মৃদুল মাহবুবের গদ্য ‘পাকিস্তান সরকারের প্রতি নিন্দা ও ক্ষোভ’

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১১, ২০২০

পা‌কিস্তা‌নি ঔপন্যা‌সিক মোহম্মদ হা‌নি‌য়ের A Case of Exploding Mangoes এর উর্দু অনুবাদের সকল কপি প্রকাশকের দপ্তর থেকে সিজ করা হয়েছে বলে খবর জা‌নি‌য়ে‌ছে গার্ডিয়ান। উপমহাদেশর উপন্যাসের খোঁজখবর যারা রাখেন তারা জানেন, হানিফ খুবই গুরুত্বপূর্ণ লেখক এ অঞ্চ‌লের। ২০০৮ সালে প্রকাশিত তার এক্সপ্লোডিং ম্যাঙ্গো দীর্ঘদিন বুকারের তালিকায় ছিল, গার্ডিয়ানের ফাস্ট বুক অ্যাওয়ার্ড তালিকাতেও ছিলে। এটা কমনওয়েলথ বেস্ট বুক পুরস্কার পায়। তিনি পাকিস্তান এয়ার ফোর্সে পাইলট অফিসার থাকলেও সেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে সাংবাদিকতায় যুক্ত হন। ১৯৯৬ সালে লন্ডনে বিবিসিতে যোগদান করেন। তিনি বিবিসি উর্দু শাখার প্রধান ছিলেন।

১৯৮৮ সা‌লে পাকিস্তানের সাম‌রিক শাসক জেনা‌রেল জিয়া উল-হ‌ক বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান খুব রহস্যজনক ভা‌বে। ১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তি‌নি খুবই দক্ষ সেনা অ‌ফিসার ছি‌লেন। তার একা‌ডে‌মিক্যালি তি‌নি জি‌নিয়াস। ১৯৭০ সালে জর্ডানের বাদশা হুসেইনকে উৎখাতের হাত থেকে রক্ষা করেন। সেই সময় তিনি সেনাদলের প্রশিক্ষণে ছিলেন সেখা‌নে। এরই স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৬ সালে জুলফিকার আলী ভুট্টো তাকে সশস্ত্রবাহিনীর প্রধান হিসাবে মনোনিত করেন। আর ১৯৭৯ এ জিয়াই ভুট্টোকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন তিনিই। বাংলাদেশের সামরিক শাসকদের সাথে তার কোথাও কোথাও মিল পাওয়া যায়। জিয়া যেমন কর্নেল তাহেরের ফাঁসি কার্যকর করেছিলে।

পাকিস্তানকে ইসলামিক র‍্যাডিক্যালাইজেশন করতে যার ভূমিকা সব থেকে বেশি, তিনি জেনারেল জিয়া। জিয়া উল-হকের সরকারের সময়ই আফগান মুজাদিদের সহায়তায় রাশিয়াকে বিতাড়িত করা সম্ভব হ‌য়ে‌ছি‌লে। জিয়ার ব্যাপক ভূমিকা ছিল এতে। আফগা‌নে সো‌ভি‌য়েত পতনে তার ব্যাপক ভূ‌মিকা। স্নায়ুযু‌দ্ধে আমেরিকার জ‌য়ের রশদ তি‌নি জু‌গি‌য়ে‌ছেন। সেই হিসাবে আমেরিকা ও সৌদি আরবের সাথে গভীর বন্ধুত্ব। আফগান মুজাহিদদের প্রশিক্ষণ দেয়া থেকে ডলারের ভাগ বাটোয়ারা তার লোকজনই করেছে। পাকিস্তান পারমাণবিক অস্ত্র কার্যক্রম তার আমলেই শুরু হয়। পাকিস্তানের বিশ্ব রাজনীতিতে সফল কূটনৈতিক তৎপরতা সেই সময়েই ব্যাপক ভাবে শুরু করে।

এই ডাকসাইটে জেনারেলের এগারো বছরের শাসনকাল শেষ হয় অতি সহসা। ১৯৮৮ সালে সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। কিন্ত ১৭ আগস্ট বিমান দুর্ঘটনার ভেতর দিয়ে পাকিস্তানের এই শাসকের জীবনাবসান হয়। এই দুর্ঘটনার সময় পাকিস্তানে নিযুক্ত আমেরিকার রাষ্ট্রদূতও পাক ওয়ান বিমানে ছিল। রাষ্ট্রদূতসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ হাই অফিসিয়ালদের নিয়ে বিমানটি ভূপাতিত হয়। বাইশ জ‌নের সক‌লেই মৃত্যুবরণ করে। এটা নিয়ে নানা রকম কন্সপাইরেসি থিয়োরি আছে। তবে এ নিয়ে খুব বেশি উচ্চবাচ্য পাকিস্তান থেকে শুরু করে আমেরিকা, কেউই করেনি। সকলে বেশ নীরব থেকেছে। এই মৃত্যু রহস্যকে আরো রহস্যাবৃত্ত করে রাখা হয়েছে।

আমেরিকা তাদের রিপোর্ট প্রকাশ করেনি। ফলে হানিফ চেষ্টা করেছেন এই রহস্য উন্মোচন করতে তার উপন্যা‌সে। প্রচলিত যে থিয়োরিগুলো ছিল হানিফ তার বাইরে গিয়ে ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে চেয়েছেন। স্যাটায়া‌রিক ফ‌র্মে লেখা এই উপন্যাস। ফ‌লে পা‌কিস্তানের সেনাবা‌হিনী, বিমান বা‌হিনী, আইএসআই, তৎকালীন ক্ষমতা নি‌য়ে সি‌রিয়ালি ভঙ্গিতে কিছু লেখা থে‌কে স্যাটায়া‌রিক ফ‌র্মে লেখা ভা‌লো। অন্য ভাষায় হলে আরো ভালো হয়। ফলে হানিফ পাকিস্তানের খুব স্পর্শকাতর বিষয়গুলো হাসি তামাশার ছলে অনেক কথা বলে দিয়েছেন তার বইতে। আমরা যেমন অনেক সময় রুড না হয়ে, হাসতে হাসতে মানুষকে মজা করার ভেতর দিয়ে অনেক সত্য কথা বলে ফেলি।

সাথে বলতে থাকি, জাস্ট কিডিং। কিন্তু যে বলে আর যে শোনে দুজনে বুঝতে পারে আসলে কথা কী হলো। হানিফের উপন্যাসের ফর্মটাও এই হাসি তামাশা। এই তামাশার ভেতর দিয়ে শাসকদের যা যা বলার তিনি তা বলে দিয়েছেন। ফলে জাস্ট ফান হিসাবে নিতে পারছেন না রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলো। মোহম্মদ হানিফ বুঝদার লোক। ফলে তিনি জানেন কী জিনিস কোন ফর্মে লিখতে হবে, কাজ হবে, নিজের প্রতি প্রতিক্রিয়া এড়ানো যাবে। কিস্তু তার বই উর্দুতে অনুবাদ হবাব পর সে রক্ষা আর হচ্ছে না। এটা ইংলিশে প্রকাশতি করে রেখেছিলেন প্রায় এক দশক। ২০০৮ সা‌লে প্রকা‌শিত তার প্রথম উপন্যাস A Case of Exploding Mangoes গত বছর উর্দু‌তে ভাষান্ত‌রিত হয়নি। উর্দু‌তে প্রকা‌শিত হওয়ার পর গত পরশু প্রকাশ‌কের দপ্তর থে‌কে আইএসআই সিজ ক‌রেছে তার সকল বই। সুস‌জ্জিত, ডি‌সি‌প্লিনড একটা বা‌হিনী‌কে নি‌য়ে হাসাহা‌সি চল‌তে পা‌রে না। তা‌দের ভাষ্য ম‌তে, cheap attempt to gain popularity by hurling false accusations on a national institution.

হানিফ আমার প্রিয় ঔপন্যাসিক। তার বইগু‌লো সংগ্রহ কর‌ছি এক এক ক‌রে। তার বই সিজ করার জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রতি নিন্দা ও ক্ষোভ।

লেখক: কবি