষমতা কাঠামোর সঙ্গে (সরকার/বিরোধী) ভাল যোগাযোগ থাকতে হবে, আন্তর্জাতিক মহলে ওঠাবসা থাকতে হবে। এই চেহারার বাইরে বুদ্ধিজীবীর কোনো ছবি সাধারণভাবে আমরা আসলেই ভাবতে অভ্যস্ত নই। আমি বলি, বুদ্ধিজীবীর এই ধারণাটা চুরমার করে দিয়েছেন আহমদ ছফা। আলোচনা আহমদ ছফা নিয়ে নয়। তাই এখন এ নিয়ে কথা বাড়াবো না।

বুদ্ধিজীবী তৈরি, বুদ্ধিজীবী চেনানো ও বুদ্ধিজীবীকে স্বীকৃতি দেওয়ার মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার ম্যাকানিজম দীর্ঘদিন ধরে আর আগের মতো কার্যকর নেই। কারণ সোশ্যাল মিডিয়ার আবির্ভাব। লোকে এখন মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার চাইতে ফেসবুক ও ইউটিউবের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশি সময় দেয়। প্রত্যেক ইনডিভিজুয়াল এখানে একটিভ থাকে। মানে তার মত, বিশ্বাস, বক্তব্য, ছবি, ভিডিও, পরিবার-পরিজন সব সহকারে। ফলে, প্রত্যেকে কোনো না কোনোভাবে স্বতন্ত্র চিন্তার ব্যক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। একজন ফেসবুক ব্যবহারকারীর কাছে ব্রাত্য রাইসু যা, মাহবুব মোর্শেদ যা, তিনি নিজেও তাই। পাশাপাশি পুরনো মিডিয়ার প্রভাবের কারণে তাদের মনে বুদ্ধিজীবীর যে চেহারা যেভাবে এঁকে দেয়া আছে তাতে বিকল্প মিডিয়ার বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধিজীবী মানতে তাদের অভ্যাসগত সমস্যাও তৈরি হয়।

কিন্তু, নিজের অজান্তে তারা ফেসবুকে যারা সচেতন বা অবচেতন প্রক্রিয়ায় বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মকাণ্ড চালায় তাদের সাবক্রাইবার হয়ে পড়ে। পরোক্ষভাবে তাদের মত পুনরুৎপাদন করে। তারা কী বলে, কোন তথ্য দেয়, কোন ব্যাখ্যা হাজির করে তা খেয়াল করে। নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তাদের ভাবায়। বলতে দ্বিধা নেই, প্রক্রিয়াটা মূলত ঘটে প্রাথমিকভাবে নাকচ করার মধ্য দিয়ে। যে চিন্তা বা ব্যক্তিকে সোশ্যাল মিডিয়ায় সবচেয়ে বেশি নাকচ করা হয় তিনিই কালক্রমে সবচেয়ে বেশি প্রভাশালী হয়ে ওঠেন। কন্ট্রোভার্সি তাকে আলোচনায় নিয়ে আসে। তার পক্ষে-বিপক্ষে লোকজন দাঁড়িয়ে যায়। আগে সাধারণের ধরাছোঁয়ার বাইরের মিডিয়া যাকে বুদ্ধিজীবী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতো তাকে মেনে নেয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকতো না। কিছু বলারও থাকতো না। মিডিয়া নিজস্ব ম্যাকানিজম ব্যবহার করে জনগণের ভক্তি আদায় করে নিতো। এখন নিউ মিডিয়ায় সেটা সম্ভব নয়। কিন্তু ওল্ড মিডিয়ার ক্রাইটেরিয়াগুলো এখনও কার্যকর আছে। পুরনো গুণগুলো নতুন যুগেও বুদ্ধিজীবী তৈরির জন্য কার্যকর।

আমরা কিছুদিন ধরে বুদ্ধিজীবিতা নিয়ে কথা বলছি। কথা বলতে বলতে খেয়াল করলাম, লোকে ফেসবুকে নতুন বুদ্ধিজীবীদের মাধ্যমে প্রভাবিত হচ্ছে ঠিকই কিন্তু তাদের বুদ্ধিজীবী হিসেবে স্বীকার করছে না। দেশে হয়তো পাকা বামপন্থী তাত্ত্বিক ও বুদ্ধিজীবী আছেন। কিন্তু তারা নিউ  মিডিয়ায় গরহাজির। বামপন্থী কথাবার্তা শুনতে তাই নির্ভর করতে হচ্ছে নতুন বুদ্ধিজীবীদের ওপর। এমনকি পুরনোদের চেনাচ্ছেনও নতুনরা। কিন্তু নতুনদের অবস্থান ও কাজকে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে না। তারা বুদ্ধিজীবীর কাজ করছেন, কিন্তু বুদ্ধিজীবী হিসেবে স্বীকৃত হচ্ছেন না। এই পুরনো ও কিছুটা এলিটিস্ট চিন্তা ভাঙার জন্য একটা তালিকা করার চিন্তা আমার মাথায় আসে।  

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দীর্ঘদিনের পর্যবেক্ষণ থেকে আমি তালিকাটি হাজির করি। যেটা আমি আমার ওয়ালে শেয়ার করি। একান্তই ব্যক্তিগত বিবেচনা থেকে বুদ্ধিজীবিতার নানা দিক থেকে যারা কাজ করছেন তাদের ধরার চেষ্টা করেছি এই তালিকায়। একটা বড় বিবেচনা ছিল, ইন্ডিভিজুয়াল হিসেবে বুদ্ধিজীবীকে চিহ্নিত করা। ধরুন, বিএনপিপন্থী একজন বুদ্ধিজীবী আমার তালিকায় স্থান পেয়েছেন। এক্ষেত্রে  বিএনপি দল হিসেবে যা বলে তা তিনি আর্টিকুলেট করতে পারেন কি না, ক্রিটিক করতে পারেন কি না, নিজস্ব মূল্যায়ন হাজির করতে পারেন কি না এটা বিবেচনায় নিয়েছি। কেননা, এটা না করতে পারেলে তিনি বুদ্ধিজীবী না হয়ে কর্মী বা সমর্থক বলে গণ্য হবেন। জনগণ তাকে বুদ্ধিজীবী হিসেবে চিনতে পারবে না।

এ তালিকার অনেকে কখনো বই লেখেননি, প্রচলতি মিডিয়ায় লেখেননি, এমনকি অনেকে একদম নাও লিখতে পারেন। কিন্তু তিনি কোনো না কোনো প্রক্রিয়ায় বুদ্ধিবৃত্তিক ফ্রেমওয়ার্কে কাজ করে নিজের মতটাকে প্রচার করতে পারছেন। কাজের এই ধরনটা বুঝতে পারাও আগামী দিনের বুদ্ধিজীবীতার বড় কাজ। নতুন একটা চ্যালেঞ্জ আমি হাজির করেছি তালিকা করার মাধ্যমে। খুব প্রত্যাশিতভাবে এটা ব্যাপক বিরোধিতার মুখোমুখি হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিরোধিতা করেই লোকে নতুন কিছুকে গ্রহণ করে। ফলে প্রতিক্রিয়ায় আমি আনন্দিত। নতুন কিছু শুরু হলো। বুদ্ধিজীবিতার নতুন বিন্যাসে সবাইকে স্বাগত।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, কবি ও গণমাধ্যমকর্মী