মিডওয়েস্ট থেকে দেখা ডেভিড ফস্টার ওয়ালেসের ৯/১১

পর্ব ১

অনুবাদ-নাদিম হায়দার

প্রকাশিত : জুলাই ০৯, ২০১৮

অক্টোবর ২৫, ২০০১ / ব্লুমিংটন, ইলিনয়
 
প্রকৃত মিডওয়েস্ট ফ্যাশন বিবেচনায় ব্লুমিংটনবাসীরা অবন্ধুসুলভ হবার কথা নয়। কিন্তু বাস্তবে এর উল্টোটাই ঘটতে দেখা যায়। আগন্তুকদের আপনার দিকে তাকিয়ে উষ্ণ হাসি দিতে দেখবেন অথচ অপেক্ষা করার জায়গা কিংবা চেকআউট লাইনে অপরিচিতদের মাঝে আলাপ-আলোচনা একেবারেই অপ্রত্যাশিত। যদিও অনেকে মিলে একই সড়ক দূর্ঘটনা চাক্ষুস করার মত এখন সবকিছু ছাপিয়ে আমাদের কথা বলার মত সাধারণ বিষয় পাওয়া গিয়েছে। উদাহরণ দিয়ে বললে, বারওয়েলের চেকআউট লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার সময় ক্যাশিয়ারদের কুঁচি দেয়া ঢিলেঢালা পোশাকের এক মহিলা এবং ডাংগারি জ্যাকেট (যার হাতা কেটে নেয়া হয়েছিলো অনেকটা ঘরে প্রস্তুতকৃত ভেস্টের মত করে) পরিহিত পুরুষকে বলাবলি করতে শুনলাম, “আমার ছেলেরা মনে করছিলো এটা ইন্ডিপেন্ডেন্স ডে’র মত কোন সিনেমা। কিন্তু এরপরই খেয়াল করলো সবগুলো চ্যানেলে একই সিনেমা দেখানো হচ্ছে”
মহিলা কিন্তু এটা উল্লেখ করেনি তাঁর ছেলেদের বয়স কত ছিলো।
 
 
বুধবারঃ
 
চারপাশে সবাই পতাকা লাগিয়েছেন। বাড়ী, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান সকলে। ব্যাপারটা অদ্ভুত ঠেকতে পারে কারণ আপনি কাউকে কখনও এসব ঝুলাতে দেখলেন না অথচ বুধবার সকালের মাঝে সবকিছু পতাকা দিয়ে ছেয়ে আছে। বড়, ছোট, সাধারণ- নানা মাপের পতাকা। এখানকার অনেক বাড়ী-মালিকের দরজার সামনে পতাকা ঝোলানোর জন্য বিশেষভাবে বানানো ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড আছে, যার মজবুত খুঁটিতে চারটে ফিলিপস স্ক্রু লাগানোর প্রয়োজন পড়ে। এছাড়াও কিছু বাড়ীর উঠনে কয়েক ডজন হাতে বহনযোগ্য (যেগুলো আপনারা সাধারণত সামরিক প্রদর্শনীতে দেখে থাকেন) পতাকা এমনভাবে পোঁতা হয়েছে, যেন সেগুলো রাতারাতি গজিয়েছে। গ্রামাঞ্চলের লোকেরা ছোট আকৃতির পতাকাগুলো রাস্তার ধারে চিঠির বাক্সের গায়ে জুড়ে দিয়েছেন। অনেক গাড়িতে এগুলো সামনের ধাতব দণ্ডে অথবা এন্টেনায় ডাক-টেপ দিয়ে এঁটে দেয়া হয়েছে। বেশকিছু উচ্চবিত্তের মানুষদের বাস্তবিক পতাকা ঝোলানোর দণ্ড আছে, যাতে তারা অর্ধনমিত করে রেখেছেন। ফ্র্যাঙ্কলিন পার্ক এবং পূর্ব দিকের বেশকিছু বহুতল ভবনের সম্মুখ দিকে ঢাউস আকৃতির পতাকা ঝোলানো হয়েছে। এরা কোথা থেকে এতবড় পতাকা সংগ্রহ করেছে এবং কি করেই বা এগুলো ঝুলিয়েছে, এও এক অমীমাংসিত রহস্য।
 
 
আমার প্রতিবেশীর (যিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক এবং সিপিএ) ঘর এবং লন রীতিমতো বিস্ময়কর ব্যাপার। এর সামনে ১৮ ইঞ্চি ধাতব প্রলেপ দেয়া সিমেন্টের মেঝেযুক্ত পতাকাদন্ড আছে। যদিও অন্য প্রতিবেশীরা বজ্রপাতের কারণ হতে পারে ভেবে এটাকে খুব একটা পছন্দ করেনা। তিনি বলেন, “অর্ধনমিতভাবে পতাকা ঝোলানোর বিশেষ নিয়ম আছে। প্রথমে তোমাকে একেবারে উঁচুতে উঠাতে হবে এরপর এটি মাঝামাঝিতে নামিয়ে আনতে হবে।” নয়তো এটা নাকি অমর্যাদা সহ আরও নানা কিছু হয়। সে পতাকাটা ঘরের বাইরে গর্বিত ভঙ্গিতে উড়ছে। আকারের দিক থেকে এটা আমাদের আশেপাশে সব থেকে বড় মাপের। পতাকা থেকে দুই হাত দূরে দাঁড়ালে এতোটা জোরালো শব্দ কানে আসবে, মনে হবে আপনি দক্ষিণের শস্য খেতে বয়ে চলা বাতাসের গর্জন শুনছেন। যেমনটা করে আলো শব্দের গতিকে অতিক্রম করে এগিয়ে যায়। জনাব `এন` এর পতাকা টাঙানোর দড়িতে ধাতব কোন উপাদান আছে, যে কারনে বেশী বাতাস বইতে থাকলে এটি পতাকা দন্ডে বাড়ি খেয়ে ঝনঝন শব্দ করে। যদিও অন্য প্রতিবেশীরা এ নিয়ে খুব একটা পাত্তা দেয়না। তাঁর এবং আমার গাড়ীবারান্দা প্রায় পাশাপাশি এবং তিনি সেখানে একটি ছোট ধাতব মইয়ের উপর দাঁড়িয়ে কোন এক ধরনের তেল সহকারে পশমি কাপড় দিয়ে দণ্ডটিকে পালিশ করছিলেন। সত্যি বলছি, সৌন্দর্য্যের দিক থেকে তাঁর এ ধাতবদন্ড যেন রাগান্বিত স্রষ্ঠার প্রতিবিম্ব!
 
‘ভীষণ সুন্দর পতাকা, মিস্টার এন’
 
‘হতেই হবে। যথেষ্ঠ খরচ হয়েছে এর পেছনে’
 
‘দেখতে পাচ্ছেন, অন্য সবার পতাকাও আজ সাতসকালে বাইরে টাঙানো হয়েছে?’
কথাটা শুনে তিনি নিচের দিকে তাকিয়ে হাসলেন। এরপর খানিকটা গম্ভীরভাবেই উত্তর করলেন,
‘এটা কি কিছুই না বলতে চাচ্ছেন?’
 
মিস্টার ‘এন’ এমন কেউ নয়, যাকে বন্ধুভাবাপন্ন প্রতিবেশী বলা যেতে পারে। তাঁর চার্চ এবং আমি একই সফটবল লীগে খেলার সূত্রে আমাদের পরিচয়। আমরা ঘনিষ্ঠ নই। তবুও তাঁকেই প্রথম জিজ্ঞেস করলাম,
 
‘ধরুন মিস্টার এন-, বিদেশী কোন লোক বা টেলিভিশন সংবাদদাতা এসে আপনার কাছে গতকালের ঘটনার ভয়াবহতা ও সবকিছুর পর এভাবে চর্তুদিকে পতাকা ঝুলানোর অভিপ্রায় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলো। সত্যিকার অর্থে কি উত্তর করতে চাইবেন?’
 
কিছুক্ষণ দম নিয়ে যেভাবে তিনি আমার লনের দিকে তাকান, সেই একই রকম দৃষ্টিতে বিদ্ধ করে উত্তর করলেন, ‘কেন? কারণ আমেরিকানদের সাথে যা হচ্ছে তার প্রতি সহানুভূতি জানাতে।’
 
একথা বলার কারন, বুধবারে এখানে পতাকা টাঙানোর এক অদ্ভুতরকম চাপ সৃষ্টি হয়েছে। পতাকার উদ্দেশ্যই যদি কোন ব্যক্তব্য সৃষ্টি করা, তবে মনে হচ্ছে এটা না টাঙ্গানোর মাধ্যমে আপনি শুধুমাত্র বক্তব্য রাখা বাদেও অনেক কিছুকে নির্দেশ করতে পারবেন। এটা ঠিক কোন ধরনের বিবৃতি হবে, যদিও তা নিশ্চিত নয়। কেমন হবে যদি আপনার কাছে কোন পতাকাই থাকলো না? এছাড়া সবাই এ পতাকাগুলো কোথায় পেল? বিশেষতঃ ছোট আকৃতির যেগুলো চিঠির বাক্সে লাগানোর মত। এগুলো কি ৪ই জুলাইয়ের; ক্রিস্টমাসে অলঙ্কারাদির মত যা সবাই জমিয়ে রেখেছিলো? মানুষ কিভাবে জানলো এই কাজটাই করতে হবে? এমনকি রাস্তার পাশে অর্ধভগ্ন বাড়ী, যেগুলোকে মানুষ ভাবতো জনমানবহীন- তাতেও গাড়িবারান্দায় পতাকা পোঁতা আছে।
 
 
ইয়েলো পেইজ (একজাতীয় টেলিফোন ডাইরেক্টরি)-এ পতাকা সম্পর্কিত কোন তথ্য নেই। মনের মধ্যে আসলেই চাপ কাজ করছিলো, কখন আবার কে এগিয়ে এসে বা গাড়ী থামিয়ে বললো, ‘হেই, তোমার বাড়ীতে দেখি কোন পতাকা টাঙাও নি।’ কিন্তু মানুষ এ কি সম্পর্কে ভাবতে শুরু করেছে, তা সহজেই বোঝা যাচ্ছিলো। শহরের কোন মুদি দোকানে পতাকা রাখা হয়না। ডাউনটাউনে উপহারের দোকানগুলোতেও শুধু হ্যালোউইনের জিনিসপত্র পত্র পাওয়া যায়। ব্লারওয়েলে এক মহিলা ১/৭৪ এর Qik-n-EZ নামের বিদঘুটে দোকানের কথা জানালো। যেখানে সে তাকের উপর রুমাল আর টুপির পাশে কিছু প্লাস্টিকের পতাকাও দেখেছে বলে মনে করতে পারছিলো। কিন্তু আমি সেখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে অপরিরিচত মানুষজন তা নিয়ে গেলো। বাস্তবিক এই শহরে আর একটি পতাকাও পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। কারো বাড়ীর সামনে থেকে চুরি করার চিন্তা মাথায়ও আনা যাবেনা। আমি Qik-n-EZ এ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে এবং ঘরে যেতে ভয় পেতে হচ্ছে। এতোগুলো মৃত মানুষের ভীড়ে আমি সামান্য এক প্লাটিকের পতাকার দ্বারা কোণঠাসা হয়ে পড়েছি। অবস্থা আরো খারাপ হলো, যখন মানুষ জিজ্ঞেস করতে শুরু করলো আমি ঠিক আছি কিনা এবং শুয়ে বিশ্রাম নেয়া উচিত। ওরা বলাবলি করছিলো এটা বেনাড্রিল রিএকশন, যা হওয়া খুব একটা অসম্ভব নয়। এরপর ভাগ্যের অদ্ভুত খেয়াল আর পরিস্থিতিতে Qik-n-EZ এর মালিক (পাকিস্তানী) নিজে এসে আমাকে প্রবোধ দিয়ে ভাঁড়ার ঘরে বসতে সুযোগ দিলেন। এরপর সেখানে তিনি মাত্র অল্প সময় পরই প্লাস্টিকের কাপে দুধের চা খেতে খেতে ভদ্রভাবে রঙ্গিন কাগজ আর ম্যাজিক মার্কার এর প্রস্তাব করলেন। যার ফলশ্রুতিতে এমুহুর্তে আমার হাতে আছে নিজে বানানো সাধের পতাকা।
 
 
এদিনের পতাকা আর ম্যাজিক মার্কার আবিষ্কারের বাকী সময়ে মানুষের কাছে নিজেকে অতিরিক্ত চালাক হিসেবে প্রচার না করেই আগেকার মত একই প্রশ্নোত্তর পর্বে কিছু উত্তর পাওয়া গেলো এরকমঃ
 
‘এটা দেখানোর জন্য- আমরা আমেরিকাবাসী কারো কাছে মাথা নত করতে যাচ্ছিনা’
 
‘পতকা হলো ছদ্ম-আদিম মনোবৃত্তিক উদাহরণের মত, যা কোন জরুরী অবস্থাকে প্রতিকার ও প্রতিরোধে করতে নিজেই থেকে ভূমিকা রাখতে শুরু করে’ (আন্ডারগ্রাজুয়েট শিক্ষার্থীর বক্তব্য)
 
‘আত্মসম্মানের জন্য’
 
‘এই যুদ্ধে আঘাতপ্রাপ্তদের সাথে আমাদের একাত্মতা প্রকাশ করার কাজ করে। সাথে এটাও বলে দেয়, এবার তারা ভুল মানুষের সাথে বিবাদে নেমেছে’
 
 
 
(চলবে)