‘মায়ামুকুট’ সময়ের আলোকবর্তিকা

সুরাইয়া জাহান

প্রকাশিত : মার্চ ১৪, ২০১৯

স্বকৃত নোমানের উপন্যাস `মায়ামুকুট`। প্রথমেই বলি, পাঠক নামকরণের তাৎপর্য উপলব্ধি করবে উপন্যাসের শেষের অংশে। এই বইটি নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে আরো একটি কথা পাঠককে জানিয়ে রাখি, সচরাচর দেখা প্রেমকাহিনি কিংবা রহস্য উপন্যাস নয় `মায়ামুকুট`। তবে প্রেম কিংবা রহস্য যে একদমই নেই উপন্যাসে, তা কিন্তু নয়। কাহিনির স্বার্থে আর মূল চরিত্রের জীবন পথের অলিগলি পার করতে করতে পাঠক ঠিকই নানা ধন্দ আর সংঘাতে নিমজ্জিত হবে। বিষয়বস্তু নির্বাচনে লেখক অনন্য এক কৌশল বেছে নিয়েছেন যা তাকে অমর করে রাখবে সাহিত্যের ভুবনে।

এবার আসি উপন্যাসের বিষয়বস্তুতে। স্বকৃত নোমান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি রাজনৈতিক অধ্যায় তুলে ধরেছেন তার লেখনিতে। কেন্দ্রিয় চরিত্র `মুলুকচান`। আপনারা জানেন, কুখ্যাত সন্ত্রাসী এরশাদ শিকদার থেকে শুরু করে স্বপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের ফাঁসির রায় কার্যকর করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রধান জল্লাদ মুলুকচান। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের ইতিহাসের জঘন্য যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিও কার্যকর করে এ ব্যক্তি। উপন্যাসের পরতে পরতে উঠে আসে এক মুলুকচান ডাকুর মুলুক জল্লাদ হয়ে ওঠার কাহিনি।

তার দীর্ঘ জীবনের প্রারম্ভেই মুলুক অভিশপ্ত হন বাবার দেয়া অভিশাপে। ফলশ্রুতিতে নিজের পৌরুষ নিয়ে ভোগেন শঙ্কায়, হারান আত্মবিশ্বাস। সেই হারানো আত্মবিশ্বাস নিয়ে নিজেকে নিক্ষেপ করেন সময়ের কালো গহ্বরে। জীবনের প্রতি চরম অনীহা তাকে রূপান্তরিত করে দুর্ধর্ষ মুলুক ডাকুতে। মানুষের জান-মালের কোনোই মূল্য থাকে না তার কাছে। রাতের পর রাত গ্রামের মানুষ নির্ঘুম কাটায় মুলুক ডাকুর ভয়ে। অসংখ্য মামলা মাথায় নিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়ায় মুলুক। পুলিশ তাকে আটক করার পরেও বারবার জেল থেকে পালায় সে। রীতিমতন পুলিশ ডিপার্টমেন্টেও আতঙ্কের আরেক নাম, মুলুকচান।

স্বল্প পরিসরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট অঙ্কিত হয়েছে `মায়ামুকুট` উপন্যাসে। তবে যুদ্ধ পরবর্তী রাজনৈতিক নানা টানাপোড়েন উঠে এসেছে সুনিপুণভাবে। বিশেষ করে স্বাধীনতার চার দশক পেরিয়ে গেলেও যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নানান বাধার মুখে পড়ে তখন তরুণ প্রজন্ম শাহবাগে গণজাগরণের ডাক দেয়। রাতদিন এক করে তারা যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবি জানাতে থাকে। সারাদেশ একাত্মতা প্রকাশ করে এই তরুণ প্রজন্মের সাথে। সেই সময়ের সঠিক চিত্র ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের তৎকালীন এক কারারক্ষীর বয়ানের মধ্য দিয়ে স্বকৃত নোমান অন্ধকার জগতের একটি মানুষকে আলোর জগতের সন্ধান দেন। সময় যে মানুষকে বদলে দেয়, আত্মউপলব্ধি করতে শেখায়, সেটাই তিনি মনে করিয়ে দেন তার লেখনিতে— ‘মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়।’ আর ভুবন সাধুর নানান আখ্যানের মধ্যে দিয়ে নোমান তুলে ধরেছেন বাংলার সুফিবাদ।

অল্প কথায় উপন্যাসের অনন্য-অসাধারণ দিকগুলো সবতো বলা সম্ভব নয়। তবে সামান্য কিছু অসংগতির কথাও বলছি। যদিও সেটা তেমন বড় কিছু নয়। কিছু জায়গায় লেখক এক কাহিনি থেকে আরেক কাহিনিতে হুট করেই চলে গেছেন, যা মনোযোগ ধরে রাখতে কষ্ট হয়। সবশেষে বলবো, ‘মায়ামুকুট’ উপন্যাসের লেখক স্বকৃত নোমান মুক্তিযুদ্ধ এবং পরবর্তী সময়ে যুদ্ধাপরাধী রাজাকার, আলবদর বাহিনীর যেই বীভৎস বিবমিশা জাগানিয়া মুক্তিযোদ্ধা হত্যাকাণ্ডের কাহিনি বর্ণনা করেছেন সেসব বড়ই মর্মপীড়াদায়ক।

তার যা বয়স তাতে মুক্তিযুদ্ধ তিনি দেখেননি। কিন্তু গ্রন্থলব্দজ্ঞানে তিনি যথাযথ অভিজ্ঞ, সত্যিকারের একজন দেশপ্রেমিক। পরবর্তীকালে এই মানবতাবিরোধী অপরাধীদের শাস্তির দাবি কতটা যৌক্তিক ছিল, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বলতে দ্বিধা নেই, স্বকৃত নোমান অগ্রজ লেখক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, সৈয়দ হক, শহিদুল জহিরের মতন কালজয়ী লেখকদের যোগ্য উত্তরসূরি। আশা করি, ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা পাবে ‘মায়ামুকুট’।

উপন্যাসটির প্রকাশ করেছে অন্যপ্রকাশ। প্রচ্ছদ, মোমিনউদ্দিন খালেদ। মূল্য, ৪০০ টাকা।

একুশে বইমেলা ২০১৮