‘এখানে জাদু শেখানো হয়’ বইয়ের প্রচ্ছদ

‘এখানে জাদু শেখানো হয়’ বইয়ের প্রচ্ছদ

মুরাদুল ইসলামের গল্প ‘মসলিন চাষি’

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৯, ২০২০

মুরাদুল ইসলামের গল্পের বই ‘এখানে জাদু শেখানো হয়’ প্রকাশিত হচ্ছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০ এ। প্রকাশ করছে বৈভব। স্টল নম্বর ৭১৮। এই বইয়ের একটি গল্প ‘মসলিন চাষি’ ছাড়পত্রের পাঠকদের উদ্দেশে:

ঘুমালে আমি হয়ে যাই মসলিন চাষি, বিষয়টা আপনাদের কাছে হয়তো বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে না, কিন্তু তা সত্য এবং এক অতি অদ্ভুত ব্যবস্থার মধ্যে আমি পড়ে গেছি এবং এর থেকে নিস্তারের উপায় কী, তা আমার জানা নেই; কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমি লিখে যাচ্ছি, যা থাকে কপালে, যখন আর কিছু করা সম্ভব না এবং যখন অতি অবাস্তব এক পরিণতির দ্বারপ্রান্তে এসে আমি উপস্থিত হয়েছি, তখন এ ভিন্ন আর কিছু আমার মাথায় আসছে না।

ঘটনা হচ্ছে, ঘুমালে আমি হয়ে যাই মসলিন চাষি এবং তা শুরু হয়েছে মাত্র দুয়েকদিন আগে থেকে। আমি দেখলাম, আমি একটি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি, তখন আমার সাথে একটি লোকের দেখা হয়। তার পোশাক-পরিচ্ছদ কেমন ছিল আমার এখন মনে নেই। তবে স্পষ্ট মনে আছে, তার হাতে একটি জালিবেত ছিল আর সেই বেতের রং ছিল মিশমিশে কালো।

লোকটি আমাকে দেখে বললেন, ‘ডু ইউ নো সামথিং এবাউট মসলিন?’
আমি তার প্রশ্নে অবাক হয়ে গেলাম কিছুটা এবং ধরতে পারলাম না তিনি আসলে কী জিজ্ঞাসা করছেন। কারণ চিনি না, জানি না এমন মানুষ হুট করে এরকম প্রশ্ন করে বসবেন তা ঠিক হিসাবের মধ্যে পড়ে না। আমি উত্তরে বললাম, ‘মাশরুম?’
তিনি বললেন, ‘না, মসলিন, মলবুস খাস, মলমল খাস...ইউ নো?’
আমি বললাম, ‘আপনি ইংরাজিতে কথা বলছেন কেন? বাংলায় কথা বলেন। বাংলা আমার সেভেন্টি পার্সেন্ট মাতৃভাষা।’
এ সময় একটা শব্দ হলো, যাকে বলা যায় ‘সপাং’; ভদ্রলোকের হাতের বেত মুহূর্তের মধ্যে লাফিয়ে এসে অতি দ্রুতবেগে আমাকে আঘাত করল। আর যে স্থানে বেত স্পর্শ করেছিল, সেই স্থানে ব্যথার তীব্র অনুভূতি আমি অনুভব করতে লাগলাম। আমি কিছু বলার আগেই লোকটি বিকৃত মুখে বলে উঠল,
‘হারামজাদা ব্লাডি বেঙ্গালি, এখন দেশ চালায় ইংরাজ, ইংরাজি চলবে না কি তর ভাষা চলবে? ইডিয়ট!’

আমি বুঝে নিলাম অবস্থা সঙ্গিন, চারপাশে মানুষজন নাই আর জায়গাটাও অচেনা, ফলে কী হচ্ছে বা কেন হচ্ছে তা বুঝতে আমাকে ঘটনার সাথে এগিয়ে যেতে হবে, আমি লোকটিকে বললাম, ‘ইয়েস স্যার!’
লোকটি মুখে অল্প হাসি এনে বলল, ‘এই তো, ভেরি গুড। এখন আমার কথার উত্তর দে বাছাধন? হোয়ার ইজ মাই মলবুস খাস?’

আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে বললাম, ‘স্যার, বিশ্বাস করুন, আমি এগুলো সম্পর্কে কিছুই জানি না। আমি একজন নাদান মানুষ, এত সব জটিল শব্দের নাম এর আগে কোনো দিন শুনিও নাই।’
লোকটি আমার দিকে অল্পক্ষণ তাকিয়ে তার বেতকে অন্য হাত দিয়ে মালিশ করল, আমি ভেবেছিলাম যে অচিরেই হয়তো আরো কয়েক ঘা বেত্রাঘাত হজম করতে হবে। কিন্তু তা হয় নি। লোকটি হঠাৎ বলল, ‘আই নো, কীভাবে তোদের মতো লায়ারদের কাছ থেকে সত্যটা বাইর করে নিতে হয়। এর জন্যই আট বছর ধরে ইংরাজ স্যারদের সাথে কাজ করতে পারছি। প্রথমে ছিলাম দালাল, এখন হইছি গোমস্তা। এই সব কি এমনে এমনে? ভেরি ফানি!’

লোকটির কথায় আমি ভয় পেয়ে গেলাম, ভয় পাওয়ার যথেষ্ট কারণও ছিল, লোকটি হঠাৎ আমার ঘাড় ধরে ধাক্কাতে শুরু করল এবং ধাক্কাতে ধাক্কাতে বাঁশের চাটাই দ্বারা নির্মিত দেয়ালযুক্ত একটি ছোটো ঘরে আমাকে নিয়ে গেল। সেই ঘরে দেখলাম কয়েকটি ছিকার মধ্যে ঝুলছে হাঁড়ি, ছিকা হলো দড়ি দিয়ে বানানো একধরনের খাঁচার মতো জিনিস, যার মধ্যে গ্রামাঞ্চলে আগেকার দিনে হাঁড়ি ঝুলিয়ে রাখা হতো; এবং ঘরের মধ্যে ছিল একটি মাটির প্রদীপ, হয়তো কেরোসিনের সাহায্যে জ্বলছে, আগুনের শিখা ওপরে উঠছে সাথে নিয়ে কালো ধোঁয়া, প্রদীপের আলো বেশি না, ছড়াচ্ছে অল্প জায়গায়, ঘরের একপাশে রাখা একটি মটকি, তার মুখে বাঁশের একটি ঝাঁকা উলটা করে রাখা আছে।

লোকটা আমাকে নিয়ে একটা চেয়ারের মতো টুলে বসাল এবং সে বসল সামনের টেবিলের ওপরে। এরপর আমার দিকে তাকিয়ে খিকখিক করে হেসে বলল, ‘দাদনের মানি ফেরত দে!’
আমি বললাম, ‘স্যার, আপনি ভুল করছেন, আমি ওই মানুষ নই, যাকে আপনি খুঁজছেন, গ্রেইভ মিস্টেক!’
ঠাশ করে একটা চড় এসে লাগল আমার গালে, আমি চারিদিকে অন্ধকার দেখলাম প্রায়, মাথা ঘুরতে লাগল, আমি চোখ বন্ধ করে সর্ষে ফুল দেখার প্রাণপণ চেষ্টা করলাম। কারণ আমি শুনেছি, এরকম অবস্থায় লোকেরা সর্ষে ফুল দেখে, যদিও অনেক চেষ্টার পরেও আমি দেখেছিলাম কেবল অন্ধকার।

লোকটি মুখ বিকৃত করে, বিকৃত স্বরে বলল, ‘হারামজাদা, নো ইংলিশ! তাঁতির বাচ্চা তাঁতি, তুই কেন ইংরাজি বলবি? ইংরাজির একটা সম্মান আছে না!’
তারপর আমার মাথার সামনের দিকের চুলের মুঠি ধরে বলল, ‘যা বলছি তা বলে দে, তরে ছেড়ে দেই। হোয়ার ইজ মাই মলবুস খাস?’

আমার চোখ দিয়ে জল এলো; চোখ ফেটে এলো জল, এমনি করে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল, ইস্কুলে পড়া নজরুলের কুলি-মজুর কবিতা ভেসে উঠল চোখের সামনে, আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না, কারণ আমি যা-ই বলি না কেন, আমার সামনে যিনি উপস্থিত আছেন, আছেন যে একজন স্যার, তিনি আমার কোনো কথাই শুনবেন বলে মনে হচ্ছে না।

আমি ঠিক করলাম লোকটির কথা মেনে নিয়ে কথা বলব, তাতে অন্তত আপাতত তার রোষানল থেকে বাঁচা যাবে। আমি বললাম, ‘স্যার, মলবুস খান কোথায় আমি জানি না। তবে যেখানেই থাকুক সে, আপনার জন্য আমি তাকে খুঁজে বের করব। ইয়ে মেরি ওয়াদা।’
প্রসন্ন হাসি ফুটে উঠল লোকটির মুখে। সে বলল, ‘এই তো গুড বাত। ভদ্রলোকের মতো কথা বললি। এরকম আগে বললে এত ঝামেলা হতো না। এখন যা, গিয়া মলবুস খাস তৈরি করতে লেগে যা।’
আমি বললাম, ‘জি স্যার!’
লোকটি বলল, ‘বইয়া রইছস ক্যা? উইঠা যা হারামজাদা!’

আমি উঠে গেলাম দরজার কাছে, বাইরে তাকিয়ে দেখি ঘুটঘুটে অন্ধকার, এমন অন্ধকারে পা ফেলতেও ভয় হয়, মনে হয় এই বুঝি পা দিলাম পুলসিরাতে, আর আমি যে গুনাগার বান্দা, পা দিলে চিকন চুলের সমান পুলসিরাত ভেঙে সোজা দোজখে পড়ব তাতে কোনোই সন্দেহ নাই; ঠিক অজগরের বিরাট হা-এর মধ্যে, সেই অজগর আবার সাঁতার কাটছে আগুনের সমুদ্রে; সেই বিস্তৃত আগুনের সমুদ্র অতল, অথই আগুন জল, বিরাট বিরাট ঢেউ এসে নিত্য বাড়ি খায় আর হারিয়ে যায়, আগুন আর আগুন, লেলিহান আগুনের ঢেউ, আগুনের জিভ...আর কিছু নেই...

দরজায় দাঁড়িয়ে ভাবছি কীভাবে যাব। আর তখনই অনুভব করলাম পশ্চাদ্দেশে শক্তিশালী লাথি এবং তাতে শূন্যে ভাসতে ভাসতে আমার অন্ধকারে গিয়ে পড়ার কথা ছিল, কিন্তু আমি পড়ে গেলাম খাট থেকে, মেঝেতে।

মেঝেতে পড়ে মাথায় অল্প ব্যথা পেলাম এবং আমি বুঝতে পারলাম এতক্ষণ যেখানে ছিলাম, তা নিছকই স্বপ্ন, আমার ধড়ে ফিরে এল প্রিয় প্রাণ, কোনোমতে উঠে বসে খাটের পাশের টেবিলে দেখলাম এক গ্লাস পানি পিরিচ দিয়ে ঢাকা আছে কি না। গলা শুকিয়ে গিয়েছিল, ফলে তেষ্টা পেয়েছে প্রচুর, কিন্তু নাটক বা ফিল্মে যেমন দেখেছি, চরিত্রগুলো দুঃস্বপ্ন দেখে উঠেই তাদের খাটের পাশে পিরিচে ঢাকা গ্লাসে বিশুদ্ধ পানি পেয়ে যায়, তা আমি পেলাম না। ফলে আমাকে অন্য রুমে যেতে হলো, ডাইনিং রুমের টেবিল থেকে একটি গ্লাস নিয়ে টেপ থেকে গ্লাসে পানি নিলাম, পানি বেশ আস্তে আস্তে জমা হলো গ্লাসে, বেশ-অর্ধেক জমা হওয়ার পরে আমি তা পান করতে শুরু করলাম এবং যেহেতু পিপাসার্ত ছিলাম, তাই কয়েক ঢোক গিলে ফেললাম দ্রুতই এবং এরপরই আমি এর স্বাদ বুঝতে পারলাম। এ তো পানি নয়, লেবুর শরবতের স্বাদ...আমি কয়েক সেকেন্ড গ্লাসের পানির দিকে তাকিয়ে রইলাম, পানির গন্ধ শুঁকলাম, সবই স্বাভাবিক কিন্তু তা-ও পানির স্বাদ লেবুর শরবতের মতো, আমি পুনরায় জিহ্বার অগ্রভাগ পানিতে ছুঁইয়ে পরীক্ষা করে দেখলাম, পানির স্বাদ লেবুর শরবতের মতোই।

আমি গ্লাস হাতে নিয়েই ভাবতে বসলাম, এমন কেন হতে পারে, পানির ট্যাংকির ভেতরে নিশ্চয়ই কেউ লেবু চিপে রেখে দেয়নি আর খালি লেবু চিপে দিলেই তো হবে না, লবণ-চিনি ইত্যাদিও দিতে হবে পরিমাণমতো, এরপর দিতে হবে ঘুটা, পানির ট্যাংকিতে লেবুর শরবত বানানোর জন্য এ কাজ কে করবে আবার কেনই বা করবে? আমি ভাবছিলাম আর তখনই আমার মনে পড়ল একটি পত্রিকার খবরের কথা, যা আমি কিছুদিন আগে পড়েছিলাম। একজন বাড়িওয়ালা তার কাজের মেয়েকে খুন করে পানির ট্যাংকির ভেতরে লুকিয়ে রেখেছিল, অতঃপর পানির স্বাদ বিস্বাদ হয়ে যায় এবং লোকেরা ট্যাংকিতে গিয়ে দেখে মৃতদেহ। আমার মনে হলো এমন জিনিস এখানেও হতে পারে, আমার যারা প্রতিবেশী ওপরের ফ্ল্যাটগুলোতে বাস করেন, এদের প্রায় প্রত্যেকের বাড়িতে কাজের মেয়ে আছে এবং যেহেতু শহরগুলোতে এসব গৃহস্থালি কাজের মেয়েরা নিরাপত্তাহীন, তাই বাড়ির কর্তা পুরুষ প্রায়ই এদের সাথে মিলিত হন স্ত্রীচক্ষুর অন্তরালে। এসব পত্রিকায় ও টিভিতে মাঝে মাঝে উঠে আসে। আমার প্রতিবেশী ফ্ল্যাটের কর্তাদের কেউ একজনের এমন স্বভাব থাকা অস্বাভাবিক না। ফলে তিনি ধরা যাক তা করেছেন এবং মেয়েটি প্রেগন্যান্ট হয়ে গেছে, অতঃপর তিনি হিচককিয়ান স্টাইলে মেয়েটিকে খুন করে পানির ট্যাংকিতে চুবিয়ে রেখেছেন; কিন্তু তাতে পানির স্বাদ লেবু লেবু টক টক হবে কেন? তাহলে কি মরার আগে মেয়েটি ট্যাংকিতে প্রস্রাব করে গেছে? হয়তো সেদিন সে বেশি লেবু খেয়েছিল......আমি আর ভাবতে পারলাম না, আমার মধ্যে বমির উদ্রেক হলো, মনে হলো পেটের ভেতরে ভূমিকম্প চলছে আর সব জিনিস বেরিয়ে আসতে চাইছে। আমি আটকাতে পারলাম না, অল্প বমি করে ফেললাম বেসিনে।

বমি করার পর পরিষ্কর হয়ে ফিরে এলাম নিজের বেডরুমে কিছুক্ষণ পর। মাথায় পানিটানি ঢেলে অল্প শান্ত হয়েছে মন, শান্ত মনে ঠিক করেছি পানির ট্যাংকি ও পানি নিয়ে আর ভাবব না। সকালে উঠে দেখব পানির স্বাদ লেবুর শরবতের মতো কি না। যদি হয় তাহলে ট্যাংকি চেক করে দেখব, যদি না হয় তাহলে বুঝব জিহ্বার স্বাদ নির্ধারক ফ্যাকাল্টিতে সমস্যা হয়েছিল রাতে। মনকে শান্ত করে আমি আমার ল্যাপটপ অন করলাম আর ফেইসবুকে প্রবেশ করলাম; দেখলাম সেখানে এক মিডলক্লাসের বাচ্চা আনন্দে গদগদ হয়ে পোস্ট দিয়েছে এমা ওয়াটসন রানা প্লাজা হ্যাশট্যাগে টুইট দিয়েছেন তাতে সে খুশি। আমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল মিডলক্লাসের বাচ্চার বাচনে। আমি টুইটারে ঢুকে এর সত্যতা যাচাই করার চেষ্টা করলাম এবং দেখলাম হ্যাঁ সত্যিই রানা প্লাজা ট্রেন্ডে প্রথমে আছে। আর এমা ওয়াটসনসহ অন্য অনেকে রানা প্লাজা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করছেন। আমি ভাবলাম যে এই সব ইউরোপিয়ান তাদের পোশাক পরে এবং কখনো ভাবে না তাদের পোশাক তৈরিতে শ্রমিকেরা ন্যায্য মূল্য পাচ্ছে না। তারা সেই সব বড়ো কোম্পানিকে কখনো চাপ দেয় না, যারা শ্রমিক ঠকিয়ে চলেছে এবং পরোক্ষভাবে এই সব রানা প্লাজার জন্য দায়ী। কিন্তু আবার তারা রানা প্লাজা দিবস পালন করে, শ্রমিকের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে। আমার মনে প্রশ্নের উদয় হলো, তাদের অভিযোগটা আসলে কার প্রতি? তবে একেবারে কিছু না হওয়ার চাইতে এটা হয়তো কোনো একদিক দিয়ে ভালো। এই অবস্থা তৈরি করতেই রানা প্লাজার শত শত শ্রমিকের প্রাণ দিতে হলো। তারা এভাবে প্রাণ না দিলে এরা হয়তো কখনো ভাবতই না তাদের পোশাক আসলে কেউ তৈরি করছে এবং তারাও মানব প্রজাতির অন্তর্গত...

পরদিন সকালে আমি রাস্তায় বের হলাম এবং আমার সাথে এক পরিচিত ভাইয়ের দেখা হয়। তিনি আমাকে বললেন, ‘কী ব্যাপার? কোথায় থাকো তুমি? আমাদের শ্রমিক অধিকার দেয়ালচিত্র উদ্বোধনে থাকছ তো?’
আমি বললাম, ‘জি স্যার, আমি থাকব।’
তিনি বললেন, ‘স্যার বলছ কেন?’
আমি বললাম, ‘এখন থেকে ঠিক করেছি সবাইকে স্যার বলব। আপনাকে দিয়ে শুরু করলাম স্যার।’
তিনি বললেন, ‘বেশ বেশ। ভালো। স্যার শুনতে ভালোই লাগে। তা তুমি কি সাম্প্রতিক রানা প্লাজা ইস্যুতে এমা ওয়াটসনের টুইট দেখেছ?’
আমি বললাম, ‘জি স্যার, দেখেছি।’
তিনি বললেন, ‘আমরা ভাবছি এই টুইট প্রিন্ট করে দেওয়ালচিত্রে ঝুলিয়ে দেব। আইডিয়া ভালো না?’
আমি বললাম, ‘জি স্যার, ভালো আইডিয়া।’
তিনি বললেন, ‘তবে কপিরাইট নিয়ে কি কোনো ঝামেলা হবে? তোমার কী মনে হয়?’
আমি বললাম, ‘সঠিক বলতে পারছি না স্যার। আপনাকে জেনে জানাব।’
তিনি বললেন, ‘তাহলে ঠিক আছে। এখন আমি যাই, পরে কথা হবে।’
আমি বললাম, ‘ওকে স্যার।’

উনি চলে গেলেন এবং কীভাবে কীভাবে যেন আমার পুরোটা দিন কেটে গেল। সেদিন রাতে ঘুমিয়েছি, আবার দেখি সেই স্বপ্ন, স্বপ্নে আমি এক মসলিন চাষি। আমি বসে আছি এক তাঁতখানায় আর আমার অনতিদূরে বসে আছেন একজন মোটাসোটা লোক। তিনি বললেন তিনি হচ্ছেন দারোগা-ই-মলবুস খাস...তার পোশাক-আশাক বিচিত্র আর হাতে একটি লাঠি।

তিনি আমার দিকে তাকিয়ে খসখসে গলায় বললেন, ‘হারামজাদা, কাজ করস না ক্যা? কাজ কর, কাজ কর। মুঘল সম্রাটের জন্য এইবার যাবে লাখ টাকার মলবুস খাস।’
আমি বসেছিলাম যে যন্ত্রটির সামনে, তা হয়তো কাপড় বোনার যন্ত্র, কিন্তু এটা কীভাবে চালনা করতে হয়, তা আমার জানা নেই। আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে ধীরে ধীরে যন্ত্রটি নাড়তে লাগলাম।
দারোগা বললেন, ‘বাজে সুতা ব্যবহার করবি না, সম্রাটের জন্য বাজে সুতার কাপড় বানাইলে তরে মাইরা উটের পিঠে বাইন্ধা সারা ঢাকা শহর ঘুরাণ্টি দেওয়া হবে।’
আমি বলতে চাইলাম, ‘কিন্তু...’
দারোগা আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, ‘চোপ হারামি, কথা না। সম্রাটের জন্য কাপড়ের কাজ শেষ হলে কাজ শুরু হবে নবাবের জন্য। নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁর জন্য বানাবি সরকার-ই-আলা। কথা কইয়া সময় নষ্ট করার ফুরসত নেহি।’
এরপরে দেখলাম দুইটা শক্তপোক্ত লোক আমার দুই দিকে ধরে আমাকে তুলল, নিয়ে গেল দারোগার সামনে। দারোগা আমার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললেন, ‘সম্রাটের পোশাকে বাজে সুতা ব্যবহার করছস? এই দারোগা সিরাজের চউখ ফাঁকি দিতে চাইছস তুই?’
আমি ভয়ে বললাম, ‘জি না স্যার, কভি নেহি। আমি সুতাই ইউজ করি নাই।’
ভয়ের চোটে মুখ দিয়ে ইংরাজি শব্দ বের হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আমার বোঝা উচিত ছিল, তখনো দেশে ইংরাজি চালু হয়নি। মুগলদের রাজকীয় ভাষা ফারসি, ফলে ইংরাজি বোঝেননি দারোগা সিরাজ। ঠাশ ঠাশ চড় পড়তে লাগল আমার গালে, একেকটা চড় দশ মণ ওজনের হবে, যদিও দশ মণ ওজন কেমন সে সম্পর্কে বর্তমানে আমার কোনো ধারণা নাই। চড়ের চোটে আমার ঘুম ভেঙে গেল।

আমার মুখ ও শরীর ঘেমে উঠেছিল। আমি ঘুম থেকে উঠে আজ আর পানি খেতে গেলাম না। কারণ অন্যদিন পানিকে মনে হয়েছিল লেবুর শরবতের মতো, কিন্তু সকালে আবার পানিকে সাধারণ পানির স্বাদেই পেলাম। ফলে আমার ধারণা স্বপ্নের চাপে মুখের স্বাদের উলটাপালটা হয়ে যায়। আমি নিশ্চুপ ও নির্ঘুম বসে রইলাম। ভাবলাম, পরদিন সকালে যাব মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে। কারণ এরকম স্বপ্ন দেখতে দেখতে বেঁচে থাকা যায় না। এই স্বপ্নের যন্ত্রণায় ঘুমানোই অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

আমি পরদিন একজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে গেলাম। তার চেম্বারে গিয়ে অনেকক্ষণ বাইরে বসে অপেক্ষা করতে হলো। তখন আমার চারপাশে অনেক মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত লোকদের দেখলাম। এর মাঝে একজন সাদা দাড়িওয়ালা বৃদ্ধ লোক আমার সাথে অদ্ভুত আলাপে লিপ্ত হলেন। আমি বোঝার চেষ্টা করলাম তিনি কী নিয়ে আলাপ করছেন। কারণ একসময় আমি জেনেছিলাম সে শেক্সপিয়রের নাটকগুলোতে যেসব চরিত্র দার্শনিক গুরুত্ববহ গভীর কথাগুলি বলেছে, এরা নাকি উন্মাদ ছিল এবং আগেকার দিনে উন্মাদ লোকদের প্রতি ঈশ্বরের বিশেষ অনুগ্রহ আছে এমন মনে করত লোকে। ফলে আমি এই বৃদ্ধ লোকটিকে ভাবতে লাগলাম একজন দার্শনিক, ঈশ্বরের স্পর্শ আছে তার চিন্তায়, তিনি নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলছেন আমাকে। আমি তার কথা বোঝার চেষ্টা করতে লাগলাম আর এদিকে তার পাশে বসা, সম্ভবত তার স্ত্রী তাকে কথা বলা থেকে নিবৃত্ত করতে চাইছিলেন। তিনি বলছিলেন যে, ‘আপনি কার সাথে কথা কন? আর কেউ কি কথা কয়? কেউ কি আপনার কথা শোনে? বন্ধ করেন।’

একসময় আমার ডাক এলো। আমি দেখলাম ডাক্তারের কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসছেন একজন স্থূল বয়স্ক মহিলা। তার সাথে আরো দুজন মহিলা, যাদের বয়স অপেক্ষাকৃত কম। স্থূল মহিলাটি অন্যদের হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইছেন এবং বলছেন, ‘আমি পীরানি। ওই তোমরা জানো না কত বড়ো বড়ো মানুষের ছায়া আছে এই আমার ওপরে। আমার ওপর বড়োপীর আবদুল কাদির জিলানি সাবের ছায়া আছে, ওই তোমরা জানো না...’ ভদ্রমহিলাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল একরকম। আমি দেখলাম ডাক্তারের সহকারী লোকটিও এগিয়ে এসে তাদের সাহায্য করছে, সম্ভবত কোনোরূপ ইনজেকশন দেওয়া হবে মহিলাটিকে, তাই মহিলা চিৎকার করছেন, ‘আমারে ইনজেকশন দিও। এত বড়ো নাফরমানি...আমার ওপর বড়ো বড়ো মানুষের ছায়া আছে, আমি কে তোমরা জানো না...’

এসব দেখতে দেখতে আমি ডাক্তারের কক্ষে প্রবেশ করলাম। ডাক্তার একজন বেঁটে-খাটো মানুষ, তার গোঁফ আছে এবং মাথায় অবৃহৎ টাক বিদ্যমান। তিনি আমাকে দেখে বললেন, ‘আপনিই কি রোগী?’
আমি বললাম, ‘জি স্যার।’
তিনি বললেন, ‘আপনার কী সমস্যা আমাকে বলেন তো?’
আমি বললাম, ‘স্যার, আমি রাতে ভয়ানক স্বপ্ন দেখি, একই স্বপ্ন বারবার দেখি, বিভিন্ন পর্বে ভাগ করে।’
ভদ্রলোক অল্প হেসে তার প্রেশার মাপার যন্ত্রটি হাতে নিয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, ‘আপনি কি বেশি টিভি সিরিয়াল দেখেন?’
আমি বললাম, ‘জি না স্যার। আমি টিভি দেখি না।’
ডাক্তার এসে আমার প্রেশার মাপলেন। তারপর আমাকে বললেন, ‘মনে কোনো সন্দেহ আছে, রাগ বা ভয়?’
আমি কিছুক্ষণ ভেবে বললাম, ‘না স্যার। সেভাবে কিছু নাই, তবে সন্দেহ একটু আছে।’
ডাক্তার বললেন, ‘আপনার স্বপ্নটা কী নিয়ে?’

আমি বললাম, ‘স্যার, স্বপ্নে আমি দেখি যে আমি হয়ে গেছি একজন মসলিন চাষি। ইংরাজ দালাল গোমস্তারা, মোগল দারোগারা আমাকে নির্যাতন করে।’
ডাক্তার বললেন, ‘আপনি কি মসলিন নিয়ে ইদানীং পড়াশোনা করছেন?’
আমি বললাম, ‘জি না স্যার। মসলিন নিয়ে আমার জানাশোনা নাই বললেই চলে।’
ডাক্তার গম্ভীর হয়ে বললেন, ‘আপনার সন্দেহটা কী নিয়ে?’
আমি বললাম, ‘সন্দেহ স্যার আগে ছিল না। তবে সেদিন স্বপ্ন দেখার পরে যখন পানি খেলাম, তখন মনে হলো পানির স্বাদ লেবুর শরবতের মতো। তখন আমার মনে হলো যে আমার কোনো প্রতিবেশী তার কাজের মেয়েকে খুন করে ট্যাংকিতে ফেলে দিয়েছেন।’

ডাক্তার বললেন, ‘হুম, বুঝেছি।’
তিনি প্রেসক্রিপশনে বেশ বড়ো করে লেখলেন স্কিজোফ্রেনিয়া। তারপর আমার নাম, বয়স ইত্যাদি জিগ্যেস করে নিয়ে লিখলেন। লিখলেন তিনটা ওষুধের নাম। একটা খেতে হবে সকালে ও রাতে। অন্য দুটি কেবল রাতে।
ডাক্তার বললেন, ‘আপনাকে কিছু ওষুধ দিলাম। অ্যান্টিসাইকোটিক ড্রাগ। এগুলো নিয়ম করে খাবেন আর ঠিক দুই মাস পরে আবার আসবেন।’
আমি জিগ্যেস করলাম, ‘স্যার, আমার কী হয়েছে?’
ডাক্তার বললেন, ‘তেমন কিছু না। সেরে যাবে। দুই মাস পরে আসুন।’

আমি ডাক্তারকে ছয়শত টাকা দিয়ে ওনার কক্ষ থেকে বের হলাম। আমি বের হওয়ার পরে দেখলাম ডাক্তারের সহযোগী তার হাতে থাকা রোগীদের সিরিয়াল দেখে সেই বৃদ্ধ লোক, যিনি আমার সাথে কথা বলেছিলেন, তাকে গিয়ে বলছেন, ‘আপনি কি সিরাজ সাহেব?’
ভদ্রলোকের পাশে বসা ভদ্রমহিলা বললেন, ‘জি।’
ডাক্তারের সহযোগী বললেন, ‘এবার আপনারা ভেতরে যান।’
বৃদ্ধ ভদ্রলোক ডাক্তারের কক্ষে প্রবেশ করতে করতে একবার আমার দিকে তাকিয়ে হাসলেন। ওনার হাসিটা আমার পরিচিত মনে হলো। ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হতে হতে আমি ভাবলাম স্বপ্নে যে দারোগা সিরাজকে দেখেছিলাম, এর সাথে এই বুড়ো লোকের কোনো মিল আছে কি...মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের ব্যাপারে আমার মেজাজ খারাপ হলো। কারণ ভদ্রলোক লিখেছেন প্রেসক্রিপশনে স্কিজোফ্রেনিয়া, কিন্তু স্বপ্নের সাথে এর কী সম্পর্ক? স্কিজোফ্রেনিয়ার বিষয়-আশয় অল্পবিস্তর আমার জানা ছিল, তাই আমি সন্তুষ্ট হতে পারলাম না। ভাবলাম যারা ওষুধ নয়, কনসালটেশনের মাধ্যমে মনোরোগের চিকিৎসা করে এদের কাছে যাব। আমার মনে হলো স্বপ্নের ব্যাপারটা ওষুধের বিষয় নয়। ফলে আমি আরেকজন সাইকিয়াট্রিস্ট খুঁজে বের করলাম এবং তার এপয়েন্টমেন্ট নিলাম সেদিনই। ভদ্রমহিলা দেখতে সুশ্রী, মাঝারি গড়নের, চেহারার দিকে তাকালে মনে হয় ওনার ওপর নির্ভর করা যায়।

আমি ওনার সামনে বসলাম। তিনি আমার সাথে প্রথমে পরিচিত হলেন, তারপর আমার স্বপ্নটার ব্যাপারে শুনলেন। মনোযোগী শ্রোতার মতো তার শোনার ভঙ্গি দেখে আমার বলতে ভালো লাগল। তিনি আমার কাছ থেকে শুনলেন আমার ছোটোবেলার কথাও। শোনার পর তিনি বললেন, ‘আপনার স্বপ্নটির একটা ব্যাখ্যা দেওয়া যায় ওডিপাস কমপ্লেক্স থেকে। আপনি যেসব দালাল-গোমস্তা ও দারোগা দেখেন, এটা হচ্ছে প্যারেন্টাল ফিগার। আসলে আপনার সুপার ইগো। আপনি কাউকে ভালোবাসেন? প্রেম-ট্রেম?’
আমি চিন্তা করলাম, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, এ ব্যাপারে কিছুই মনে করতে পারলাম না। কিন্তু একটু ঘুরিয়ে উত্তর দিলাম। আমি বললাম, ‘ম্যাডাম, সেভাবে হয়তো কাউকে ভালোবাসি না; কিন্তু....’
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘বুঝেছি। আপনি হয়তো কাউকে ভালোবাসেন এবং আপনাদের মাঝে কোনো বাধা আছে। সেটা তৃতীয় কোনো ব্যক্তি হতে পারে বা অন্য কোনো ধরনের সমস্যা হতে পারে। হতে পারে সামাজিক বাধাও। যেমন আপনি এক ধর্মের এবং মেয়েটি অন্য ধর্মের। অথবা আপনি যাকে ভালোবাসেন, সে হতে পারে কোনো ছেলে...’
আমি বললাম, ‘ম্যাডাম, আমি স্ট্রেইট।’
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘তাহলে অন্য ধরনের যে বাধা আছে, এটিই দারোগা-দালাল-গোমস্তা হয়ে আপনার স্বপ্নে হানা দিচ্ছে। আর মলবুস খাস হচ্ছে সেই মেয়ে, যাকে আপনি ভালোবাসেন। আপনি কি জানেন মলবুস খাস কী?’
আমি বললাম, ‘সঠিক জানি না ম্যাডাম।’
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মানের মসলিন, যা মুঘল সম্রাটের জন্যই কেবল তৈরি হতো।’
আমি বললাম, ‘থ্যাংক ইউ ম্যাডাম।’

ভদ্রমহিলা প্রেসক্রিপশনে একটি ওষুধ লিখে দিলেন। বললেন, ‘রোজ রাতে একটি করে খাবেন ঘুমানোর আগে। আর এক সপ্তাহ পরে আবার আসবেন। পরের সেশনে আপনার ছোটোবেলা নিয়ে আরো কিছু কথা বলব।’
ভদ্রমহিলার চেম্বার থেকে বের হওয়ার পর আমি রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম। তখন সন্ধ্যা হয়ে আসছে। আমার দুজন মনোরোগ বিশেষজ্ঞকে নিয়েই ভাবতে ইচ্ছা হলো। দুজন দুইভাবে দেখলেন বিষয়টাকে, ওষুধও দিলেন ভিন্ন। এখন আমি কার কথাটা শুনব বিড়ম্বনায় পড়ে গেলাম। সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে এবং সব শেষে সিদ্ধান্ত নিলাম, দুইটা প্রেসক্রিপশনই ড্রেনে ফেলে দেব এবং ফেলে দিলামও। ড্রেনের মধ্য জমা ছিল অল্প পানি। গত রাতে বৃষ্টি হয়েছিল সম্ভবত এবং পড়ে ছিল একটি মৃত ইন্দুর।

আমার মনে হলো আসলে আমার কোনো সমস্যা হয়নি। স্বপ্ন দেখা স্বাভাবিক ব্যাপার। তাই এ নিয়ে আর দুশ্চিন্তা করে লাভ নেই। আমি যখন বাসায় ফিরছিলাম, তখন আমার ঠিক পাশে এসে একটি বড়ো কালো গাড়ি থামল। স্টেশন ওয়াগন না কী যেন এর নাম এবং এর কাচ তুলে একজন গোঁফওয়ালা লোক বললেন, ‘ব্যাপার কী ভাই? আপনি আজ অফিসে এলেন না, আবার ফোনেও পাচ্ছি না?’
আমি কিছুটা ভ্যাবাচেকা খেলাম এবং দ্রুতই নিজেকে সামলে নিয়ে বড়ো একটা হাসি দিয়ে বললাম, ‘নাথিং, এই তো আছি। একটা কাজে আটকা পড়েছিলাম।’
গোঁফওয়ালা বললেন, ‘তাই বলে ফোনটা অন রাখবেন না?’

আমি পকেটে হাত দিয়ে মোবাইল ফোন আছে কি না দেখার চেষ্টা করলাম, কিন্তু পেলাম না। লোকটাকে হাসিমুখে বললাম, ‘ফোন বোধহয় বাসায় ফেলে এসেছি। স্যরি!’
লোকটা বললেন, ‘ভাই, আপনার কি কিছু হয়েছে? আমাকে জানাতে পারেন।’
আমি বললাম, ‘আরে না! কী আর হবে?’
লোকটা বললেন, ‘ওকে। তাহলে এখন যাই ভাই। কাল কথা হবে অফিসে।’
আমি হাসলাম। লোকটা তার গাড়ি নিয়ে চলে গেল। কিন্তু আমি অফিসের কথা মনে করতে পারলাম না। মনে করতে পারলাম না এই লোকটি আসলে কে। আমি বাসায় গেলাম, গিয়ে মোবাইল ফোনটা পেলাম। বিছানার এক পাশে পড়ে আছে, চার্জ নেই। ফোন চার্জে লাগিয়ে অন করার পরে কিছু মেসেজ দেখতে পেলাম ইনবক্সে। যে নাম থেকে এসেছে, তার নাম অবনী। অদ্ভুত ব্যাপার, মেয়েটি আমাকে ফোনে না পেয়ে বেশ বিরক্ত, তা মনে হচ্ছে মেসেজ দেখে। এবং মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মহিলার কথা আমার মনে পড়ল এই মেয়েটির মেসেজ পড়তে পড়তে। মেয়েটির মেসেজ পড়ে এবং আমাদের মেসেজ হিস্টরি দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল আমার সাথে তার বা তার সাথে আমার প্রেম আছে। আমি চাইলাম ব্যাপারটা কী আরো জানতে। এবং এই সময়ে আমার মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মহিলাটির প্রতি আস্থা তৈরি হতে শুরু করল।

আমি অবনীর নাম্বারে ফোন দিলাম। ওপাশ থেকে ঝাঁজের সাথে সে বলল, ‘এতক্ষণ কোথায় ছিলে? আমি সারাদিন ফোনে পাই না! তোমার বন্ধুরাও কেউ কিছু বলতে পারে না কোথায় তুমি, কী হয়েছে?’
আমি বললাম, ‘নাথিং।’
ঝাঁজের পরিমাণ বাড়িয়ে অবনী বলল, ‘নাথিং কী? এটা কি ফাজলামি করার সময়? কাল আমাদের প্রোগ্রাম, সব গুছিয়ে এনেছি। এর মাঝে তুমি এভাবে নাই হয়ে যাবে? তোমার কি ন্যূনতম দায়িত্বজ্ঞান বলতে কিছু নেই?’
আমি বললাম, ‘স্যরি!’
অবনী বলল, ‘স্যরি কী? লেখা শেষ করেছ?’
আমি অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম, ‘কীসের লেখা?’
অবনী যেন এবার রাগে ফেটে পড়ল। সে বলল, ‘আমাদের প্রোগ্রামের জন্য লেখা। যে প্রবন্ধ তুমি পাঠ করবে। যা তুমি এক সপ্তাহ আগে আমাদের সাথে বসে ঠিক করেছিলে। এখন কি আমাকে বলতে হবে আমাদের প্রোগ্রামের নাম কী এবং তোমার প্রবন্ধের বিষয় কী?’
আমি পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বললাম, ‘ও, ওটা তো শেষই।’
এরপর বুদ্ধি করে জিগ্যেস করলাম, ‘নামটা কী যেন ছিল, ওটা কি বদলে দেব?’
অবনী বলল, ‘না, ‘জনপ্রিয় মাধ্যমে নারীর উপস্থাপন ও বর্তমান নারীবাদী আন্দোলনের সমস্যা’ এই নামই ঠিক আছে। এটাই হবে মূল প্রবন্ধ। লেখা শেষ হয়ে গেলে আমাকে ইমেল করে দাও। আমি দেখে দিই।’
বুঝলাম অবনী একজন নারীবাদী একটিভিস্ট এবং তাদের প্রোগ্রামে আমার প্রবন্ধ পাঠের কথা। বিষয়টি গুরুতর, আমি কী বলব আর বুঝতে পারলাম না। একবার ভাবলাম অবনীকে জিগ্যেস করব আমাদের মধ্যে যৌন সম্পর্ক হয়েছে কি না বা ও সাবমিশিভ কি না। কিন্তু ভয়ে সেসব প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারলাম না। ওর আরো কিছু কথার উত্তরে হ্যাঁ-হু করে ফোন রেখে দিলাম। এবং যে জটিল স্বপ্নজনিত সমস্যায় আমি পড়েছি, তাকে আর সাধারণ ভাবতে পারলাম না। মানুষের মস্তিষ্ক যে অদ্ভুত, এই জিনিসটি ক্রমে আমার কাছে পরিষ্কার হতে শুরু করল এবং আমার ক্ষীণ সন্দেহ হতে শুরু করল আমি কি অবচেতনের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে চলে যাচ্ছি...

সেদিন রাতে আমি দেখি আবার সেই দালাল কাম গোমস্তা লোকটিকে। আমি আবার তার সামনে বসে আছি, বাঁশের চাটাইয়ের দেওয়ালযুক্ত ঘরে। লোকটি এবার রাগান্বিতভাবে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। আমি বেশ কাচুমাচু হয়ে বসে ছিলাম। লোকটি আমার দিকে এগিয়ে এসে বলল, ‘হোয়ার ইজ মাই মলবুস খাস?’
আমি বললাম, ‘স্যার, এখনো পাইনি।’
লোকটি বলল, ‘পাবি না কেন রে হারামজাদা? হোয়াই? দাদনের টাকা নেবার সময় মনে ছিল না? তর বউ কই, হোয়ার ইজ ইওর ওয়াইফ?’
আমি বললাম, ‘স্যার, আমার বউ নাই, আমি অবিবাহিত।’
হুংকার দিয়ে উঠল লোকটা, ‘শাটাপ বেত্তমিজ! বউ নাই তাইলে সুতা কাটে কে? আমার সাথে ফাইজলামি করস? এত বড়ো সাহস তর, তাঁতির বাচ্চা তাঁতি!’
আমি করুণভাবে বললাম, ‘বিশ্বাস করেন স্যার, আমি ফাইজলামি করছি না। সত্যি বলছি।’
লোকটি রাগে কটমট করে আমার দিকে তাকাল।

তার কোমরের কাছে লুকানো একটা জায়গা থেকে চকচকে এক চাকু বের করল, এরপর চাকুটি টেবিলে গেঁথে দিয়ে বলল, ‘হোয়াট ইজ দিস?’
আমি ভয়ার্ত মুখে বললাম, ‘স্যার, এটি একটি চাকু।’
লোকটি বলল, ‘নট অর্ডিনারি চাকু, ইট ইজ চাক্কু। এটা দিয়া তোদের মতো দুই পয়সার বেইমান তাঁতিদের আঙুল কাটা হয়। কাটা হবে মিডল ফিঙ্গার। হাতটা দে তো দেখি?’
ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে গেল। আমি বললাম, ‘স্যার, আপনি যা বলবেন আমি তা শুনব। আমার হাত কাটবেন না।’
লোকটা বলল, ‘আঙুল যদি বাঁচাইতে চাস, যা তাঁতিপাড়ায় যা। তর বউরে খুঁইজা বাইর কর। এবং সে যে সুতা কাটছে, সেইসব দিয়া কাপড় বুনতে লাইগা যায়। অ্যান্ড নেক্সট টাইম কাম টু মি উইথ মলবুস খাস।’
আমি আঙুল বাঁচাতে গিয়ে বললাম, ‘জি স্যার, যাচ্ছি।’
আমি ঘরের দরজার সামনে গেলাম, বাইরে অন্ধকার, কিন্তু এবার আমি বেশিক্ষণ দাঁড়ালাম না। কারণ বেশিক্ষণ দাঁড়ালে পশ্চাদ্দেশে লাথি খেতে হয়। কিন্তু অন্ধকারে যেতেও ভয় হচ্ছিল, তাই মাথা ঘুরিয়ে লোকটিকে বললাম, ‘স্যার, আন্ধার, ডার্ক।’
লোকটা গর্জে উঠল, ‘ইংলিশ চুদাবি না, রান রান।’
যা থাকে কপালে, দিলাম দৌড়, হাঁপাতে হাঁপাতে গিয়ে থামলাম এক গলির মুখে। মনে হলো একটা কোনো পাড়া, অল্প অল্প আলো জ্বলছে ঝুঁপড়ির মতো ঘরগুলোতে। আমার মনে হলো আমি তাঁতিপাড়ায় এসে গেছি। চারিদিকে তাকিয়ে এক জায়গায় দেখলাম তিনটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাদের কাছে গেলাম। তাদের শরীরে পোশাক-পরিচ্ছদের স্বল্পতা চোখে পড়ার মতো। ফলে আমি তাদের দিকে তাকাতে পারলাম না। অন্যদিকে তাকিয়ে জিগ্যেস করলাম, ‘ম্যাডাম, এটা কি তাঁতিপাড়া?’
একজন মেয়ে বলল, ‘কার সাথে কথা বলেন? আমাদের সাথে কথা বললে আমাদের দিকে তাকিয়ে কথা বলুন। আমাদের শ্রীঅঙ্গে আব-ই-রওয়ানের সাতটি করে জামা, এগুলো যদি লোকে না দেখে, তাহলে কী জন্য পরলাম?’
আমি ভ্রু কুঁচকে তাকালাম ওদের দিকে। তখন বুঝতে পারলাম পোশাকের স্বল্পতা নয়, তারা যা বলছে তা হয়তো ঠিক। এত সূক্ষ্ম কাপড়ের জামা যে সাতটি পরলেও বোঝা যায় না। ভয়াবহ ব্যাপার...আমি এসব না ভেবে তাদের জিগ্যেস করলাম, ‘ম্যাডাম, এটা কি তাঁতিপাড়া?’
মাঝখানের মেয়েটা বলল, ‘না, এটা মাগিপাড়া।’
আমি বললাম, ও..., আপনারা কি তাঁতিপাড়া কোনদিকে আমাকে বলতে পারবেন?’
এর উত্তরে তিনটি মেয়েই তাদের বুকের কাপড় সরিয়ে ফেলল আর আমি তৎক্ষণাৎ অন্যদিকে মুখ ফেরালাম। মুখ ফেরানোর আগে একদৃষ্টিতে যা দেখেছিলাম, তাতে বুঝলাম মেয়েগুলোর স্তনের আকার বেশ বড়ো, বিশেষ করে মাঝের মেয়েটিকে দেখে মনে হলো সে যেন সুলতানের চিত্রকর্ম থেকে স্তন নিয়ে উঠে এসেছে। আমি অন্যদিকে মুখ রেখেই ওদের বললাম, ‘এ আপনারা কী করছেন? আমার তাঁতিপাড়ার খোঁজ জানা দরকার। আমার জীবন-মরণ নিয়ে টানাটানি চলছে।’

তিনটা মেয়েই বুকের কাপড় উঠিয়ে নিয়ে বলল, ‘হারামি, তরে তো আমরা তাঁতিপাড়া কোথায় তাই বললাম। তুইই তো মুখ ফিরিয়ে নিলি।’
আমি মুখ ঘুরিয়ে অবাক হয়ে বললাম, ‘সেটা কীভাবে? আপনারা তো বক্ষ দেখালেন!’
একেবারে বাম দিকের মেয়েটি বলল, ‘না, তোমারে নামতা শেখালাম। দুই একে দুই, দুই দুগোনে চার, তিন দুগোনে ছয়...বাল আমার!’
মেয়েদের গালি আমার গায়ে লাগল না। কারণ তাঁতিপাড়ার খোঁজ আমাকে পেতেই হবে। চারপাশে আর কোনো জনমানব নেই, তাই এরাই আমার ভরসা। দরকার হলে পায়ে পড়ব, তবু তাঁতিপাড়ার খোঁজ নিতে হবে।
আমি দুঃখী মুখে বললাম, ‘দেখুন, আপনারা আমাকে গালি দিন আর যাই করুন, আমার তাঁতিপাড়ার খোঁজ খুব দরকার। আমার লাইফ ইজ ইন ডেঞ্জার।’
গর্জে উঠল মাঝের মেয়েটি। বললো, ‘ওই খবরদার! ইংরাজি চুদাবি না, থাবড়াইয়া দাঁত ফেলে দেব বান্দির পোলা।’
আমি বললাম, ‘জি আচ্ছা। ভুলে বের হয়ে গেছে মুখ দিয়ে। আর ইংরাজি বলব না। মাফ করে দেন।’
মেয়েটি বলল, ‘ঠিক আছে। যা যা।’
আমি বললাম, ‘কিন্তু দয়া করে তাঁতিপাড়ার খোঁজ দিয়ে আমাকে সাহায্য করুন।’
ডান পাশের মেয়েটি বিরক্ত ভঙ্গিতে বলল, ‘আরে দিলাম তো একটু আগে। প্রথমে বাম দিকে যাবি দুই মাইল, এরপর পাবি তিনটা রাস্তা, মাঝের রাস্তা দিয়া যাবি দুই মাইল, এরপর পাবি আবার তিন রাস্তা, তখন ডানের রাস্তা দিয়া যাবি দুই মাইল। তবেই পাবি তাঁতিপাড়া।’
আমি তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে বামে দিলাম দৌড়। তাদের খিলখিল হাসির শব্দ আসতে লাগল কানে এবং সেই হাসির শব্দ পুরোপুরি মিলিয়ে যাওয়ার আগেই আমার পা হড়কে গেল এবং আমার মনে হলো আমি কোনো ম্যানহোলের গর্তে পড়ে যাচ্ছি। আমি বেশ কিছক্ষণ শূন্যে ভেসে গিয়ে পড়লাম ঘন একপ্রকার আধা তরল পদার্থে এবং নাকে আসা গন্ধের বরাতে আমি নিশ্চিত হলাম এসব ঘন অর্ধ তরল পদার্থ মনুষ্য বর্জ্যই...
আমার ঘুম ভেঙে গেল, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। কেউ কেউ এটাকে বলে হুমায় ধরা আর কেউ বলে স্লিপ প্যারালাইসিস। কিন্তু আমি জানি আমার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হওয়ার কারণ ছিল মানুষের গুয়ে নিমজ্জিত হওয়া...সিই রাতে আর আমার ঘুম হলো না। আমার কী হচ্ছে বা আমার কী করা উচিত কিছুই আমি ভাবতে পারছিলাম না।
সকালে ভোরের আলো ফুটে উঠলে আমি একটি ফার্মেসিতে যাই এবং গিয়ে জিগ্যেস করি, ‘আপনাদের এখানে কি ইন্দুর মারার ওষুধ আছে? ল্যানিরেট?’
ফার্মেসির লোকটা আমার দিকে চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাল। হয়তো না ঘুমানোর ফলে আমার লাল চোখ ও ফোলা মুখ দেখে সে আমাকে অপ্রকৃতিস্থ ভেবেছিল অথবা অন্য কিছুও হতে পারে। লোকটি আমাকে বলল, ‘না, নেই। মুদিদোকানে দেখেন। এটা ফার্মেসি, এখানে মাইনষের ওষুধ বিক্রি হয়।’
আমি গেলাম এই মুদিদোকানে। গিয়ে কয়েক প্যাকেট ইন্দুরের ওষুধ নিয়ে এলাম বাসায়। এরপর এগুলো পানির সাথে মিশিয়ে খেয়ে ফেললাম এবং খাওয়ার সময় আমার মনে হলো আমি লেবুর শরবত খাচ্ছি। তবে বিট লবণর পরিমাণ একটু বেশি হয়ে গেছে, তাই স্বাদ ভালো না।

ইন্দুরের ওষুধ খাওয়ার পর আমি ভেবেছিলাম যে আমি মরে যাব। কিন্তু কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও মরার কোনো লক্ষণ দেখতে পেলাম না। কিছুটা অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম, তখন পশ্চাদ্দেশে সুড়সুড়ি অনুভব করি আর সেই সুড়সুড়ির জায়গাটিতে হাত দিয়ে দেখতে পাই আমার লেজ গজিয়েছে। তখন আমি আমার পায়ের দিকে তাকিয়ে দেখি আমার পা-ও হয়ে যাচ্ছে ইন্দুরের পায়ের মতো। আমার সারা শরীরে জন্ম নিচ্ছে ইন্দুরের লোম, তাই আমি খুবই দ্রুত সব লিখে রাখছি। কারণ আমার ধারণা দ্রুত আমি পরিণত হবে এক ইন্দুরে। সেই ইন্দুর পাঁচ ফিট আট ইঞ্চির অধিক লম্বা হবে, নাকি সাধারণ ইন্দুর সাইজের হবে, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত না। তবে হে পাঠকবৃন্দ, হে আমার ভাই ও বোনেরা; আপনারাই পারেন আমাকে বাঁচাতে। যদি দেখেন কোনো বড়ো সাইজের একটি ইন্দুরকে নিয়ে হইচই শুরু হয়েছে, তাহলে নিশ্চিত জেনে রাখুন ওটা আমি। আর আমি যদি কোনো ছোটো ইন্দুর হই, তাহলে কোথাও কোনো ছোটো ইন্দুর যদি আপনারা দেখেন, তাহলে জেনে রাখবেন, ওটা আমি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এই ইন্দুর হওয়ার কালে আমার ভয় হচ্ছে, গবেষকেরা আমাকে ল্যাবে নিয়ে কাটাছেড়া, টেস্টফেস্ট করবে। নানাবিদ ড্রাগ দিয়ে আমার প্রতিক্রিয়া কী হয় তা বিচার-বিবেচনা করবে। এ বড়ো কষ্টের শাস্তি। বায়োলজি প্রাক্টিক্যালে ব্যাঙ কাটাকুটির সময় বুঝতে পারিনি, এখন ব্যাঙের দুঃখ বুঝতে পারি। বুঝতে পারি যে ওই ব্যাঙ আমিও হতে পারতাম; তাই আমার ভয় হচ্ছে, এই সব কঠিন শাস্তির ভয়। আপনারা আমাকে বাঁচাবেন, এ আমার অনুরোধ। কারণ আমি তো আসলে ইন্দুর না, আমি মানুষ। হোমো ইরেক্টাস থেকে আগত হোমো সেপিয়েন্স, আপনাদের মতোই...ক্যাক...