মুরাদ হফম্যানের মিশন ছিল মুসলিম ও ক্রিশ্চান সমঝোতা

তুহিন খান

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৪, ২০২০

১৯৫২ সালের কাহিনি। জার্মান যুবক উইলফ্রিড হফম্যান পড়াশোনা করতেন আমেরিকায়। তো, মিসিসিপিতে রাইড দেয়ার সময় ওনার কার ক্রাশ করে। অপজিট গাড়ির দুজন যাত্রীই মারা যায়, কিন্তু হফম্যান ও তার ড্রাইভার বাঁইচা যান। হফম্যানের ডাক্তার অবাক চোখে তার দিকে তাকাইয়া বলেন, ‘খোদা আপনার জন্য আলাদা কিছু একটা ভাইবা রাখছে মিয়া।’

হফম্যান সেই ঘটনা ভুইলাই বসছিলেন প্রায়। মানে খোদা আর কী করবে! হফম্যান তখন জার্মানির ল স্কুলে থিকা বের হইয়া, মাস্টার্স কইরা ফেলছেন হার্ভার্ডে। জার্মানির সিভিল সার্ভিসে ঢুইকা গেলেন তারপর, ইওরোপের সিক্যুরিটি পলিসির উপরে ট্রেনিং নিলেন; নিউক্লিয়ার ডিফেন্সের নাড়ি-নক্ষত্র জানলেন। নিউক্লিয়ার ডিফেন্স স্পেশালিস্ট হিশাবে প্রথম এসাইন্ড হইলেন আলজেরিয়ায়।

আলজেরিয়ায় তখন চলতেছে স্বাধীনতা যুদ্ধ। যে যুদ্ধে `ইসলাম` ছিল আলজেরিয়ানদের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার। যে যুদ্ধে `নেকাব` ছিল আলজেরিয়ান নারীদের গেরিলা মাস্ক। তাদের নেকাবঢাকা চেহারার বাইরে খোলা চোখ দুইটা কীভাবে ফ্রেঞ্চ সৈন্যদের মনে ইনফেরিওরিটির বোধ তৈরি করত, তার অসাধারণ বর্ণনা দিছেন মালেক আল্লুলা, তার `দ্য কলোনিয়াল হারেম` বইতে।

যাহোক, আলজেরিয়ানদের স্বাধীনতা যুদ্ধ প্রভাবিত করলো হফম্যানরে। উনি আলজেরিয়ার ইতিহাস পড়তে পড়তে খোঁজ পাইলেন ইসলামি আর্ট-কালচারের। আরো অভিভূত হইলেন হফম্যান। শেষমেশ ১৯৮০ সালে, ক্যাথলিক চার্চের আনুগত্য ছাড়লেন উনি। মুসলিম হইলেন। নতুন নাম রাখলেন নিজের, মুরাদ হফম্যান।

এরপরে বিতর্ক হইছে অনেক। মুসলিম হওয়ার তিন বছর পরেই, ১৯৮৩ সালে, ন্যাটোর ডিরেক্টর অব ইনফরমেশন পদে নিয়োগ পান। চার বছর ছিলেন ওই পদে। ১৯৮৭ সালে আবার স্বাধীন আলজেরিয়ায় জার্মান রাষ্ট্রদূত হওয়ার সুযোগ পান। সেসময় জার্মানিতে বেশ বড়সড় বিক্ষোভ হইছিল। একজন মুসলিম বাইরের রাষ্ট্রে জার্মানিরে রিপ্রেজেন্ট করবে, অনেকেই জিনিশটা মানতে পারেন নাই। ১৯৮৭-১৯৯০ পর্যন্ত ছিলেন আলজেরিয়ায়; ১৯৯০-১৯৯৪ সাল পর্যন্ত মরোক্কে।

অবসর নেন তারপর। শুরু করেন লেখালেখি। মুসলিম ও ক্রিশ্চান দুনিয়ার মধ্যে যে কনফ্লিক্টের কথা বলতেছিল সবাই, হান্টিংটনরা যে `ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশন` তত্ত্ব দিলো, মুরাদ হফম্যান তার বিরুদ্ধে দাঁড়ান। তার সারাজীবনের মিশন ছিল, মুসলিম আর ক্রিশ্চান ওয়ার্ল্ডরে সমঝোতায় আনা, একের কাছে আরেকের সমাজ, জীবন, কালচার, বোধ, বিশ্বাস ইত্যাদির ব্যাখ্যা দেয়া। স্টিফেন কিঞ্জাররে দেয়া এক ইন্টারভিউতে মুরাদ বলছিলেন, `আমার কাজ আসলে ব্রিজ বানানো। `ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশান` যে পুরাই ভুয়া একটা জিনিশ, এইটা প্রমাণ করাই আমার মিশন।`

১৯৯২ সালে তার `ইসলাম: দ্য অল্টারনেটিভ` বই বের হইলে তুমুল সমালোচনার শিকার হন উনি। তবে এইটাই সম্ভবত ওনার সবচাইতে বিখ্যাত বই। এছাড়া `ইসলামিক ফিলোসফি`, `জার্নি টু মক্কা`, `রেইজ অব রেলিজিওন: ইসলাম ইন দ্য থার্ড মিলেনিয়াম` এইগুলাও তার গুরুত্বপূর্ণ বই।

১৯৯৬ সালে বের হয় তার আরেকটা বিখ্যাত বই `ইসলাম ২০০০`। মূলত এই বই দিয়াই হফম্যানের সাথে আমার খাতির। এই বইয়ে হফম্যান পুব ও ইসলামের ব্যাপারে ওয়েস্টের প্রিজুডিসগুলার ক্রিটিক করছিলেন; সমালোচনা করছিলেন তাদের সাম্রাজ্যবাদ ও এর পেছনে লুকানো সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতারও, যা মূলত এনলাইটেনমেন্টেরই জাতক— `সারা দুনিয়ার লোক জিন্স পরবে, হ্যামবার্গার খাবে, কোকাকোলা খাবে, মার্লবোরো টানবে, সিএনএন দেখবে, পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসির সুবোধ সিটিজেন হইয়া ঘরে বইসা থাকবে, আর মেবি, কোনও চার্চেরও মেম্বার হবে— এইরকম ভাবা ঠিক না`— লেখছিলেন হফম্যান।

মুরাদ হফম্যান আজ মারা গেছেন। যে দুনিয়া উনি চাইছিলেন, তা যে এক অলীক স্বপ্ন ছিল, এইটা দেইখা শেষ বয়সে হয়তো কষ্ট পাইছেন অনেক। ৯/১১ দেখছেন, পরবর্তী দুনিয়াটাও দেখছেন। ২০২০-এর জানুয়ারিতে, ৮৮ বছর বয়সে যখন মরলেন, তখন গোটা দুনিয়ায় ফ্যানাটিকদের রাজত্ব। ক্ল্যাশ অব সিভিলাইজেশন। কিন্তু একইসাথে আবার, সারা দুনিয়ায়, এই ফ্যানাটিকদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মানুষের লড়াইও চলমান। এই দিকটা ভাবলে মনে হয়— শান্তিতেই হয়তো মরতে পারছিলেন হফম্যান।

ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিয়ুন।